রুহুল আমিন : জালের সর্দার থেকে রিকশাওয়ালায় রুপান্তর

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

৩/৫/২০১৮

হাউজ বিল্ডিং এ দাড়িয়ে রিকশা খুজছিলাম। শেষ পর্যন্ত একটা পেয়ে গেলাম। রিকশাওয়ালা টান দিল।  মনে মনে চিন্তা করছিলাম তাদের জীবন সম্পর্কে, আবার হুট করে কিছু জিজ্ঞেস করাও যায়না । বিভিন্ন কথা বলছিলাম তাঁর সাথে। একপর্যায়ে তাঁকে একটা ফলের দোকানে দাড়  করিয়ে কিছু ফলমূল কিনতে নামি। সাথে করে আমার বড় ব্যাগ টা নামিয়ে নি। শুনেছি রিকশাওয়ালারা নাকি ব্যাগ নিয়ে টান দেয় । এটা এখানে বলার একটা কারন আছে যেটা পরে বোঝা যাবে। হঠাৎ  কি জানি মনে এল। একটা পেয়াড়া আলাদা কিনে , দুই ভাগ করে নিলাম। তারপর রিকশায় উঠে তাঁকে এক ভাগ দিয়ে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম রিকশায়। তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলাম”মামা আপনার নাম কি?”  তিনি বললেন তাঁর নাম রুহুল আমিন।তাঁর বাড়ি কই জিজ্ঞেস করলাম, বলল ময়মনসিংহের শেরপুর। এ কথা সে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

আচ্ছা, আমার  আর রুহুল আমিনের মাঝের কথোপকথন আমি হুবুহু তুলে ধরলাম……

“আপনার বাড়ি কই?”

“ময়মনসিংহ ,শেরপুর জেলা”

“এখানে কয়দিন হইসে আপনার?”

“হইসে অনেকদিন”

“অনেকদিন বলতে, কত দিন?  চার পাঁচ বছর হবে?”

“আরো বেশি”

 

“দশ বছর?”

“আরো বেশি”

 

“এর থেকে বেশি ,আচ্ছা তাইলে ,আপনি বলেন কতদিন হইসে, ঢাকায় আসছেন”

“মামা, বিশ বচ্ছর হইল ঢাকায় আইলাম”

 

“এখানে থাকেন কই? ফ্যামেলি আছে নাকি?”

“আছে ,থাকি আশুলিয়ায়”

 

“ছেলে মেয়ে আছে?”

“তিন্ডা মেয়ে একডা ছেলে, ছেলে ছোড”

 

“মেয়ের বিয়ে দিছেন?”

“নাহ, দুই মাইয়া চাকরি করে, একডা ছোড, আর পোলার বয়স ধরেন এক বছর”

 

“ও আচ্ছা,  তা এই রিকশা চালায়ে আপনার সংসার চলে?”

“আল্লায় চালায় মামা”

 

“বাড়িতে কি যান নাকি ঈদে কোরবানে?”

“আমি যাই, মাঝে মাঝে ,ফুল ফ্যামিলি যায় ঈদে চান্দে”

 

“তো বিশ বছর কি এই এলাকায় আপনি?

“হ”

“অন্য কোন দিকে যান নাই?”

“নাহ, এই উত্তরা এলাকাই ছিলাম এদ্দিন”

 

“অন্য কোন দিকে যান নাই বুঝলাম, অন্য কোন কিছু করেন নাই রিকশা ছাড়া ?”

“করসিতো, করসিনা আবার, অন্য কিছুই কইরাই তো এত দিন এই জায়গায় আছি ভাই”

 

“রিকশা কি নিজের? নাকি ভাড়া? অন্য চাকরি করছেন আগে?”

“চাকরি না ব্যবসা করতাম”

 

“কিসের?”

“মাছের, মাছ ধরতাম,দুইটা জাল আছিল, জালের সর্দার আছিলাম আমি”

 

“কোথায় ধরতেন?”

“দক্ষিন খানে”

 

“এখন ওই ব্যবসা আছে?”

“না”

 

“তো ওই ব্যবসা বাদ দিসেন কেনো?”

“রাজনৈতিক ব্যাপার বুঝেন না!বিলে মাছ ধরতাম, যে পারে জোর কইরা খায়”

 

“তো এখন কি ধরতে দেয় না?”

“আরে আমি কি মাছ ধরুম, যাগো জায়গা সম্পদ তারাই মামলায় জায়গাডা হারাইসে”

 

“আচ্ছা তো এই কারনে ছেড়ে দিসেন, ঐ টাতে কি রিক্সার চাইতে বেশি আয় হত?”

“হ , খরচ বিরোজ বাদ দিয়া ষাইট হাজার থাকতো মাসে”

 

“ তো এই কাজ অন্য জায়গায় করেন নাই কেনো?, মাছ ধরার জায়গা তো আরো আছে”

“চিন পরিচয়ের একটা ব্যাপার আছে মামা, এলাকায় পরিচিত হইতে না পারলে ব্যাবসা নাই, এর পরিচয় হুট কইরা হয়না”

 

“আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম, আপনি কি নিজে বেচতেন মাছ ?”

