এক.
“হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান।”
চরণ দুটি একসময় খুব উদ্বেলিত করত। নিজেকে মহান ভাবতে, খ্রীস্টের সমান সম্মান প্রাপ্তিতে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করত। যেন কোথায় হারিয়ে যেতাম! আজকাল আর ভালো লাগে না। নিষ্ঠুর উপহাস মনে হয়।
নিদারুণ অর্থ কষ্টে ভুগছি ক’দিন যাবত। পকেটে একটা পয়াসাও নেই। অর্থাভাবে গতকাল প্রায় আট-দশ কিলোমিটার হেঁটেছি। একটানা হেঁটেছি সোয়া এক ঘন্টার মত। কিছু করার নেই। নিজের কোনো আয়-রোজগার নেই। পাঁচটা টাকার জন্যেও আম্মার কাছে হাত পাততে হয়। নিজেরই কেমন জানি সংকোচ লাগে! কত বন্ধুদের বললাম একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে। কেউ দেয় না।
সেদিন আসলাম তো বলল, “দোস্ত, তুই লেখক মানুষ। তুই চাকরি দিয়ে কি করবি। তোকে চাকরিতে মানায় না। লেখালেখি তে মানায়।”
হারামজাদার কানপট্টির ঠিক এক সেন্টিমিটার নীচে থাপ্পড় দেয়ার ইচ্ছাটা বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করলাম। একবার ভাবলাম বলি, “তোর মতো হাঁদারাম কে হাঁদারামিতে মানায়, জ্ঞান দেয়াতে মানায় না।” কিন্তু বললাম না। মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে এলাম।
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়নালকে খুব করে ধরেছিলাম, কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে। সে দুই-তিনটা টিউশনি করে। আবার কোচিং-টোচিংয়েও ভাল যোগাযোগ আছে। ক্লাস নেয়, খাতা কাটে। ছোটখাটো ব্যবসাপাতিও শুরু করেছে। রোজগার তাঁর ভালোই।
সে কিছুটা উদাস হয়ে আমার কাঁধে হাত রাখে। আর বলে, “শোন, তুই একটা প্রতিভা। বুঝলি, প্রতিভা। সৃষ্টিকর্তা এই লেখালেখির মহৎ গুণটা সবাইকে দেন না। স্রষ্টার আশীর্বাদ–পুষ্ট মানুষদেরকেই দেন। বুঝলি। তো এখন যদি আমি তোকে একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেই, তাহলে তোর মনোযোগ লেখালেখিতে থাকবে না। টাকার দিকে চলে যাবে। টিউশনি একটা করলে, দুইটা খুঁজবি। দুইটা পেলে চারটা। দোস্ত, আমরা তো করছি। আমরা জানি। এই টাকার নেশাটা বড় কঠিন নেশা। তোর টাকার দরকার লাগলে আমাকে বলিস। আমি সাধ্যমত তোকে সাহায্য করব। কিন্তু তোকে কিছু ঠিক করে দেব না। তুই রাগ করিস আর আমাকে গালি দিস, আমি তোকে কোনো ব্যবস্থা করে দেবো না।”
তখন ব্যাটার এই ফিলোসফি কপচানো শুনে বেশ রাগ হয়েছিল। আবার তাঁর এই কথাগুলা আমাকে বেশ প্রভাবিতও করেছিল। কিছুদিনের জন্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার অর্থকষ্টের ব্যাপার-স্যাপার।
বড় লেখকদের জীবনীও আমাকে বেশ প্রলুব্ধ করত। ভাবতাম, তাঁরাও তো কত কষ্ট সয়েছেন। এই লেখালেখির জন্য জেল-জুলুম ছাড়াও অভাব-অনাহার ছিল তাদের নিত্য সঙ্গী। কার্ল মার্কসের মৃত্যুর সময় তাঁকে ক’জন চিনত! অথচ মৃত্যুর পর তাঁর জগৎ জোড়া খ্যাতি হয়েছে। এমন বহু লেখক আছেন।
আমিও ভাবতাম আজ হয়তো কষ্টে দিনাতিপাত করছি। কিন্তু যা রেখে যাচ্ছি, হয়তো মৃত্যুর পর আলোড়ন তুলবে। লেখক-খ্যাতি বিশাল ব্যাপার। এই সম্মানের কোনো তুলনা হয় না। রাস্তা-ঘাটে কোনো বন্ধু বা পরিচিত কেউ যখন বলে উঠে, “কি খবর লেখক সাহেব? কেমন আছেন?”
