মানুষের জীবনের গল্পে দুটো প্রধান অংশ থাকে প্রথম অংশে সে জীবন যে জীবন সম্পর্কে সবাই জানে, ২য় অংশে আছে সেই জীবন যার সম্পর্কে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ অবগত নন বাবা গুটিকয়েক মানুষ মাত্রই জানে।
তাসলিমা হায়দার এখন তার জীবনের কোন অংশে আছে তা তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। মা-বাবার একমাত্র কন্যা। খুবি আদরে লালিত মেয়ে। জীবনের হেন আল্লাদ নেই তার মা-বাবা তা পূরন করেন নি।
আজ সকালে উঠেই তাসলিমার মনে পড়লো আজ তার বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার কথা। সে এক ঘন্টা দেরি করে ফেলেছে। এক ঘন্টা দেরি এমন বড় ব্যাপার হতনা, যদি সে ঢাকায় না থাকত। ঢাকার জ্যামের খ্যাতি আস্তে আস্তে পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তাসলিমার কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারায় মন খারাপ হয়ে গেলো। পরক্ষনেই সে লাফ দিয়ে উঠলো, যা সময় অপচয় হয়েছে ঠিক আছে আর হতে দেওয়া যায় না। সে মা আমার তাওয়াল বলে যেন উড়ে চল্ল গোসলখানায়।
১০ মিনিটের মাথায় ডুপ্লেক্স ঘরের সিড়ি বেয়ে তাসলিমা নেমে এলো নীচ তলায়। টেবিলে বসে আছেন বাবা আলী হায়দার, মা রোকসানা বেগম। তাসলিমা কথা খুব কম বলে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকোলো। মাঝ পথে বাবা খালি একবার জিজ্ঞেস করলেন “ কোথায় যাবে মা?”
তাসলিমার সোজাসাপ্টা উত্তর”বৃধাশ্রম”।
তাসলিমার বাবা এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাইলেন না। মেয়েকে রিতীমত ভয় পান তিনি। মেয়ের মেজাজ মর্জির ঠিক নেই কোন। এই পর্যায়ে মনে হতে পারে তাসলিমা বুঝি খটমটে, পরিপক্ক কোন মেয়ে। তাসলিমা পরিপক্ক বটে তবে তার বয়স ১৭ ছুই ছুই।
তাকে দেখে তার অনেক বান্ধবির হিংসে হয়, এই বয়সে তার কত স্বাধীনতা , কত ক্ষমতা। ইশ তাদের মা-বাবাদের কেনো তাসলিমার মা-বাবার মত বাড়ি গাড়ি নেই!
তাসলিমার অবশ্য নিজের এই আরাম আয়েশের জীবন নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা নেই! তার যত আল্লাদ অন্যদের জন্য!
টানা দু ঘন্টা ৩০ মিনিট বাদে তাসলিমার কালো গাড়িটা এসে থামলো বৃদ্ধাশ্রমের গেটে। অদ্ভুত তো! এই মাঝ দুপুরে বৃদ্ধাশ্রমের গেট এ তালা কেনো! তাসলিমা ১০ মিনিট গাড়িতে বসার পর দেখতে পেলো কেউ আসছে গেটের দিকে। ওই তো, শিকদার দারোয়ান আসছে, গেট খুলে দিতে। তাসলিমা শিকদার কে গরম হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শিকদার জানালো, গত রাতে বৃদ্ধাশ্রমে চোর ঢুকেছিলো, তারপর থেকেই এই কড়াকড়ি ব্যাবস্থা।
বৃদ্ধাশ্রমে কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাথে ভালো সময় কাটিয়ে আর তাদের কে বিভিন্ন গিফট দিয়ে এসে তাসলিমা গাড়িতে করে সোজা চলে যাবে গানের স্কুলে। তার এই ধরনের জীবন দেখে অনেকেই চিন্তা করে ইশ যদি তাসলিমার মত করে বাঁচতে পারত!
তবে তাসলিমা যে শুধু গান শিখে তাই নয়, তার তত্ত্বাবধানে চলে একটি সম্পূর্ন অসহায় পরিবার। সেই পরিবারের ঘর ভাড়া থেকে শুরু করে খাওয়তা দাওয়া সবই তাসলিমা চালায়। এতক্ষনে নিশ্চই বুঝতে পারছেন বাবা-মার কাছে তাসলিমার আবদার গুলোর মদ্ধ্যে এটাও অন্তর্ভূক্ত!