“নাহ, আমার লগে লগে পাইকার থাকতো,তারাই মনে করেন যে সবডি কিনা লইত”

 

“বর ফ্যামিলি চালাইতে কষ্ট হয়না, এই আয় দিয়ে ?”

“আল্লায় চালায় মামা। আমি কে চালাবার”

“হুম, ভালো বলসেন, রিকশা চালান  কয় বছর?দশ বছর?”

“নাহ”

“পনেরো বছর?”

“নাহ”

 

“কিরে মামা আমার অনুমান আজকে লাগেনা কেন জায়য়গা মত, আর  জিজ্ঞাস করবোনা, তাইলে আপনি বলেন, কয় বছর ধর রিকশা চালান?”

“দুই বছর”

 

“তো এত বছর কি মাছের ব্যাবসা করসিলেন”

“হ”

 

“তো এই কাজ কষ্ট বেশি না?”

“একশ গুন বেশি কষ্ট,  সাধে তো ছাড়ি নাই, রাগে, ক্ষোবে ,জিদে ছাড়সি”

 

“কষ্ট তো বুঝলাম, জিদ কিসেরর?”

“একদল কয় মাছ ধর , আরেক দল বাইন্ধা লইয়া যায়, কয়, মাছ ধরিস না,  আর কত সয্য করি কন! যা ! মাছি ধরুম না আর , তোগো মাছ তোরা খা এবা্র,  জিনিশ পত্র থুইয়া মনে করেন যে চলে আসছি, যাহ আমার আরো কাজ করার আছে, তোগো পুকুর ছাড়া কি চলবনা নাকি, হ্যা?”

 “হুম বুঝলাম, ভাড়া কত দিতাম?, এসে পড়লাম মামা”

“৭০”

 

“ধরেন ত্রিশ টাকা ফেরত দেন, আচ্ছা , ২০ আচ্ছা থাক ১০ দেন”

“ধরেন”

 

“আচ্ছা শুনেন ,আমি তো কিছুটা লেখালেখি করি, আপনাকে নিয়ে, আপনার জীবন, নিয়ে লিখলে সমস্যা আছে?”

“কি আর সমস্যা, লিখবেন?লিখেন!”

 

“আমার জীবন লিখে ,কার  কি লাভ?”

“আপনার জীবন সম্পর্কে সবাই জানবে, কেও কিছু শিখবে , কেও আপনাকে নতুন করে চিনবে, সবার জীবন সম্পর্কে সবাই জেনে যদি কিছুটা উপকার হয় তাই অনেকের জীবনী লিখে রাখি, যারা অনুমতি দেয় আরকি”

 

“অ সে কথা , তাইলে লিখেন!”

“আচ্ছা”

 

“আর হ্যা ,আপনার এক  টা ছবি তুলতে পারি, অনুমতি দিলে তুলব ,  নাইলে তুলবোনা”

“ছবি দিয়া আবার কি করবেন, বিপদে পরুম না তো ?”

 

“ না বিপদ নাই, লিখার সাথে ছবি যাবে শুধু, আর আপনি যা বলছেন এর বেশি লিখব না”

“অ, তাইলে তুলেন!, আমি যা বলসি তাই লিখলে আমার বিপদের কিছু নাই, আর মালিক তো আল্লাহ”

 

অতঃপর তিনি বিদায় নিলেন। রুহুল আমিন মামা কে বলেছিলাম, তিনি যা বলেছেন এর বাইরে লিখবনা, তবে নিয়ম ভেঙে কিছু  কথা লিখে ফেললাম।, আমরা অনেক সময় রিকশাওালাদের সহজে বিশ্বাস করতে পারিনা, অনেকেই হয়ত করে(যেমন আমি অবিশ্বাস করেছিলাম, আমার ব্যাগের ক্ষে্ত্রে ) কিন্তু তাঁরা সহজেই আমাদের কথা বিশ্বাস করে। আমরা হাজার টাকা নিমিশে নিজেরে সুখের জন্যে উড়াই, কিন্তু রুহুল আমিনদের হয়ত ভাড়া দিতে গিয়ে হাত কাপে, এই বুঝি ১০ টাকা মনে করে ৫০ চলে গেল। অনেক সময় তাঁদের কে আমরা ন্যায্য ভাড়া দিতে রাজি হইনা, বা ১০ টাকা বেশি চাইলে ঝাড়ি মারি, কিন্তু ঠিক ই ১০০ টাকা বন্ধুর জন্যে কোন কারন ছাড়াই খরচ করি।  সমস্যা নাই রুহুল আমিন দের, তারা হয়ত তখন জিদের বশে প্যাডেল টায় জোরে চাপ মেরে এগিয়ে যায়, আর মনে মনে বলে , “ আপনার ১০ টাকার জন্য কি আমার জীবন যাবে, আপনার ১০ টাকা আপনি খান, আমার আল্লাহ আসে, আল্লায় খাওয়াইবো”

 

সেই মুহুর্তে আমরা হয়ত ১০০০ টাকার একটা গিফট  প্রিয় জন কে দেই।প্রিয় জন তবুও হাসেনা। তাঁর আরও চাই, আর ১০ টাকা দিয়ে যে রুহুল আমিনদের  অন্তর ভুলানো হাসি আর দোয়া পেতাম সেটা একটুর জন্যে মিস হয়ে গেলো। ইশ।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন