বাংলার এক বীরযোদ্ধার গল্প- মীর জুমলা

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

আমরা আমাদের অতীত কতটুকু জানি? বাংলায় মুসলমানদের আগমণ ঘটেছিল অনেক আগে। ৭১২ খ্রিস্টাব্দ। ভারতের  সিন্ধু প্রদেশে সর্বপ্রথম মুহাম্মদ বিন কাসিম আগমণ করেন বিজয়ীর বেশে। এটা ছিলো বাংলায় ইসলামের বিরাট রাজনৈতিক বিজয়। এ বিজয় সিন্ধু প্রদেশ পর্যন্ত থেমে থাকেনি বরঞ্চ তা বিস্তার লাভ করে পাঞ্জাবের মুলতান পর্যন্ত। ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির অলৌকিক ভাবে বাংলা বিজয়ের ফলে বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয় ঘটে। কিন্তু এসবের অনেক পূর্বেই এদেশে ইসলামের বীজ বপন করা হয়েছিল।  সেটা হিজরি ১ম সাল থেকেই শুরু। এই বিষয় টা বাংলায় মুসলমান দের আগমনের ইতিহাসে আলোচনা করব। আজকে আসুন জানি বাংলার সুবেদার দের মধ্যে একজন সম্পর্কে ।

বিভিন্ন সময়ে বাংলার সুবেদার ছিলেন বিভিন্ন জন । বাংলার সুবাদার দের মধ্যে অন্যতম মীর জুমলা(১৫৯১-১৬৬৩)। তৎকালীন ঢাকায় পৌঁছার অল্পদিন পরই মীরজুমলা বাংলার সুবাহদার হিসেবে তাঁর নিয়োগের ফরমান লাভ করেন ১৬৬০ খিস্টাব্দে।  সে সময়কার পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় বাংলার নাম করা সুবাদার ছিলেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি ছিলেন মীর জুমলা। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন কারন  তিনি নিজে ব্যবসায়ী ছিলেন। মীর জুমলার আমলে পর্তুগীজদের অর্থনৈতিক অবনতি ঘটে। তবে ইংরেজ ও ওলন্দাজ কোম্পানিগুলোর উত্থান ঘটে । কেরানি হিসাবে তিনি জীবন শুরু করেছিলেন ,হয়ে উঠেছিলেন  সপ্তদশ শতাব্দীর একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীতে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সেনানায়ক এবং মোগল সাম্রাজ্যের একজন যোগ্য গভর্নর হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

ঢাকা ও শহরতলি এলাকায় দ্রুত উন্নতির জন্যে তিনি দুটি রাস্তা ও সেতু নির্মাণ করেন। এর ফলে সৈন্য চলাচল দ্রুত করা সম্ভব হয় , যন্ত্র স্থানান্তর সহজ হয়। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনে  মীর জুমলা কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন। এর মধ্যে একটি ছিল ছিল টঙ্গী জামালপুরে, যা তৎকালীন ঢাকাকে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করে ( বর্তমানে: ময়মনসিংহ রোড) সড়কটির নিরাপত্তা বিধান করত। দুটি দুর্গ অবস্থিত ছিল খিজিরপুর এ। ফতুল্লা থেকে অদূরে পাগলা সেতুটি এই  রাস্তায় অবস্থিত। তাঁর নির্মিত সড়ক ও দুর্গগুলির কিছু অংশ এখনও টিকে আছে। বুড়িগঙ্গার তীরে মীর জুমলার স্থাপন করা ২টি কামানের কথা উল্লেখ  পাওয়া যায় ড. মুনতাসীর মামুন এর ‘ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামানের খোঁজে’ গ্রন্থতে

মীর জুমলার বড় সাফল্য গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কামরূপ ও আসাম রাজ্য দখল করা। মীর জুমলা একটি বিরাট সৈন্য বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন তিনি কামরূপ রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁর মূল সৈন্য বাহিনী ও নৌবহর পাঠান । কোচবিহারের বিরুদ্ধে তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে অগ্রসর হন। রাজা প্রাণ নারায়ণ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান মীর জুমলার অগ্রযাত্রার কারণে।  দেড় মাসের মধ্যে কোচবিহার দখল করলেন মীর জুমলা। এর পর মীর জুমলা কামরুপ অভিমুখী মূল বাহি্নীর সাথে যোগ দেন। আসামের  রাজা কামরুপ ত্যাগ করলেও তিনি আসাম দখলের সিদ্ধান্ত নেন।

মীর জুমলা সিমালুগড় অবরোধ করেন  ১৬৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। মারাত্মক হাতাহাতি লড়াইয়ের পর অহমীয়রা দুর্গ পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায় ।মীর জুমলা ১৬৬২ সালের ১৭ মার্চ বীরদর্পে  অহমের রাজধানী গড়গাঁয়ে প্রবেশ করেন  এ বিস্ময়কর বিজয় লাভের পর । তিনি শুধুমাত্র আসামের রাজধানী গড়গা  দখল করেছিলেন।তিনি সে দেশের রাজাকে বন্দী করতে পারেন নি বা গোটা রাজ্য দখলে আনতে পারেন নি । মীর জুমলা গড়গাঁ পর্যন্ত গিয়ে তাঁর যাত্রা রহিত করেন। বর্ষাকালে মোগল রা কয়েকটি উচু ভূমিতে আটকা পড়ে । আর এই সুযোগে অহমীয়রা মোগলদের নৈশ প্রহরে হয়রানি করত। অহমীয়রা পূর্বদিকে তাদের হারানো ভূখণ্ড বিনা কষ্টে, অনায়াসে  পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। মোগলদের অধিকারে ছিল কেবলমাত্র গড়গাঁও এবং মথুরাপুর।

পাগলা সেতু (১৮১৭), সেতুটি মীর জুমলা ১৬৬০ সালে নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়।

মোগলরা মথুরাপুর শিবির পরিত্যাগ করে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি না থাকাযর কারনে । বন্ধ হয়ে যায় রসদের সরবরাহ । খাদ্যের তীব্র ঘাটতি দেখা দেয় শিবিরে। সৈন্যরা ঘোড়া জবাই করে  মানুষের জীবন বাঁচাতে। অনেক দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে মোগলরা পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে । মীর জুমলা সক্ষম হয়েছিলন লাখনৌ ও ঢাকায় মোতায়েন রাজকীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে । মথুরাপুরে মোগল শিবিরে মহামারী দেখা দেয় খাদ্য ঘাটতির পাশাপাশি। মহামারির কারনে  মীর জুমলা তার দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্য হারান।মোগল সৈন্যবাহিনী তাদের আক্রমণাত্মক অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয় একমাত্র মীর জুমলার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে।

অবশেষে বৃষ্টির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসে । পানি নেমে যায়। যোগাযোগ সহজতর হয়ে যায়। মীর জুমলার সৈন্যদের পুনরায় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় লখনৌতে মোগল নৌবহরের সঙ্গে। ইতি ঘটে মোগল শিবিরে দুর্দশার। দেবালগাঁয়ে মোতায়েন নৌবহরের সঙ্গে মিলিত হয় মীর জুমলার সৈন্যরা । আবার পাহাড়ে পালিয়ে যান রাজা জয়দববাজ সিং। সৈন্যরা অগ্রযাত্রা করতে অস্বীকৃতি জানায় , ডিসেম্বরে মীর জুমলা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে। এরই মধ্যে আসামের রাজা অস্থির হয়ে পড়েন পুনরায় শান্তি চুক্তি করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ১৬৬৩ সালের জানুয়ারিতে ঘিলাজহরিঘাটে একটি চুক্তি হয়।

মীর জুমলা সৈন্য প্রত্যাহার করার সঙ্গে সঙ্গে দখলীকৃত অহমীয় ভূখণ্ড মোগলদের হাতছাড়া হয়ে যায় চুক্তির শর্ত অনুকূলে হওয়ার পরেও। মোগলদের সঙ্গে অহমীয়দের বিরোধ বাধে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ নিয়ে। ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ করেন রাজা জয়দববাজ । অহমীয়রা ক্ষতিপূরণ স্থগিত করে দেয়  মীর জুমলা আসাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা মাত্র । নীতিগতভাবে  যে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিপক্ষে ছিলেন জয়দববাজের উত্তরসূরি চক্রধাবাজ সিং ।

মীর জুমলা যখন আসাম থেকে ফিরে আসছিলেন সে সময় ১৬৬৩ সালের ৩০ মার্চ খিজিরপুরের অদূরে নৌকায় থাকা অবস্থায় তিনি  মারা যান।তাকে কবর দেয়া হয় ভারতের মেঘালয় রাজ্যে । এটি অবস্থিত গারো পাহাড়ের কাছে একটি উঁচু টিলায় । দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর কবর সংরক্ষণ করা হয়।

তাঁর শাসন কাল (১৬৬০ – ১৬৬৩) । ১৭ শতকে ভারতের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের অন্যতম  মীরজুমলা ছিলেন নিজের চেষ্টায় সামান্য অবস্থা থেকে অতি উচ্চপদে আসীন হওয়া একজন । তিনি ছিলেন নম্র,ভদ্র,কিন্তু নিজের দায়িত্বের  প্রতি সচেতন । জীবন শুরু করেছিলেন একজন সামান্য কেরানী হিসেবে। সেই তিনি নিজ গুনে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও সুবাহদার হয়েছিলেন। একজন দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালক এবং দূরদর্শী ব্যক্তি  ছিলেন মীর জুমলা । তাঁর ন্যায়পরায়নতা ও দক্ষ নেতৃত্বের জন্যে তিনি বাংলার চির স্মরণীয় ।

 

রেফারেন্স: bn.wikipedia.org

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন