মৃত্যু

Please log in or register to like posts.
পোস্ট
মৃত্যু

এক.

 

“হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান

তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান

চরণ দুটি একসময় খুব উদ্বেলিত করত। নিজেকে মহান ভাবতে, খ্রীস্টের সমান সম্মান প্রাপ্তিতে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতেন কোথায় হারিয়ে যেতাম! আজকাল আর ভালো লাগে না। নিষ্ঠুর উপহাস মনে হয়

 

নিদারুণ অর্থ কষ্টে ভুগছি ক’দিন যাবতপকেটে একটা পয়াসাও নেঅর্থাভাবে গতকাল প্রায় আট-দশ কিলোমিটার হেঁটেছিএকটানা হেঁটেছি সোয়া এক ঘন্টার মত। কিছু করার নেই। নিজের কোনো আয়-রোজগার নেইপাঁচটা টাকার জন্যেও আম্মার কাছে হাত পাততে হয়নিজেরই কেমন জানি সংকোচ লাগে! কত বন্ধুদের বললাম একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে। কেউ দেয় না

সেদিন আসলাম তো বলল, দোস্ত, তুই লেখক মানুষ। তুই চাকরি দিয়ে কি করবি। তোকে চাকরিতে মানায় নালেখালেখি তে মানায়

হারামজাদার কানপট্টির ঠিক এক সেন্টিমিটার নীচে থাপ্পড় দেয়ার ইচ্ছাটা বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করলামএকবার ভাবলাম বলি, “তোর মতো হাঁদারাম কে হাঁদারামিতে মানায়, জ্ঞান দেয়াতে মানায় না” কিন্তু বললাম না। মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে এলাম

 

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়নালকে খুব করে ধরেছিলাম, কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে। সে দুই-তিনটা টিউশনি করেআবার কোচিং-টোচিংয়েও ভাল যোগাযোগ আছে। ক্লাস নেয়, খাতা কাটেছোটখাটো ব্যবসাপাতিও শুরু করেছে। রোজগার তাঁর ভালো

সে কিছুটা উদাস হয়ে আমার কাঁধে হাত রাখে আর বলে, “শোন, তুই একটা প্রতিভা। বুঝলি, প্রতিভাসৃষ্টিকর্তা এই লেখালেখির মহৎ গুণটা সবাইকে দেন না। স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট মানুষদেরকেই দেন। বুঝলিতো এখন যদি আমি তোকে একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেই, তাহলে তোর মনোযোগ লেখালেখিতে থাকবে না। টাকার দিকে চলে যাবে টিউশনি একটা করলে, দুইটা খুঁজবি। দুইটা পেলে চারটাদোস্ত, আমরা তো করছি। আমরা জানিএই টাকার নেশাটা বড় কঠিন নেশাতোর টাকার দরকার লাগলে আমাকে বলিস। আমি সাধ্যমত তোকে সাহায্য করবকিন্তু তোকে কিছু ঠিক করে দেব নাতুই রাগ করিস আর আমাকে গালি দিস, আমি তোকে কোনো ব্যবস্থা করে দেবো না

তখন ব্যাটার এই ফিলোসফি কপচানো শুনে বেশ রাগ হয়েছিলআবার তাঁর এই কথাগুলা আমাকে বেশ প্রভাবিতও করেছিলকিছুদিনের জন্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার অর্থকষ্টের ব্যাপার-স্যাপার

বড় লেখকদের জীবনীও আমাকে বেশ প্রলুব্ধ করতভাবতাম, তাঁরাও তো কত কষ্ট সয়েছেনএই লেখালেখির জন্য জেল-জুলুম ছাড়াও অভাব-অনাহার ছিল তাদের নিত্য সঙ্গীকার্ল মার্কসের মৃত্যুর সময় তাঁকে ক’জন চিনত! অথচ মৃত্যুর পর তাঁর জগজোড়া খ্যাতি হয়েছে। এমন বহু লেখক আছেন

আমিও ভাবতাম আজ হয়তো কষ্টে দিনাতিপাত করছিকিন্তু যা রেখে যাচ্ছি, হয়তো মৃত্যুর পর আলোড়ন তুলবেলেখক-খ্যাতি বিশাল ব্যাপারএই সম্মানের কোনো তুলনা হয় না। রাস্তা-ঘাটে কোনো বন্ধু বা পরিচিত কেউ যখন বলে উঠে, “কি খবর লেখক সাহেব? কেমন আছেন?”

