শিহাব মামাকে আমি চিনতাম একজন কাঁচামাল ব্যবসায়ী হিসেবে। বড়খাতায় আমাদের দোকানের পাশে কাঁচামাল বাজার।সেই বাজারে প্রত্যেক হাটের দিন আমি তাকে খুঁজে পেতাম। সবাই মামাকে লাজু নামেই চিনতো।আমি দেখতাম সে সন্ধ্যায় আলু, পটল, শাক এসব বিক্রি করতো, তার মূলধন ছিলো সীমিত। আমার লেখায় পাঠকেরা এখনো কিছু খুঁজে পাননি। আমিও খুঁজে পাইনি সে সময়ের অন্যরকম এক শিহাব মামাকে! সে বাজারে ছোট ছোট তরিতরকারি বিক্রি করে তার পড়াশুনার খরচ চালায়! যদিও মামা আমার ক্লাশের দিক দিয়ে ছোট ছিলো তাই স্কুলে অতটা পরিচিত ছিলো না।কিন্তু এক সময় তার জীবনের কাহিনী শোনার ভাগ্য হয় আমার। জীবন কাহিনী যে এত করুণ আর দুঃখ কষ্টে ভরা হতে পারে তা পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন…………..
শিহাবের জন্মের দুই বছর পর তার মা মারা যায়। সে সময় তার বাবাকে ছেড়ে সে তার নানীর কাছে বড় হতে থাকে। তার বাবা আরেকটি বিয়েও করেন। তাই শিহাবের প্রতি কারো আগ্রহ ছিলো না। কয়েক বছর পর নানীর বাড়িতেও ছোট ছেলে শিহাবের ঠাঁই হলো না। চলে গেলো বাবার সাথে চট্টগ্রাম বাবার সাথে কাজ করতে। সেখানে ক্লাস টু পড়ার পর ভাগ্য তাকে নিয়ে এলো বড়খাতায়। বড়খাতায় বাবার সাথে ফিরে এসে শিহাব আবার সৎ মায়ের সংসারে পড়ে গেলো। যার সৎ মা আছে সেই জানে তার কি জ্বালা (সবাই একরকম হয় না)। শিহাব খুব কষ্টে লেখাপড়া করতে লাগলো। তার দিকে খাওয়াটুকু দেওয়া ছাড়া কেউ ফিরেও তাকায় না। যখন সে ক্লাস ফোরে, তখন বাজারে মানুষ সবজি নিয়ে আসে তাতে একটু সাহায্য করায় তাকে যা দেয় তা দিয়েই খাতা কলম কিনে পড়াশোনা চালায়। এভাবে চলতে থাকার পর পয়সা জমিয়ে সে গ্রাম থেকে আসা সবজি কিনে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করে।
কিন্তু এভাবে আর কত! তাই ফাইভে উঠে তার খালার বাড়িতে গিয়ে উঠলো।ফাইভে রোল এক হওয়ার পরেও একটা বাচ্চা ছেলে চাপ সহ্য করতে না পেরে এক সময় ভাবলো আর পড়াশোনা করবে না। তাই ফাইভ পাশ করেই চলে গেলো ট্রাকের হেলপারি করতে। প্রায় আট মাস পর শিহাব বাড়িতে এলো। একদিন বড়খাতা হাইস্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো সে ছিলো এক রোলের ছাত্র, আর আজ ভাগ্যগুণে সে ট্রাকের হেলপার! গেটে দাঁড়িয়ে তার পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছা আবারো জেগে উঠলো। স্কুলের স্যারদের কাছে গিয়ে তার ইচ্ছার কথা জানালো, কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি হলো না। কেননা ততদিনে বার্ষিক পরিক্ষা চলে এসেছে। পরে অনেক জোরাজুরির পর কয়েকজন স্যারের সহযোগিতায় সে আবার স্কুলে ভর্তি হলো।আবার শুরু হলো সবজিবিক্রেতা শিহাবের জীবন সংগ্রাম। শিহাবের বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তার কোন ছেলেমেয়েই শিক্ষিত হতে পারেনি।এবং শিহাবের সাথেও তেমন যোগাযোগ নেই। তিনি আরো দুটি বিয়ে করে সংসারি হয়েছেন।
