দ্যা সাইলেন্ট ফাইটার

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

 

“At least be like a Moon if you cannot afford to be like a Sun to the one in need.”
-Irfan Hafiz

Depressed জীবন নিয়ে?
কখনো কী মনে হয়েছে, “আসলেই আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা”?
অথবা “আমার সাথেই কেনো বারবার এমন হয়?”
অথবা “যদি ‘অমন’ হতো/আমার যদি ‘সেটা’ পাওয়ার সামর্থ্য থাকতো তবে হয়তো জীবনে অনেক কিছুই করতে পারতাম”?
আফসোস…আফসোস…আর আফসোস…

এতো এতো আফসোসের ভীড়ে কখনো কি ভেবে দেখেছেন…যদি এই পা দু’টো কোনদিন অচল হয়ে যেতো, হাত দু’টো অচল হয়ে যেতো, অথবা স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতো অথবা যদি কোনদিন চিরকালের জন্যে পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে যেতো …তবে কী হতো আমাদের?

ইরফান হাফিজের ক্ষেত্রে এই সবগুলোই ঘটেছিলো। Duchenne Muscular Dystrophy (DMD) নামে এর বিরল দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুই যুগের বেশী সময় তিনি প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। এক অবস্থানে থেকে বিছানায় কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের দুই-তৃতীয়াংশের বেশী সময়। কিন্তু এই প্রতিকূলতা, এই নিথরতা কি অর্থপূর্ণ এবং বড় কিছু অর্জনে বাধা ছিলো তার জন্যে? ইরফান হাফিজ নামের এই ব্যক্তির জীবন এক অজেয় জীবনের গল্প, যেখানে প্রতিকূলতাই হয়ে উঠে শক্তি, যেখানে একজন অসাধারন মানুষের ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে তার সমস্ত অক্ষমতা। যে অবিশ্বাস্য গল্পে একজন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত অচল ব্যক্তি তার শরীরের কর্মক্ষম একমাত্র অঙ্গ হাতের আংগুলটিকে ব্যবহার করে হয়ে উঠেন ‘keyboard Warrior’-এই শব্দটির প্রতিশব্দ।

“Nothing stops the man who desires to achieve. Every obstacle is simply a course to develop his achievement muscle. It’s a strengthening of his powers of accomplishment’– Thomas Carlyle

এটি একজন Silent Fighter এর Silent struggle এর গল্প…

১৯৮১ সালে শ্রীলংকার মাতারা শহরে হাফিয ইসসাদিনের ৮ সন্তানের তৃতীয় সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন ইরফান হাফিজ। তার বাবা ছিলেন একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও শিক্ষামূলক ম্যাগাজিন আরুম্বু এর সম্পাদক। ইরফানের জীবনের ট্র্যাজিডি শিশুবেলাতেই শুরু হয়। সিঁড়ির একটা ধাপ উঠতেও ইরফানের কষ্ট হতো। কিন্তু বাবা-মা সমস্যাটা নিয়ে তখনও অতটা চিন্তিত হননি। কিন্তু ২ বছর পর যখন সে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতে লাগলো তখন তারা বুঝলেন কোন সমস্যা আছে। কলোম্ব মেডিকেল স্কুল অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সিদ্ধান্ত নিলো এটি দূরারোগ্য Duchenne Muscular Dystrophy। ইরফান যখন গ্রেড ৫ এর ছাত্র তখন শিক্ষক বলে দিলেন ইরফানের শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে তার পক্ষে স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। যখন পরিবারের বাকি ৭জন ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতো ধীরে ধীরে প্যারালাইসিসের দিকে এগিয়ে যাওয়া ইরফান তখন বাসায় একা পড়ে থাকতো। ১২ বছর বয়সে সে পুরোপুরি হুইল-চেয়ার নির্ভর হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে ইরফানের শরীরের সমস্ত পেশীগুলো অচল হয়ে যেতে শুরু করে এবং সে একসময় পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। ডাক্তাররা বলেছিলেন ইরফান ১৮বছরের বেশী বাঁচবেনা। ইরফানের জীবন যখন সমুদ্রে ভাসা ভেলার মত, সবদিকেই হতাশা আর অন্ধকার এমন সময় ইরফান সিদ্ধান্ত নিলো ইংরেজী ভাষা শেখার । সে নিজে নিজে ইংরেজী শেখা শুরু করলো এবং Google এ সার্চ দিয়ে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের উপর যথেষ্ট পড়াশোনা ও গবেষণা করতে লাগলো।