বুকের ভেতরটা কি এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে উঠেসব শূণ্যতা, না-পাওয়া কোথায় যেন উবে যায়স্বর্গীয় প্রশান্তিতে আমার চোখমুখে অন্যরকম প্রফুল্লতা চলে আসেআমার দেহের প্রতিটি কোণ-কোষ, লোম-কূপ পরম পূর্ণতায় ভরে উঠেআমি নিজেকে লেখক ভাবতে তৃপ্ত বোধ করতে থাকি। এ এক অন্য রকম অনুভূতি…

 

 

দুই.

লেখালেখি করে তো আর পেট ভরে নাকাপড়-চোপড়ও বানানো যায় না। এসবের জন্য টাকা লাগেতাই লেখালেখি করলেও অর্থাভাব মাঝেমধ্যেই আমাকে পীড়া দেয়আব্বা একসময় খুব বকাঝকা করতেনপড়ালেখা মাঝ অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছি বলে। ঘরে বসে থেকেছি বলেচাকরি বাকরি করছি না বলে। ঘরের কোনো দায়-দায়িত্ব নিচ্ছি না বলেঅভিযোগ কত…! অন্তহীন

 

আজকাল আর বকা দেন না । ভুল করে হোক বা যেভাবে হোক আমার একটা লেখা একবার এক সাহিত্য সাময়িকী ছাপিয়েছিলখুবই অখ্যাত আর অনিয়মিত একটা সাহিত্য সাময়িকী। সেটা আব্বাকে দেখিয়েছিলামসেই থেকে আব্বা আর কিছু বলেন নাছাপার অক্ষরে নিজের ছেলের নাম দেখেছেন বলেই কি না কে জানে!

এই দূর্ঘটনার (!) পর থেকে আমাকে একদম কিচ্ছু বলেন নাকি জানি, আব্বাকেও ‘লেখকের বাবা’ হওয়ার মোহ পেয়ে বসেছে কি না! পেলে তো সর্বনাশ! এই মোহ বড় কঠিন মোহএকবার যাকে পেয়েছে, তার আর নিস্তার নেই

 

অনার্স চতুর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা দিই নাইলেখালেখি, সাহিত্য, লেখক, গল্প, কবিতা… এইসব এমনই মোহগ্রস্থ করে দিল যে, পড়ালেখা আর চালানো গেল নাসেই থেকে একদম বেকার। কিচ্ছু করি না, লেখা-জোখা ছাড়া

 

 

তিন.

আব্বার চাকরিটা এই বছরই শেষ। বোনটারও বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ে দিতে হবেআম্মারও ‘চোখের ছানি অপারেশন’ করানো খুব জরুরী আব্বার রিটায়ারমেন্টের টাকা থেকে ব্যাংকের লোন কেটে রাখবেতারপর আর কত থাকবে, কে জানে! বোনটার বিয়ে দিতে হলেও টাকা লাগবে অপারেশনেও মোটা টাকা দরকারএরপর চলতে গেলে তো কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকারকিন্তু করব টা কি?

এসব চিন্তা হঠাৎ পেয়ে বসলে একদম অস্থির হয়ে যাই আমি

 

আর থাকতে না পেরে এক বন্ধুকে অনুনয় করে বলেছিলাম, অন্তত একটা টিউশনি যেন ঠিক করে দেয়। সে দিয়েছিলকিন্তু একমাস পূরণ হওয়ার আগেই টিউশনি টা চলে গেলগৃহকর্তা চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান বদলি হয়েছেনপরিবার সহ উনার সাথে নিয়ে গেলেনসাথে আমার টিউশনিটাওকপাল আর কাকে বলে!