বুকের ভেতরটা কি এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে উঠে। সব শূণ্যতা, না-পাওয়া কোথায় যেন উবে যায়। স্বর্গীয় প্রশান্তিতে আমার চোখমুখে অন্যরকম প্রফুল্লতা চলে আসে। আমার দেহের প্রতিটি কোণ-কোষ, লোম-কূপ পরম পূর্ণতায় ভরে উঠে। আমি নিজেকে লেখক ভাবতে তৃপ্ত বোধ করতে থাকি। এ এক অন্য রকম অনুভূতি…।
দুই.
লেখালেখি করে তো আর পেট ভরে না। কাপড়-চোপড়ও বানানো যায় না। এসবের জন্য টাকা লাগে। তাই লেখালেখি করলেও অর্থাভাব মাঝেমধ্যেই আমাকে পীড়া দেয়। আব্বা একসময় খুব বকাঝকা করতেন। পড়ালেখা মাঝ অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছি বলে। ঘরে বসে থেকেছি বলে। চাকরি বাকরি করছি না বলে। ঘরের কোনো দায়-দায়িত্ব নিচ্ছি না বলে। অভিযোগ কত…! অন্তহীন।
আজকাল আর বকা দেন না । ভুল করে হোক বা যেভাবে হোক আমার একটা লেখা একবার এক সাহিত্য সাময়িকী ছাপিয়েছিল। খুবই অখ্যাত আর অনিয়মিত একটা সাহিত্য সাময়িকী। সেটা আব্বাকে দেখিয়েছিলাম। সেই থেকে আব্বা আর কিছু বলেন না। ছাপার অক্ষরে নিজের ছেলের নাম দেখেছেন বলেই কি না কে জানে!
এই দূর্ঘটনার (!) পর থেকে আমাকে একদম কিচ্ছু বলেন না। কি জানি, আব্বাকেও ‘লেখকের বাবা’ হওয়ার মোহ পেয়ে বসেছে কি না! পেলে তো সর্বনাশ! এই মোহ বড় কঠিন মোহ। একবার যাকে পেয়েছে, তার আর নিস্তার নেই।
অনার্স চতুর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষা দিই নাই। লেখালেখি, সাহিত্য, লেখক, গল্প, কবিতা… এইসব এমনই মোহগ্রস্থ করে দিল যে, পড়ালেখা আর চালানো গেল না। সেই থেকে একদম বেকার। কিচ্ছু করি না, লেখা-জোখা ছাড়া।
তিন.
আব্বার চাকরিটা এই বছরই শেষ। বোনটারও বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে। আম্মারও ‘চোখের ছানি অপারেশন’ করানো খুব জরুরী। আব্বার রিটায়ারমেন্টের টাকা থেকে ব্যাংকের লোন কেটে রাখবে। তারপর আর কত থাকবে, কে জানে! বোনটার বিয়ে দিতে হলেও টাকা লাগবে। অপারেশনেও মোটা টাকা দরকার। এরপর চলতে গেলে তো কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু করব টা কি?
এসব চিন্তা হঠাৎ পেয়ে বসলে একদম অস্থির হয়ে যাই আমি।
আর থাকতে না পেরে এক বন্ধুকে অনুনয় করে বলেছিলাম, অন্তত একটা টিউশনি যেন ঠিক করে দেয়। সে দিয়েছিল। কিন্তু একমাস পূরণ হওয়ার আগেই টিউশনি টা চলে গেল। গৃহকর্তা চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান বদলি হয়েছেন। পরিবার সহ উনার সাথে নিয়ে গেলেন। সাথে আমার টিউশনিটাও। কপাল আর কাকে বলে!