যখন ইরফানের বয়স ১৬ তখন ইরফানের শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা শুরু হওয়ায় সুইডেন থেকে আনা একটি যন্ত্রের সাহায্যে তখন থেকে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে হতো তাকে। এইভাবেই চলতে লাগলো জীবন ও মৃত্যুর সংগ্রাম। যেখানে ইরফান হাফিজ নামের সেই ছেলেটির ওই কঠিন সংগ্রামের মাঝে ভেঙ্গে-চুরে চুরমার হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো, সেখানে আল্লাহর উপর সুদৃঢ় বিশ্বাস জীবন নামক এই কঠিন চ্যালেঞ্জটি মুকাবেলার জন্যে ইরফানকে প্রস্তুত করছিলো। এমনি সময় একদিন ইরফান ফেসবুকে একটি ইংরেজী কবিতা লেখেন। অনেকেই সেই কবিতাটির প্রশংসা করে এবং তাকে উৎসাহ যোগায় আরো লেখার জন্যে।

শুরু হয় শুধুমাত্র একটি আঙ্গুল দিয়ে ইরফানের সাহিত্য জীবন।

ইরফান শুয়ে শুয়ে এক আঙ্গুল দিয়ে কম্পিউটারে টাইপ করে কবিতা লিখতে থাকেন। যখন ইরফানের লেখা কবিতার সংখ্যা ২২ হলো তখন তার বাবা এইগুলো একত্রে বই আকারে ছাপানোর উদ্যোগ নিলেন। প্রকাশিত হলো ইরফান হাফিজের প্রথম বই ‘Silent Struggle’. ধীরে ধীরে ইরফানের আঙ্গুলের শক্তি কমে আসতে লাগলো। তিনি আর আগের মতো ল্যাপটপে টাইপ করতে পারছিলেননা। তখন তিনি মাউজের মাধ্যমে অন-স্ক্রীন কীবোর্ডে প্রতিবারে একটি শব্দ টাইপ করে লিখতে লাগলেন। এইভাবেই প্রকাশিত হলো ইরফান হাফিজের ২য় বই ‘Moments of Merriment’. এই বইয়ে তার জীবন অভিজ্ঞতা থেকে লেখা ১৫টি ছোট গল্প আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই বইয়ে প্রায় ৪০,০০০ শব্দ আছে এবং প্রতিটি শব্দ ইরফানকে মাউজ দিয়ে টাইপ করতে হয়েছিলো! Passion, Patience, perseverance এই শব্দগুলো হয়তো ইরফান হাফিজের মতো অসাধারন মানুষদের জীবনের সাথেই যায়…

তার তৃতীয় বই ‘Silent Thoughts’- যা ছিলো জীবন ও জগৎ নিয়ে তার চিন্তাকে কেন্দ্র করে। এই ৩টি বইয়েরই প্রথম কপি সবগুলো বিক্রি হয়ে যায়। এমনকি শ্রীলংকার বাহির থেকেও বইগুলোর অর্ডার আসতে লাগলো। ইরফানের এই বইগুলো তাকে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষের মাঝে খ্যাতি এনে দেয়।এবং ইরফান হাফিজের জীবন ও কর্ম বহু মানুষের জীবনের প্রেরনা হয়ে দাঁড়ায়।ইরফান হাফিজকে নিয়ে তৈরী হতে থাকে একের পর এক মোটিভেশনাল ভিডিও। কিছু কিছু ভিডিওর ভিউয়ারস ২০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়!

এর মাঝে ইরফান মাউজ ব্যবহার করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রটি ছাড়া তিনি ৫মিনিটের বেশী স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে পারতেননা। তখন আই-ফোনের মাধ্যমে টাইপ করে ইরফান তার চতুর্থ বইয়ের কাজ শুরু করেন। কিন্তু এই বইয়ের কাজ তিনি শেষ করতে পারেননি। DMD নামক দূরারোগ্য ব্যাধির সাথে ইরফানের জীবনব্যাপী সংগ্রাম অবশেষে২০১৮ সালে ৩৭ বছরে এসে শেষ হলো। ইরফান চলে গেলেন তার রবের সাক্ষাৎ এ, যে সাক্ষাতের জন্যে তিনি অপেক্ষা করছিলেন, নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন।

৩৭ বছরের জীবন…যে জীবন প্রায় পুরোটাই কেটেছে চলৎশক্তিহীনভাবে এক দূরারোগ্য ব্যাধির সাথে সংগ্রাম করে। কিন্তু যাওয়ার বেলায় শুধু একটি আঙ্গুল দিয়ে তিনি বহু মানুষের অন্তরকে জয় করে গিয়েছিলেন, লাখ লাখ মানুষের জন্যে তিনি এমন এক প্রেরনা রেখে গিয়েছিলেন যা আমাদের মতো সুস্থ-সক্ষম মানুষেরা শুধু কল্পনার জগতেই ভাবতে পারি। কোথায় পেয়েছিলেন এই মানুষটি এমন অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য ও হার না মানা মানসিকতা? ইরফান হাফিজ একবার লিখেছিলেন,

“ ধর্মের প্রতি মজবুত বিশ্বাস এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি অগাথ আস্থা জীবনের কঠিন পরীক্ষাগুলো হাসিমুখে মেনে নেওয়ার জন্যে আমার মাঝে মজবুত ইচ্ছাশক্তি তৈরী করে দিয়েছিলো, আলহামদুলিল্লাহ। এইটা বলার মতো মজবুত মানসিকতা আমার আছে যে, কোন প্রতিকূলতা অথবা দুঃখ-ক্ষোভ কখনোই একমুহূর্তের জন্যে আমার সাহস বা বিশ্বাসকে টলাতে পারেনি। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি Duchenne নামক রোগটি আমাকে ধৈর্য শিখিয়েছে, শিখিয়েছে সমস্ত রকম কষ্ট ও পরীক্ষাকে সহ্য করতে”।

আমি জীবনে অনেক মোটিভেশনাল স্পিচ শুনেছি, কিন্তু ইরফান হাফিজের Silent Struggle বইয়ের প্রকাশনাকালে তিনি বিছানায় শুয়ে এক হাতের উপর মাথা রেখে যে ছোট্ট ব্যক্তব্যটি তিনি দিয়েছিলেন তা আমার জীবনে শোনা অন্যতম শ্রেষ্ঠ মোটিভেশনাল স্পিচ…

“আমি আমার জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডের জন্যে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ…আমার কবিতাগুলোতে আমি এই বিষয়টিতেই জোর দিতে চেয়েছি যে আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিটি নিয়ামতের জন্যে আমাদের কতটা কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অধিকাংশই এই নিয়ামতগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনা। আমি জানি শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে নাড়াতে পারা আমাদের জন্যে কত বড় নিয়ামত। কিন্তু আমরা কতজনই বা এই বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখি? আমি জানি হাতটা নাড়াতে না পারা, কানটি চুলকাতে না পারার অনুভূতি কতবড় অসহায়ত্বের অনুভূতি। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ধৈ্র্যের মতো নিয়ামত আমায় দেওয়া হয়েছে। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আল্লাহ আমাকে ধৈর্য শিখিয়েছেন।। আমার রব্ব আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অচল করে দিয়ে আমার মস্তিষ্ককে অনেক অনেক মজবুত করে দিয়েছেন যেনো এই সমস্ত প্রতিকূলতাকে আমি সহ্য করতে পারি। তিনি আমাকে শ্রেষ্ঠ থেকে শ্রেষ্ঠতর যে পুরষ্কার তার জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে চেয়েছেন…”।

TEDTalk এ দাঁড়িয়ে হয়তো এই কথাগুলো তিনি বলতে পারেননি, কিন্তু লাখ লাখ মানুষের জীবনে অনুপ্রেরণা হয়ে আছে ইরফান হাফিজের এই কথাগুলো…

ইরফান হাফিজের জীবন আমাদের সকলকেই নিজেদের জীবন নিয়ে দ্বীতিয়বার চিন্তা করতে বাধ্য করে…

জীবন নিয়ে অভিযোগ করার আগে তাই দ্বীতিয়বার ভাবুন। একজন কৃত্রিম অক্সিজেন নির্ভর সম্পূর্ণ চলৎশক্তিহীন ব্যাক্তি যদি তার একমাত্র সক্ষম দূর্বল আঙ্গুলটি দিয়ে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেন, ৩টি অসাধারণ বইয়ের লেখক হতে পারেন, লাখ লাখ মানুষের জীবনের অনুপ্রেরণা হতে পারেন, এই অক্ষম শরীরিটি নিয়ে রমজান মাসের সিয়াম পালন করতে পারেন, জীবনকে জীবনের মতো বাঁচার প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি রাখতে পারেন…সেখানে আমার আপনার মতো সুস্থ-সবল মানুষদের অভিযোগ, অযুহাতগুলো কি বড়ই ঠুনকো নয়?

মানবজাতির ইতিহাস বারবার প্রমান করেছে যে মানুষের ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতা এতো বেশী যে এটি যে কোন প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে দিতে সক্ষম। মানুষের ভেতরের শক্তি বাহিরের ঝড়-ঝঞ্ঝাকে থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।তাই প্রতিবন্ধকতার দিকে তাকাবেননা। আপনাকে দেওয়া স্রষ্টার নিয়ামতগুলোকে শক্তি ও সাহসে পরিণত করুন। এবং সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনেক বড় কিছু করার আকাঙ্ক্ষা রাখুন।

আমরা এই অসাধারণ মানুষটির মাগফিরাত কামনা করি। তিনি তার রব্বের কাছে যে শ্রেষ্ঠতম পুরষ্কারের আশা করেছিলেন তাঁর রব্ব যেন তাকে সেই জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। আমীন।


“Then, undoubtedly, you shall surely be asked about the blessings”
[Sura at- Takathur:8]

তথ্যসূত্রঃ
1. The Story of Irfaan Hafiz: 
2. Colombo Telegraph:
3. Speech During the Launching Ceremony of Silent Struggle:

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া