টিউশনি টা চলে গেলেও সজিব কে কিছু বলি নাইবারবার এভাবে ধরণা দিতে ভালো লাগে না। লেখক হওয়ার এই আরেক জ্বালা! আত্নসম্মান বোধ টা এত টনটনে হয়ে যায়… এক্কেবারে যখন-তখন টনটন করে বেজে উঠে

তাই জয়নাল যেকোনো সময় সাহায্য নিতে বললেও কখনো নিই নাই। আমি জানি, জয়নাল এমনি এমনি কোনো কথা বলে নাআমি চাইলে সে নিজের রক্ত বেঁচে হলেও আমাকে সাহায্য করবেসে আমাকে বড় ভালবাসেলেখালেখির জন্য হয়তো শ্রদ্ধাবোধও আছে

জয়নালের সাথেও দেখা হয়েছে প্রায় মাস-দুয়েক হলো

সেবার তাঁর বাসায় গিয়েছিলামবললাম, “প্রতিভা-টতিভার কথা বলিস না। আমার ভালো লাগে নাআমি তো প্রতিভা পাতিল না, আমার পাতিল ভরা প্রতিভা নাই। আমি অতি সাধারণ মানুষবেঁচে থাকার জন্য আমার কিছু একটা অবলম্বন দরকার। একটা আয়ের উৎস দরকারতুই কিছু একটা করে দে

সে কিছুক্ষণ কি জানি ভাবলতারপর বলল, “দেখ, তুই আমাকে কি ভাবিস জানি না! তবে আমি সত্যি মন থেকে চাই, তুই লেখালেখিতেই ক্যারিয়ার কর…

বিরক্ত হয়ে তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম, “আবার, শুরু করেছিস!”

সে আরো কি চিন্তা করলতারপর আচমকা বলে উঠল, “আচ্ছা, এক কাজ করা যায়তোর পত্রিকার কারো সাথে কোনো লিংক আছে?”

না তো!

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল। “তাহলে তো হবে নাআমারও ঐ লাইনে কোন লিংক-টিংক নাইথাকলে করে দিতাম

আমি আশ্চর্য্য হয়ে বলেছিলাম, “পত্রিকা দিয়ে কি হবে?”

আরে, পত্রিকায় লিখলে কিছু সম্মানী পাওয়া যায়নিয়মিত লিখতে থাকলে পরিচিতিও আসে। তবে তাতে ভালো যোগাযোগের প্রয়োজন হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে রিলেশন লাগে। তোর তো সেটা নাই

আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলামআমার তো তাহলে হবে না

একটু পর জয়নালই বলেছিল, “তুই একটা কাজ করতোর যখন লেখার হাত ভালোঅন্যদিকে না-গিয়ে এই লেখালেখি দিয়েই কিছু আয় করা যায় কি না চেষ্টা কর। পত্রিকায়-টত্রিকায় লেখা দেয়আর একটা বই বের করতে পারিস না কি দেখ। জানাশোনা প্রকাশনী আছে?”

আমি দুই পাশে মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিলাম, নাই

সে বলেছিল, “ব্যাপার নাএখন বইমেলার সিজন না। প্রকাশনীগুলোতে হয়তো তেমন ব্যস্ততাও নাইতুই একটা চেষ্টা করে দেখতবে নাম করা কোন প্রকাশনীতে না গিয়ে ছোটখাটো অখ্যাত কোন প্রকাশনীতে যাবি। বড় প্রকাশনীগুলো তোদের মত তরুণ লেখকদের সাথে কথা-ই হয়তো বলবে না। ছোটগুলোতে একটা চেষ্টা করে দেখআর পত্রিকার ব্যাপারটাও মাথায় রাখিস

 

আমি মোটামুটি বেশ আশ্বস্ত হয়েছিলাম আশন্বিতও হয়েছিলাম খুবতাঁর এই পরামর্শ আমার চমৎকার লেগেছিল

 

চার.

কাজে না নামলে বোঝা যায় না কাজ কত কঠিন! জয়নালের কথামতো একটা প্রকাশনী খুঁজে বের করলামতুলনামূলক ভাবে অখ্যাত। প্রকাশনীর নামটা… উদয়ন… উড়ন… না উন্নয়ন… কি একটা জানি ছিল! ঠিক মনে নাইশুধু মনে আছে প্রথমে রস্য’উ আর শেষে দন্ত্য’ন ছিল

প্রকাশনীতে তেমন ভীড় চোখে পড়ে নাই গিয়ে সোজা প্রকাশকের কাছে গেলামতিনি আমাকে দেখেই বললেন, “হেঁটে এলেন বুঝি?

আমার কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছিলগায়ের টি-শার্ট টা শরীরের সাথে একদম লেপ্টে ছিল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলামতাই আমাকে দেখে বোঝা যাওয়ারই কথা, আমি হেঁটে এসেছিতবু ভদ্রলোকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করল

আমি ছোট্ট করে মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, জ্বী

 

প্রকাশক সাহেব কাকে যেনো ঠান্ডা পানীয় আনার নির্দেশ দিলেন। আমাকে ইঙ্গিতে বসতে বললেনআমি বসলাম

পান্ডুলিপি উনার হাতে দিলাম। উনি নেড়েচেড়ে দেখলেন “আপনারই লেখা বুঝি?

জ্বী

তিনি আরো একটু নাড়াচাড়া করলেনএত কি দেখছেন, বুঝতে পারছি নাপড়ছেন বলেও মনে হচ্ছে না । শুধু এদিক সেদিক, এ-পাতা সে-পাতা কি জানি দেখছেন । ভাবটা এমন, যেন আমি উনাকে জাল নোট ধরিয়ে দিয়েছি, আর উনি তা চেক করছেন

আগে কোনো বই বের করেছেন?

জ্বী না, স্যার

স্যার বলছেন কেন? আমি কারো স্যার নাস্যার বলবেন না

আচ্ছা, বলব না জনাব

জনাব! জনাবও বলার দরকার নাই

তাহলে কি বলব?

কিচ্ছু বলার দরকার নাইযদি সম্পর্ক আরো স্থায়িত্ব লাভ করে, তখন সম্বোধন একটা

ঠিক করে নেয়া যাবে। আপাতত কিছু না-ডাকলেই খুশী হবো

আচ্ছা, ঠিক আছে

 

আমার চেহারা ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। ডেকচির তলার মত। চেহারায় কোনো শিশুসুলভ সরলতা নাইতবুও কেন জানি লোকেরা আমাকে খুব মায়া করে। আমি বুঝতে পারিআমি চেষ্টা করছি প্রকাশক সাহেবের মনে, মায়া জন্ম দিতেযেন কাজটাতে একটু সুবিধা লাভ করতে পারিরোদে-ঘেমে ক্লান্ত চেহারা আমাকে সাহায্য করছে, লোকটার মনে মায়াভাব জন্ম দিতে

মনে হয় কাজ করছে একটু একটু। কেন জানি প্রকাশক সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি কিছু কঠিন কথা বলতে চানকিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে আবার চুপসে যাচ্ছেনআমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, উনি কি বলেন শোনার জন্য

 

লেখালেখি কতদিন ধরে করেন ?

ক্লাস সেভেন-এইট থেকে

হুমতাহলে আপনি লেখক?

ওই আর কি…! ঠিক সেভাবে লেখক বলা যায় না!

আচ্ছা। তা কোনো পত্রিকা-টত্রিকায় লেখা বের হয়েছে? সাময়িকীতে?

জ্বী না

অহ তা যারাই লেখেন, তাঁরাই তো লেখক। তাই না?

জ্বী

ব্যাংকের এ্যাকাউন্টেন্ট সারাদিন লিখছেন, তিনিও তো লেখকতারপর আপনার যারা হিসাবের ব্যাপার-স্যাপার দেখেন তাঁরাও তো লেখক। যিনি লিখছেন তিনিই লেখক। তাই না? নাকি নয়?

জ্বী, একদম তাই

কিন্তু সেভাবে বলা হয় না। কেবলমাত্র যারা আপনার মতো লিখেন তাদের লেখক বলা হয়, অন্যদের বলা হয় না এটা কেন জানেন?

জানি নাআপনিই বলেন

লক্ষ করেন, যারা লেখাটাকে নেশা হিসেবে নিচ্ছেন তাঁরা লেখকআর যারা পেশা হিসেবে নিচ্ছেন তাঁরা নয়। বুঝতে পারছেন

জ্বী

 

তিনি একটু বিরতি নিলেন। বাইরে কোথায় জানি গেলেন। আমি ঠান্ডা জুসটা এক ঢোকে শেষ করে ফেললাম

 

পাঁচ.

প্রকাশক সাহেব এসেই বলে উঠলেন, “এবার আসেন বইয়ের কথায়। আপনাকে কয়জন চিনে?”

সেভাবে তো কখনো গুণে দেখি নাই। তবে শ’খানেক হতে পারে। পাঁচশও হতে পারে

আচ্ছা… বুঝলামতো এবার আপনার বই আমি প্রকাশ করলামকত কপি বিক্রির নিশ্চয়তা দিতে পারবেন?

একটারও পারবো না

তবুও আপনি চেষ্টা করলে পঞ্চাশ-একশ হয়তো পারবেন

জ্বী, হয়তো …

কিন্তু আমি যে বইগুলো প্রকাশ করব… সে তো বিক্রির জন্য, নাকি? আচ্ছা, আপনি কি করেন?

কিছু না

একদম কিচ্ছু না? স্টুডেন্ট?

জ্বী না

চাকরি-বাকরি?

না, আমি একদম কিছুই করি না

হুম, বুঝেছিকিন্তু এটা আমার ব্যবসা। এই করেই আমি পেট চালায়। জীবিকা নির্বাহ করি। এটাই আমার আয়ের উৎস। বুঝতে পারছেন?

জ্বী, বুঝতে পারছি

এখন আপনিই বলেন, জেনে শুনে আমার কি লস প্রজেক্টে হাত দেয়া উচিৎ?

জ্বী না, উচিৎ নয়।”

তিনি কিছুক্ষণের জন্য একদম চুপ মেরে গেলেনতারপর আবার বলে উঠলেন, “দেখেন, ইরফান সাহেব, আপনাকে আমার ভালো লেগেছেআমার যদি ক্ষমতা থাকত আমি আপনাকে বিনা মূল্যে বই প্রকাশ করে দিতাম। কিন্তু আমি সেটা পারবো নাআপনাকে কি আমি বোঝাতে পারছি আমার কথা?

জ্বী, পারছেন

তবে একটা বিষয়ে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি, আপনার বই বিক্রির ব্যবস্থা আমি করবো কারণ, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে

আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বললাম না

তিনিই বললেন, “অনেক সময় লেখকের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ নেয়া হয়, প্রায় সেই পরিমাণ মূল্যের বই আমরা তাকে সৌজন্য সংখ্যা বলে দিয়ে দিই। বিক্রির তেমন চেষ্টা করি না। তবে আপনার ক্ষেত্রে করবো। এটা আমার ওয়ার্ড

আমি মৌন ব্রতই পালন করলামকিছু বললাম না

ইরফান সাহেব!

জ্বী, বলেন

আপনাকে আমি আমার ব্যাপারটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি?

জ্বী, হয়েছেন

আপনার কিছু বলার আছে?

জ্বী না, নাই

ও আচ্ছা…তবু আপনাকে জানিয়ে রাখি, আপনি যদি হাজার খানেক কপি প্রকাশ করতে চান, তাহলে হাজার পঞ্চাশেক লাগবেপনি আপাতত অর্ধেক দিলেই চলবে” একটু থেমে আবার যোগ করলেন, ইরফান সাহেব, কিছু মনে করবেন না… আমি আসলে অপারগতবে আমি চাই আপনি বইটা প্রকাশ করেন। আপনার হবে

আচ্ছা, আমি তাহলে উঠি

আবার কবে আসছেন?

জানি না, স্যার

 

প্রকাশক সাহেব কে আর কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। সালাম দিয়ে চলে এলাম

আমার পক্ষে বই প্রকাশ করা সম্ভব নাতবু আমার মধ্যে হতাশা এলো না। কেমন জানি নিস্পৃহ ভাব চলে এলোসৃষ্টিকর্তা কাউকে অর্থ দেন, খরচের পথ দেন নাআর কাউকে খরচের পথ দেখালেও, খরচের জন্য অর্থ টা দেন না

সৃষ্টিকর্তা আসলে সর্বজ্ঞানী। তিনি জানেন, কার কি দরকারআমার যা দরকার ছিল তিনি দিয়েছেনযা দরকার নাই, তিনি তা দিবেন কেন!

 

 

ছয়.

আম্মার অসুখটা আজ আবার বেড়েছেদুপুরে শোয়া থেকে উঠতে বেশ কষ্ট হয়েছে

আব্বা সন্ধ্যায় আসার পর থেকে আম্মার পাশে বসে আছেনবোনটা কি এক গল্পের বই নিয়ে বসে আছেএকেক জন একেক কাজে ব্যস্তআমিই একা একা বসে আছিজানালার পাশেভাবছি আমার তো এখন ভাবারই সময়। আকাশে কি সুন্দর চাঁদ। পূর্ণ চন্দ্র না, অর্ধ চন্দ্রসাহিত্যে পূর্ণ চন্দ্র বা পূর্ণিমা-জোছনা নিয়ে অনেক গল্প, কবিতা আছেকিন্তু চাঁদের অর্ধাংশ নিয়ে তেমন কিছু আছে বলে মনে পড়ছে নাছোটবেলায় ‘অর্ধচন্দ্র দেয়া’ নামে একটা বাগধারা পড়েছিলাম, বাংলা ব্যাকরণেসেই বাগধারার সাথে নিজেরই কেমন যেন মিল খুঁজে পাচ্ছিমনে হচ্ছে, আমাকেও যেন অর্ধচন্দ্র দেয়া হচ্ছে!

 

জীবন-জীবিকার টানাপোড়েন আমি আর টানতে পারছি না। আমি অনেক ক্লান্ত, বিধ্বস্তভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আজযাকে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

ইদানীং দারিদ্রের মহানত্বকে অসহ্য লাগেএর চেয়ে সচ্ছলতার সাধারণত্ব ঢের ভালআমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, আমি মহান হতে চাই না। আমি খ্রীস্টের সম্মান চাই না। আমি সাধারণ হতে চাই। আমি সচ্ছলতা চাই

 

আজ সারাদিন রোদে পুড়ে পুড়ে হেঁটেছিঅনেক কষ্টে যোগাড় করেছি একটা চাকরি। সেলসম্যানের চাকরিমুদি দোকানে যাব আর গিয়ে বলব, ‘ভাই আপনাদের সাবান লাগবে? ওয়াশিং পাউডার? টুথপেষ্ট?… কেউ হয়তো মুখ ঝামটা দিবে। অপদস্থ করবে। কঠিন ব্যবহার করবে। তাতে কি! আমি এখন সব কিছু সহ্য করার জন্য তৈরী

 

আমার কোনো আত্নসম্মান বোধ নাইআত্নসম্মান বোধটাকে বিসর্জন দিয়েছি, লেখক সত্তাকে বিসর্জন দেয়ার সাথে সাথেইআজকের পর থেকে আমি আর লিখবো না আমার লেখক সত্তা মরে গেছে। তার মৃত্যু ঘটেছেস্লো পয়জনে নাকি শ্বাসরোধে, কিভাবে মৃত্যু ঘটেছে আমি জানি নাশুধু জানি, আমার লেখক আত্না সম্পূর্ণ মরে গেছে। আমি নিজে তার স্বাক্ষী

কারণ, আমি নিজ হাতে তার দাফন কাজ সম্পন্ন করেছি ।

___________

লেখকঃমোঃ ইয়াসির ইরফান

বই : শব্দবৃত্ত গল্প সংকলন

প্রকাশনী : বিদ্যানন্দ প্রকাশনী

সম্পাদনা : সালু আলমগীর

অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ফেব্রুয়ারী ২০১৬

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন