মকবুলের অব্যক্ত জীবন কথা –
কিছু কিছু জীবনের গল্প আছে যা সময়ের ব্যবধানে থেকে যায় লোকচোক্ষুর অন্তরালে। সময় জীবন এর গভীর থেকে গভীরতর দাগগুলো ধূয়ে মুছে দিলেও কিছু দাগ সময়ের স্রোত উপেক্ষা করে টিকে থাকে।
সিলেটে জন্ম হওয়া মকবুল দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বাস করছেন চট্টগ্রামে। সুরমা নদীর তীরবর্তী শহরে বেড়ে উঠেছেন মকবুল। দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত সিলেট শহরে কাটে মকবুলের শৈশব, কৈশোর। মকবুল পড়ালেখাও করেছেন সিলেটে । তাকে যখন প্রথম দেখি তখন তিনি ঝালমুড়ি বিক্রেতা।পরবর্তিতে তাঁর সাথে অনেকবার দেখা হয়। দেখা হয়ার আরেকটি কারন হয়ত তাঁর সাথে একি এলাকায় থাকা হত।
কিছুদিন আগে পতেঙ্গার সমূদ্র সৈকতে গিয়ে আবার দেখা হয় মকবুলের সাথে।এবার তিনি বাদাম বিক্রেতা। এতদিন তাঁর সাথে পরিচয়, জানতাম তিনি সিলেট থেকে এসে বিগত ১০ বছর ধরে চট্টগ্রামে থাকছেন। কিন্তু এ ব্যপারটা কখনই মনে দাগ কাটেনি। যখন তাকে ঝালমুড়ি ছেড়ে বাদাম বিক্রি করতে দেখলাম, ব্যপারটা আমার মনে প্রশ্ন তৈরি করল। দাগ কাওটলো। ছোটখাট ব্যপারে আসলেই আমার বা আমাদের উৎসাহের অন্ত নেই। তাকে জিজ্ঞেস করলাম ঝালমুড়ি বিক্রেতা থেকে তিনি এখন বাদাম বিক্রেতা কেন? উত্তর শুনে বুঝলাম ব্যপারটা অনেকটা চাকরি বদলানোর মতই। এখানে ভালো না লাগলে অন্যত্র স্থানান্তর।
তবে ঝাল্মুড়ি আর বাদাম বিক্রি করতে করতে আমাদের গল্প অন্যদিকে মোড় নিল। ধীরে ধীরে মকবুলের ভিন্নতর জীবনের গল্প আমার সামনে উন্মোচিত হল। সুরমা নদীর তীড়েই মকবুলের বাসস্থান। সংসারে বাবা, মা, সাত বোন আর দুই ভাই আছে। সবার বড় মকবুল। সিলেটে তাদের পরিবারের বনেদী খেতাব আছে। বাবা শরিফুল ইসলামের অনেক স্বপ্ন ছিল সন্তানদের নিয়ে। সবাই কিছু না কিছু করছে। দুই ছেলে ডাক্তার। ওদিকে বড় ছেলে মকবুল শিক্ষাগত অযোগ্যতার কারনে মেট্রিক পর্যন্ত পাশ করতে পারেন নি। পরিবারের চোখে,সমাজের চোখে মকবুল পরিবারের অপচ্ছায়া হয়ে পড়ে। পরিবারের মধ্যে থেকেও মকবুল হয়ে পরে একা।
বাবা-মা তাদের বাকি সাত মেয়ে ও দুই ছেলেকে এতটাই পছন্দ করত যে তাদের মধ্যেই সম্পত্তির সম্পূর্ন বাটোয়ারা করে দিলেন। কালের স্রোতে এমন অনেক কিছুই ঘটে যা আমাদের কাছে কাম্য নয়। শরিফুল ইসলাম সাত মেয়ে ও দুই ছেলে কর্তৃক নির্বাসিত হলেন সস্ত্রীক। সাথে ছিল একমাত্র- বড় সন্তান মকবুল। মকবুল তখনো বেকার। বনেদী পরিবারের সম্মান ধূলোয় লুটাবে বলে কেউ তাকে চাকরী করতে তাড়া দেয়নি, বরঞ্চ তাকে ছোটখাট চাকরী করতে নিষেধ করেছিল। যদিও এই বেকারত্বের কারনে হাজার কথা সহ্য করতে হত মকবুলকে। এই মকবুলের সাথে নতুন জীবনে, ভাগ্যের সন্ধানে পথে নামলেন শরিফুল ইসলাম্। সিলেটে যদি নিম্ন শ্রেনীর কাজ করে তবে বাবা-মার সম্মানহানী হবে, এই ভেবে মকবুল বাবা-মাকে নিয়ে পাড়ি দেন চট্টগ্রামে। মকবুল জানত, যদিও বাবা-মা তাকে তাঁর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছে তবুও তাদের ঋণ মকবুল কখনই শোধ করতে পারবেনা। কারন তারা তাঁর আপন পিতা-মাতা। অল্প শিক্ষিত হলেও মকবুলের মাঝে এতটুকু জ্ঞান ছিল।
মকবুল বর্তমানে তাঁর বাবা-মা ও সস্ত্রীক পতেঙ্গায় থাকেন। দু রুমের বাসা নিয়েছেন। কখনো ঝালমুড়ি কখনো বাদাম বিক্রি করেন। তবুও বাবা-মাকে কষ্টে থাকতে দেননা। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সব ভালো কাজই তো সম্মানের , আপনি এ পেশায় নিয়োজিত থেকে সিলেটে থাকেননা কেন?
মকবুল খানিক চিন্তা করে বলেছিল- সে চলে যেতে পারে, এখন তাঁর মাঝে সে আত্মবিশ্বাস এসেছে। তবে কেন জানি এ চট্টগ্রাম শহরের উপর তাঁর মায়া পড়ে গিয়েছে। চাইলেও তিনি কেন জানি মন থেকে সায় পাচ্ছেন না চট্টগ্রাম ছেড়ে নড়তে।–
সেদিনের মত তাঁর সাথে আর কথা হলোনা। আশা করি একদিন মকবুলের সাথে আবার দেখা হবে। তাঁর জীবন সম্পর্কে আরো কিছু হয়ত জানার বাকি আছে!