******************************************************************************************************
নিতিশ বার বার চিন্তা করেও ভেবে করতে পারেনা এই তাসলিমা মেয়েটা এরকম কেনো! নিজের টাকায় পরের ঘর চালায়, দুই ঈদে শত-শত ছেলেমেয়ের মুখে হাসি ফোটায় তাদেরকে নতুন জামা কাপড় দিয়ে। কেনো সে এসব করে! এবং খুব নিয়মিত ভাবে, যেন এটাই তার জীবন!
নিতিশ তাসলিমা কে অন্য জীবনের রূপ দেখাতে চায়, কিন্তু তাসলিমা তার আগের জীবনেই বেশি খুশি ছিলো । নিতিশ তাসলিমার ভালো বন্ধু হলেও ,তাসলিমা নিতিশদের সাথে পাব,ক্লাব এ সময় কাটাতোনা। এভাবেই ধীরে ধীরে নিতিশদের সাথে তাসলিমার সম্পর্কে ছেদ পরে। তাসলিমা বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে পথশিশুদের আর বৃদ্ধাদের নিয়েই তার শখের জীবন কাটাতে লাগলো।
তার রাতের অশ্রু কেউ দেখতনা। হয়ত শুধুই সৃষ্টিকর্তা , কাছের কেউ, ডাক্তার আর শুধু বাবা-মা ছাড়া ! ডাক্তার বলে দিয়েছেন বছর দুয়েক আগেই, ক্যান্সারের রোগী। বেশিদিন আর বাচবেনা তাসলিমা!
শুধুই তাসলিমার অনুরুধ রক্ষা করে তার বাবা মা এই সত্য কাউকে জানায় নি! তাসলিমা কারো করুনা নিয়ে নয় সবার মাঝে সবার মত করে থাকতে চায়। সে ক্যন্সারের রোগী জানলে কেউ নিশ্চই তাকে হিংসে করতোনা! সবাই শুধুই করুনা দেখাতো!
সে কাউকে জানায়নি কারন, কারন যে কটা দিন বাঁচবে , সে মানুষের হিংসা,রাগ ,ভালোবাসা আর ক্ষোবের মাঝেই বাঁচতে চায়।জানে আর বেশিদিন বাঁচবেনা , তবুও কেন জানি তাসলিমার বাঁচার ইচ্ছে হয়। বৃদ্ধাশ্রমে , আর পথশিশুদের সাথে কাটানো সময় গুলো সে বার বার ফিরে পেতে চায়! সে জানে সে পাবেনা! তবুও পেতে চায়! তাসলিমা অঝোরে কাঁদতে থাকে!
*****************************************************
এই মেয়েটার সম্পর্কে যখন শুনলাম তখন আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ার এর ছাত্র। তার খুব কাছের একজনের কাছ থেকে তার সম্পর্কে জেনেছিলাম, হয়ত মা-বাবার বাইরেও কেউ জানত তাসলিমার কথা! তার থেকেই আমার শোনা! এরপর অনেকদিন হয়ে গেছে আমি জানতে চাইনি তাসলিমা কেমন আছে। ভয় হয়, খারাপ কিছু শুনবো বলে।
তাসলিমার সেই কাছের মানুষ্টি এইতো সেদিন জানালো, তাসলিমা আর সে সুখেই আছে! তাদের একটা সন্তান আছে! তাসলিমা এখনো পথশিশুদের কাছে যায়, বৃদ্ধাশ্রমে যায়। সে এখন ক্যান্সার নামক ব্যাধী থেকে মুক্ত!
কিভাবে কখন, আমি এত কিছু আর জানতে চাইনি। আমি শুধু আনন্দে চোখের পানি মুছেছিলাম ! কেন জানিনা! তাসলিমা বেঁচে আছে শুনে জীবন কে আরো ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে! ক্ষনিকের জীবন! আজ আছি কাল নেই!
কোথায় জানি বেজে উঠলো” আজ জীবন খুজে পাবি, ছুটে ছুটে আয়……”