এদিকে তার আরেক ভাই নুরনবী শিহাবের লেখাপড়ার প্রতি এত আগ্রহ দেখে তাকে কষ্ট সত্ত্বেও খরচের জন্য ১০০০ টাকা করে প্রতি মাসে দিতে শুরু করে। এবংতিনি এই টাকা প্রায় ক্লাশ টেন পর্যন্ত দিয়েছিলেন।শিহাব সপ্ন দেখতে শুরু করে সে একদিন প্রথম সারির কর্মকর্তা হবে। অথচ সে সকাল হলে খাতা কলম ছাড়া খালি পেটে কিভাবে স্কুলে যাবে তাও জানতো না। এর মাঝে সে জেএসসি পরীক্ষায় ৪.৭১ পয়েন্ট পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। শিহাব ক্লাশ নাইনে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়া শুরু করলো। দিনে স্কুল করে আর বিকেল হলেই পুটলি নিয়ে বাজারে সবজি বিক্রি করে। তা থেকে যা পায় তাতে লেখাপড়া ও খালাকে কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট রাখে। আমি তাকে দেখেছি মাঝে মাঝে অন্যের বাড়িতেও ঘুমাতে, সকাল হলেই চলে যেতো। সেই স্কুল থেকে ঝরে পড়া সবজি বিক্রেতা ছেলেটি বড়খাতা হাইস্কুল থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস ( জিপিএ ফাইভ) পেয়ে বসলো !
অদম্য মেধাবী শিহাব কে নিয়ে সারা এলাকায় হইচই পড়ে গেলো। অথচ সে কোনদিন প্রাইভেট পড়েনি,কোচিং করেনি!তার সেই ক্ষমতাটা ছিলনা যে! শুধুমাত্র স্কুল আর নিজের মেধায় যে সাইন্সের মত বিভাগে গোল্ডেন পাওয়া সম্ভব তা মানতে কষ্টই হয়। তাকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ ছাপানো হলো, বিশেষ করে এলাকারই পরিচিত খ্যাতনামা সাংবাদিক রবিউল হাসান তাকে নিয়ে শিরোনাম করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেন। ফলে সবজি বিক্রেতা শিহাব নতুন জীবন গঠনের পথে এগিয়ে গেলো। এরই ধারাবাহিকতায় সবার সহযোগিতায় সে রংপুর বিভাগের খ্যাতনামা কারমাইকেল কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে। এরপর সে যখন আর পড়াশোনা করবে কিভাবে তা ভেবে কূল পাচ্ছিলো না, ঠিক তখনি তার পাশে এসে দাড়ালো লালমনিরহাট জেলার একটি আলোকিত সংগঠন “আলোকিত বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন“। এই সংগঠনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন ইফতেখার হোসেন মাসুদ। তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে শিহাবের কথা জানতে পেরে শিহাবকে এই সংগঠনের সদস্য করে নেন। মেধাবী শিহাবকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে তুরস্কের স্কলারশিপ পেতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন সম্মানিত ইফতেখার হোসেন মাসুদ।ফলে শিহাব তুরস্কের গেবজে টেকনিকাল ইউনিভারসিটি তে ” কম্পিউটার সাইন্স ও প্রকৌশলী” বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে গেলো। আর সেই সাথে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলো শিহাব নামের একটি উজ্জ্বল মেধাবী নক্ষত্র।
পরিশেষঃ শিহাব আহমেদ লাজু এখন নিজেকে নিয়ে অনেক সপ্ন দেখে। সে চায় তার দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করতে। সবার সহযোগীতায় সে এগিয়ে এসেছে, সেও সবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন।
লেখকঃ সাঈদ আল রবি
রচনাকালঃ ২৫ শে জুলাই ২০১৮ খ্রিঃ
It was a good work vai
!!!!!