টিউশনি টা চলে গেলেও সজিব কে কিছু বলি নাই। বারবার এভাবে ধরণা দিতে ভালো লাগে না। লেখক হওয়ার এই আরেক জ্বালা! আত্নসম্মান বোধ টা এত টনটনে হয়ে যায়… এক্কেবারে যখন-তখন টনটন করে বেজে উঠে।
তাই জয়নাল যেকোনো সময় সাহায্য নিতে বললেও কখনো নিই নাই। আমি জানি, জয়নাল এমনি এমনি কোনো কথা বলে না। আমি চাইলে সে নিজের রক্ত বেঁচে হলেও আমাকে সাহায্য করবে। সে আমাকে বড় ভালবাসে। লেখালেখির জন্য হয়তো শ্রদ্ধাবোধও আছে।
জয়নালের সাথেও দেখা হয়েছে প্রায় মাস-দুয়েক হলো।
সেবার তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। বললাম, “প্রতিভা-টতিভার কথা বলিস না। আমার ভালো লাগে না। আমি তো প্রতিভা পাতিল না, আমার পাতিল ভরা প্রতিভা নাই। আমি অতি সাধারণ মানুষ। বেঁচে থাকার জন্য আমার কিছু একটা অবলম্বন দরকার। একটা আয়ের উৎস দরকার। তুই কিছু একটা করে দে।”
সে কিছুক্ষণ কি জানি ভাবল। তারপর বলল, “দেখ, তুই আমাকে কি ভাবিস জানি না! তবে আমি সত্যি মন থেকে চাই, তুই লেখালেখিতেই ক্যারিয়ার কর…।”
বিরক্ত হয়ে তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম, “আবার, শুরু করেছিস!”
সে আরো কি চিন্তা করল। তারপর আচমকা বলে উঠল, “আচ্ছা, এক কাজ করা যায়। তোর পত্রিকার কারো সাথে কোনো লিংক আছে?”
“না তো!”
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল। “তাহলে তো হবে না। আমারও ঐ লাইনে কোন লিংক-টিংক নাই। থাকলে করে দিতাম।”
আমি আশ্চর্য্য হয়ে বলেছিলাম, “পত্রিকা দিয়ে কি হবে?”
“আরে, পত্রিকায় লিখলে কিছু সম্মানী পাওয়া যায়। নিয়মিত লিখতে থাকলে পরিচিতিও আসে। তবে তাতে ভালো যোগাযোগের প্রয়োজন হয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে রিলেশন লাগে। তোর তো সেটা নাই।”
আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। “আমার তো তাহলে হবে না।”
একটু পর জয়নালই বলেছিল, “তুই একটা কাজ কর। তোর যখন লেখার হাত ভালো। অন্যদিকে না-গিয়ে এই লেখালেখি দিয়েই কিছু আয় করা যায় কি না চেষ্টা কর। পত্রিকায়-টত্রিকায় লেখা দেয়। আর একটা বই বের করতে পারিস না কি দেখ। জানাশোনা প্রকাশনী আছে?”
আমি দুই পাশে মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিলাম, নাই।
সে বলেছিল, “ব্যাপার না। এখন বইমেলার সিজন না। প্রকাশনীগুলোতে হয়তো তেমন ব্যস্ততাও নাই। তুই একটা চেষ্টা করে দেখ। তবে নাম করা কোন প্রকাশনীতে না গিয়ে ছোটখাটো অখ্যাত কোন প্রকাশনীতে যাবি। বড় প্রকাশনীগুলো তোদের মত তরুণ লেখকদের সাথে কথা-ই হয়তো বলবে না। ছোটগুলোতে একটা চেষ্টা করে দেখ। আর পত্রিকার ব্যাপারটাও মাথায় রাখিস।”
আমি মোটামুটি বেশ আশ্বস্ত হয়েছিলাম। আশন্বিতও হয়েছিলাম খুব। তাঁর এই পরামর্শ আমার চমৎকার লেগেছিল।
চার.
কাজে না নামলে বোঝা যায় না কাজ কত কঠিন! জয়নালের কথামতো একটা প্রকাশনী খুঁজে বের করলাম। তুলনামূলক ভাবে অখ্যাত। প্রকাশনীর নামটা… উদয়ন… উড়ন… না উন্নয়ন… কি একটা জানি ছিল! ঠিক মনে নাই। শুধু মনে আছে প্রথমে রস্য’উ আর শেষে দন্ত্য’ন ছিল।
প্রকাশনীতে তেমন ভীড় চোখে পড়ে নাই। গিয়ে সোজা প্রকাশকের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, “হেঁটে এলেন বুঝি?”
আমার কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝরছিল। গায়ের টি-শার্ট টা শরীরের সাথে একদম লেপ্টে ছিল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলাম। তাই আমাকে দেখে বোঝা যাওয়ারই কথা, আমি হেঁটে এসেছি। তবু ভদ্রলোকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করল।
আমি ছোট্ট করে মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, জ্বী।
প্রকাশক সাহেব কাকে যেনো ঠান্ডা পানীয় আনার নির্দেশ দিলেন। আমাকে ইঙ্গিতে বসতে বললেন। আমি বসলাম।
পান্ডুলিপি উনার হাতে দিলাম। উনি নেড়েচেড়ে দেখলেন। “আপনারই লেখা বুঝি?”
“জ্বী।”
তিনি আরো একটু নাড়াচাড়া করলেন। এত কি দেখছেন, বুঝতে পারছি না। পড়ছেন বলেও মনে হচ্ছে না । শুধু এদিক সেদিক, এ-পাতা সে-পাতা কি জানি দেখছেন । ভাবটা এমন, যেন আমি উনাকে জাল নোট ধরিয়ে দিয়েছি, আর উনি তা চেক করছেন।
“আগে কোনো বই বের করেছেন?”
“জ্বী না, স্যার।”
“স্যার বলছেন কেন? আমি কারো স্যার না। স্যার বলবেন না।”
“আচ্ছা, বলব না জনাব।”
“জনাব! জনাবও বলার দরকার নাই।”
“তাহলে কি বলব?”
“কিচ্ছু বলার দরকার নাই। যদি সম্পর্ক আরো স্থায়িত্ব লাভ করে, তখন সম্বোধন একটা
ঠিক করে নেয়া যাবে। আপাতত কিছু না-ডাকলেই খুশী হবো।
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
আমার চেহারা ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। ডেকচির তলার মত। চেহারায় কোনো শিশুসুলভ সরলতা নাই। তবুও কেন জানি লোকেরা আমাকে খুব মায়া করে। আমি বুঝতে পারি। আমি চেষ্টা করছি প্রকাশক সাহেবের মনে, মায়া জন্ম দিতে। যেন কাজটাতে একটু সুবিধা লাভ করতে পারি। রোদে-ঘেমে ক্লান্ত চেহারা আমাকে সাহায্য করছে, লোকটার মনে মায়াভাব জন্ম দিতে।
মনে হয় কাজ করছে একটু একটু। কেন জানি প্রকাশক সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি কিছু কঠিন কথা বলতে চান। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে আবার চুপসে যাচ্ছেন। আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, উনি কি বলেন শোনার জন্য।
লেখালেখি কতদিন ধরে করেন ?
“ক্লাস সেভেন-এইট থেকে।”
“হুম। তাহলে আপনি লেখক?”
“ওই আর কি…! ঠিক সেভাবে লেখক বলা যায় না!”
“আচ্ছা। তা কোনো পত্রিকা-টত্রিকায় লেখা বের হয়েছে? সাময়িকীতে?”
“জ্বী না।”
“অহ। তা যারাই লেখেন, তাঁরাই তো লেখক। তাই না?”
“জ্বী।”
“ব্যাংকের এ্যাকাউন্টেন্ট সারাদিন লিখছেন, তিনিও তো লেখক। তারপর আপনার যারা হিসাবের ব্যাপার-স্যাপার দেখেন তাঁরাও তো লেখক। যিনি লিখছেন তিনিই লেখক। তাই না? নাকি নয়?”
“জ্বী, একদম তাই।”
“কিন্তু সেভাবে বলা হয় না। কেবলমাত্র যারা আপনার মতো লিখেন তাদের লেখক বলা হয়, অন্যদের বলা হয় না। এটা কেন জানেন?”
“জানি না। আপনিই বলেন।
“লক্ষ করেন, যারা লেখাটাকে নেশা হিসেবে নিচ্ছেন তাঁরা লেখক। আর যারা পেশা হিসেবে নিচ্ছেন তাঁরা নয়। বুঝতে পারছেন।”
“জ্বী।”
তিনি একটু বিরতি নিলেন। বাইরে কোথায় জানি গেলেন। আমি ঠান্ডা জুসটা এক ঢোকে শেষ করে ফেললাম।
পাঁচ.
প্রকাশক সাহেব এসেই বলে উঠলেন, “এবার আসেন বইয়ের কথায়। আপনাকে কয়জন চিনে?”
“সেভাবে তো কখনো গুণে দেখি নাই। তবে শ’খানেক হতে পারে। পাঁচশও হতে পারে।”
“আচ্ছা… বুঝলাম। তো এবার আপনার বই আমি প্রকাশ করলাম। কত কপি বিক্রির নিশ্চয়তা দিতে পারবেন?”
“একটারও পারবো না।”
“তবুও আপনি চেষ্টা করলে পঞ্চাশ-একশ হয়তো পারবেন।”
“জ্বী, হয়তো …।”
“কিন্তু আমি যে বইগুলো প্রকাশ করব… সে তো বিক্রির জন্য, নাকি? আচ্ছা, আপনি কি করেন?”
“কিছু না।”
“একদম কিচ্ছু না? স্টুডেন্ট?’
“জ্বী না।”
“চাকরি-বাকরি?”
“না, আমি একদম কিছুই করি না।”
“হুম, বুঝেছি। কিন্তু এটা আমার ব্যবসা। এই করেই আমি পেট চালায়। জীবিকা নির্বাহ করি। এটাই আমার আয়ের উৎস। বুঝতে পারছেন?”
“জ্বী, বুঝতে পারছি।”
“এখন আপনিই বলেন, জেনে শুনে আমার কি লস প্রজেক্টে হাত দেয়া উচিৎ?”
“জ্বী না, উচিৎ নয়।”
তিনি কিছুক্ষণের জন্য একদম চুপ মেরে গেলেন। তারপর আবার বলে উঠলেন, “দেখেন, ইরফান সাহেব, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আমার যদি ক্ষমতা থাকত আমি আপনাকে বিনা মূল্যে বই প্রকাশ করে দিতাম। কিন্তু আমি সেটা পারবো না। আপনাকে কি আমি বোঝাতে পারছি আমার কথা?”
“জ্বী, পারছেন।”
“তবে একটা বিষয়ে আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি, আপনার বই বিক্রির ব্যবস্থা আমি করবো। কারণ, আপনাকে আমার ভালো লেগেছে।”
আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বললাম না।
তিনিই বললেন, “অনেক সময় লেখকের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ নেয়া হয়, প্রায় সেই পরিমাণ মূল্যের বই আমরা তাকে সৌজন্য সংখ্যা বলে দিয়ে দিই। বিক্রির তেমন চেষ্টা করি না। তবে আপনার ক্ষেত্রে করবো। এটা আমার ওয়ার্ড।”
আমি মৌন ব্রতই পালন করলাম। কিছু বললাম না।
“ইরফান সাহেব!”
“জ্বী, বলেন।”
“আপনাকে আমি আমার ব্যাপারটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি?”
“জ্বী, হয়েছেন।”
“আপনার কিছু বলার আছে?”
“জ্বী না, নাই।”
“ও আচ্ছা…। তবু আপনাকে জানিয়ে রাখি, আপনি যদি হাজার খানেক কপি প্রকাশ করতে চান, তাহলে হাজার পঞ্চাশেক লাগবে। আপনি আপাতত অর্ধেক দিলেই চলবে।” একটু থেমে আবার যোগ করলেন, “ইরফান সাহেব, কিছু মনে করবেন না… আমি আসলে অপারগ। তবে আমি চাই আপনি বইটা প্রকাশ করেন। আপনার হবে।”
“আচ্ছা, আমি তাহলে উঠি।”
“আবার কবে আসছেন?”
“জানি না, স্যার।”
প্রকাশক সাহেব কে আর কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। সালাম দিয়ে চলে এলাম।
আমার পক্ষে বই প্রকাশ করা সম্ভব না। তবু আমার মধ্যে হতাশা এলো না। কেমন জানি নিস্পৃহ ভাব চলে এলো। সৃষ্টিকর্তা কাউকে অর্থ দেন, খরচের পথ দেন না। আর কাউকে খরচের পথ দেখালেও, খরচের জন্য অর্থ টা দেন না।
সৃষ্টিকর্তা আসলে সর্বজ্ঞানী। তিনি জানেন, কার কি দরকার। আমার যা দরকার ছিল তিনি দিয়েছেন। যা দরকার নাই, তিনি তা দিবেন কেন!
ছয়.
আম্মার অসুখটা আজ আবার বেড়েছে। দুপুরে শোয়া থেকে উঠতে বেশ কষ্ট হয়েছে।
আব্বা সন্ধ্যায় আসার পর থেকে আম্মার পাশে বসে আছেন। বোনটা কি এক গল্পের বই নিয়ে বসে আছে। একেক জন একেক কাজে ব্যস্ত। আমিই একা একা বসে আছি। জানালার পাশে। ভাবছি…। আমার তো এখন ভাবারই সময়। আকাশে কি সুন্দর চাঁদ। পূর্ণ চন্দ্র না, অর্ধ চন্দ্র। সাহিত্যে পূর্ণ চন্দ্র বা পূর্ণিমা-জোছনা নিয়ে অনেক গল্প, কবিতা আছে। কিন্তু চাঁদের অর্ধাংশ নিয়ে তেমন কিছু আছে বলে মনে পড়ছে না। ছোটবেলায় ‘অর্ধচন্দ্র দেয়া’ নামে একটা বাগধারা পড়েছিলাম, বাংলা ব্যাকরণে। সেই বাগধারার সাথে নিজেরই কেমন যেন মিল খুঁজে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, আমাকেও যেন অর্ধচন্দ্র দেয়া হচ্ছে!
জীবন-জীবিকার টানাপোড়েন আমি আর টানতে পারছি না। আমি অনেক ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আজ। যাকে বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
ইদানীং দারিদ্রের মহানত্বকে অসহ্য লাগে। এর চেয়ে সচ্ছলতার সাধারণত্ব ঢের ভাল। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, আমি মহান হতে চাই না। আমি খ্রীস্টের সম্মান চাই না। আমি সাধারণ হতে চাই। আমি সচ্ছলতা চাই।
আজ সারাদিন রোদে পুড়ে পুড়ে হেঁটেছি। অনেক কষ্টে যোগাড় করেছি একটা চাকরি। সেলসম্যানের চাকরি। মুদি দোকানে যাব আর গিয়ে বলব, ‘ভাই আপনাদের সাবান লাগবে? ওয়াশিং পাউডার? টুথপেষ্ট?…’ কেউ হয়তো মুখ ঝামটা দিবে। অপদস্থ করবে। কঠিন ব্যবহার করবে। তাতে কি! আমি এখন সব কিছু সহ্য করার জন্য তৈরী।
আমার কোনো আত্নসম্মান বোধ নাই। আত্নসম্মান বোধটাকে বিসর্জন দিয়েছি, লেখক সত্তাকে বিসর্জন দেয়ার সাথে সাথেই। আজকের পর থেকে আমি আর লিখবো না। আমার লেখক সত্তা মরে গেছে। তার মৃত্যু ঘটেছে। স্লো পয়জনে নাকি শ্বাসরোধে, কিভাবে মৃত্যু ঘটেছে আমি জানি না। শুধু জানি, আমার লেখক আত্না সম্পূর্ণ মরে গেছে। আমি নিজে তার স্বাক্ষী।
কারণ, আমি নিজ হাতে তার দাফন কাজ সম্পন্ন করেছি ।
___________
লেখকঃমোঃ ইয়াসির ইরফান
বই : শব্দবৃত্ত গল্প সংকলন
প্রকাশনী : বিদ্যানন্দ প্রকাশনী
সম্পাদনা : সালু আলমগীর
অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ফেব্রুয়ারী ২০১৬