আনিসুল হক – একজন সফল রাজনীতিবিদ , উদ্যোক্তা এবং টেলিভিশন উপস্থাপক

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এর সফল  রাজনীতিবিদ ,উদ্যোক্তা এবং টেলিভিশন উপস্থাপক ,  ঢাকার নগর পিতা মেয়র আনিসুল হকের জন্ম হয়েছিল ১৯৫২ সালে। ভাষা   আন্দোলন এর ঠিক এক বছরে পরেই। একজন শিশুর জন্মের পরেই বলে দেওয়া যায় না, সে কি হবে কি হবেনা। কিন্তু ভাগ্য বিধাতার নিয়তির কালিতে, হয়ত সেই ভবিষ্যৎ আগেই লিখা হয়।  আনিসুল হক জন্মেছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত নোয়াখালি জেলার কোম্পানীগঞ্জে । কে জানত জন্মের পরে এই ক্ষুদে সন্তান একদিন ঢাকাকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখবেন। হয়ে উঠবেন ব্যবসায়ী থেকে নগর পিতা।

আনিসুল হকের নানা বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজী এর আমিরাবাদ ইউনিয়নের   সোনাপুর গ্রামে।শৈশবের বেশ কিছু সময় তিনি কাটিয়েছেন এখানে। দুরন্ত শৈশবের সে সময় টা মানুষ কখনই ভুলতে পারেনা । আনিসুল হকের  ও শৈশবের সে সময়ের কথা না ভুলার ই কথা। স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন আনিসুল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন চবি(চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে। আনিসুল হকের জীবন ছিলো কর্মময় ।এ যেন  ধীরে ধীরে চারা গাছ থেকে  মহিরুহে পরিণত হয়ে ওঠার গল্প। টেলিভিশনে উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে আনিসুল হকের কর্ম জীবনের শুরু। তার হাত ধরে দেশের টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। ১৯৮০ সালে তাঁর টেলিভিশনে তাঁর উপস্থাপক হিসেবে যাত্রা শুরু।  সে থেকে শুরু করে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত তিনি এ কাজে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। ‘আনন্দমেলা’ নামে এক অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থাপনা ছিল জনপ্রিয়। ‘অন্তরালে’ অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থাপনা ছিল দেখার মত। দুটো অনুষ্টান ই তাঁর উপস্থাপনার গুনে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। সাল ১৯৯১। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া মুখমুখি একটি টেলিভিশনের অনুষ্টানে । সেখানেও উপস্থাপক হিসেবে ছিলেন আনিসুল হক।

বোধকরি টেলিভিশনের উপস্থাপক নয় একজন সমাজ সংস্কারকের ভুমিকায় তাকে বেশি মানায়। একজন ব্যবসায়ি হওয়ার দিকে মনযোগ দিলেন তিনি। আশির দশকে  বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সাথে জড়িয়ে পরেন আনিসুল হক। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন একজন সফল ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা । ধীরে ধীরে গড়ে তুলেন নিজের  প্রতিষ্ঠান । ১৯৮৬ সালের একদিন, প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান “মোহাম্মদী গ্রুপ” । এই গ্রুপের অধীনে পোশাক তৈরি হয়। এছাড়াও এই গ্রুপের অধীনে রয়েছে বিদ্যুৎ , তথ্যপ্রযুক্তি, এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা । ২০০৭ এর জরিপ অনুযায়ী এই “মোহাম্মদী গ্রুপ” প্রায় ৭০০০ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। এটা ছিল আনিসুল হকের  স্বপ্ন পুরনের পথে প্রথম মাইলফলক। ২০০৫ সালে আনিসুল বিজিএমই এর সভাপতির দায়িত্ব প্রাপ্ত হন আনিসুল হক, এ দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করেন ২০০৬ সাল পর্যন্ত। জীবনের সাফল্যের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যান ২০০৮ সালে, এফবিসিসিআইর এর সভাপতি নির্বাচিত হন ২০০৮ এ,যেটা কিনা ব্যবসায়িদের শীর্ষ সংগঠন। সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। এখানেই থেমে থাকেন নি আনিসুল হক। তিনি  বিআইপিপিএরও সভাপতি ছিলেন। বিআইপিপি হলো বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন।

 এর পর শুরু হইয় আনিসুল হকের রাজনৈতিক জগতে পদচারনা। রাজনৈতিক বা ব্যক্তি জগত উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। তাঁর মাঝে একটা অভিপ্রায় ছিল সুন্দর সমাজ গঠনের। হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সুশীল সমাজ,শিক্ষিত সমাজ রাজনীতিতে না জড়ালে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সাল ২০১৫। শুরু হলো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন।  সে সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামিলীগ থেকে আনিসুল হক মেয়র পদের জন্যে মনোনয়ন লাভ করেন।এখানেও তাঁর বিজয় হয়। তিনি বিজয় লাভ করেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও।ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরে  ঢাকা উত্তরের জন্য তাঁর কিছু সাহসী পদক্ষেপ ছিল প্রশংসনীয়  ।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বনানীতে ডিএনসিসির জায়গা উদ্ধার যা আটকা পরে ছিল মোনায়েম খানের বাড়ির ভেতর। ১৪ কাঠা জমি উদ্ধার করেছে ডিএনসিসি, আনিসুল হকের সময় প্রকল্পের অংশ ছিলো, এটাকে পার্ক হিসেবে তৈরি করা হবে, সেই হিসেবে নকশা অ করা হয়েছিল। এখনএ নিয়ে আলাদা কোন  উদ্যোগ নেই আর। ১১ টি ইউটার্নের প্রকল্প গ্রহনের উদ্দেশ্য ছিল বিনবন্দর সড়কের যানজট কমানো। শৈশবে সবুজের মাঝে বেড়ে ওঠা আনিসুল হকের স্বপ্ন ছিল সবুজ ঢাকার। এজন্য তিনি গ্রহন করেছিলেন ৫ লাখ গাছ লাগানোর উদ্যোগ।এছাড়াও তিনি নগর উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রহন করেছিলেন বিভিন্ন উদ্যোগ। যানজট নিরশনের জন্যে, এবং গাবতলী সহ ৯ টি জায়গা  পার্কিং মুক্ত রাখা ছিল তাঁর প্রকল্পের অংশ।তাঁর অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে ছিল নিরাপত্তার জন্যে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা । শ খানেক আধুনিক গনশৌচাগার নির্মান করা ছিল তাঁর স্বাস্থ্যকর , সুন্দর ঢাকা নির্মানের লক্ষ্যে আরেকটি পদক্ষেপ। । খেলাধূলার মান উন্নয়নে তাঁর লক্ষ্য ছিল খেলার মাঠের উন্নয়ন সাধন করা ।

আনিসুল হকের মৃত্যুর পরে তাঁর  নেওয়া এমন দশটি প্রকল্প এখন স্থবিরতার মুখে।  দরকার তাঁর মত শক্তিশালি নেতৃত্বের । নতুবা বঞ্চিত হবে নগরবাসী ।গাবতলীতে দখলে থাকা ৫২ একর দখল কৃত জমি উদ্ধার করেছে ডিএনসিসি।  দেখার বিষয় প্রয়াত মেয়রের স্বপ্নের ঢাকার প্রকল্প গুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বর্তমান প্রশাসন প্রস্তুত কিনা। হয়ত প্রতি বন্ধকতা থাকবে, তবুও হয়ত সম্ভব, যদি যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া যায়।  সময় ই বলে দিবে সময়ের দাবি মেটাতে সক্ষম কিনা আমরা। আনিসুল হক যে স্বপ্নের পথে একধাপ এগিয়ে ছিলেন, আমাদের দায়িত্ব, এসময়ের নেতাদের দায়িত্ব তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকা। এটা এখন সময়ের প্রশ্ন , স্বপ্ন দ্রষ্টা আনিসুল হকের ১০ টি বড়  উদ্যোগ কি আলোর মুখ দেখবে?

আনিসুল হক ছিলেন পারিবারিক মানুষ। তাঁর স্ত্রীর নাম রুবানা হক ।বর্তমানে তাঁর স্ত্রী  মহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আনিসুল হক ছিলেন চার  সন্তানের গর্বিত পিতা। তাঁর দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তানিশা ফারিয়ামান এবং অয়ানিক উমাইরা তাঁর মেয়েদের নাম। ছেলের নাম নাভিদুল হক । ছোট ছেলে শারাফ কবরে শায়িত আছেন।  তাঁর পরিবারে বিভিন্ন ব্যক্তি সমাজের বিভিন্ন ভালো জায়গায় আছেন। তাঁর ছোট ভাই আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেনা প্রধান হিসেবে আছেন। মৃত্যু মানুষের জীবনের অমোঘ সত্য। মৃত্যু থেকে কেও পালিয়ে বাঁচতে পারেনা। আনিসুল হক পারেন নি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসতে ।

সপরিবারে যুক্তরাজ্যে ব্যক্তিগত  সফরে যান মেয়র আনিসুল হক ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই।  সেখানেই তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন। ১৩ আগস্ট তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার দের নিবিড় পর্যবেক্ষনে সনাক্ত করা হয় তাঁর মস্তিস্কের রক্তনালী প্রদাহের সমস্যা। এই রোগ কে বলা হয় সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস।এর পর তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষন কেন্দ্রে রাখা হয়।  ৩১ অক্টোবর তাঁর অবস্থার উন্নয়ন ঘটলে তাকে আইসিইউ(ICU) থেকে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে(Rehabilitation centre) সরিয়ে নেওয়া হয়। আবার ২৮ নভেম্বর তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার (Rehabilitation centre)থেকে তাকে আবার আইসিইউ (ICU) তে সরিয়ে নেওয়া হয় । এর পরে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। দেশের মানুষ কায়মনোবাক্যে দোয়া করছিল নগরপিতার সুস্থতার জন্যে।

৩০ নভেম্বর,  বাংলাদেশ সময় তখন  রাত ১০.২৩ । চিকিৎসাধীন অবস্থায় লন্ডনের ওয়েলিংটন  হাসপাতালে আনিসুল হকের মৃত্যু ঘটে। ২০১৭ সালের ২ ডিসেম্বর তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়  আর্মি স্টেডিয়ামে । জানাজার পরে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। এখানেই শায়িত আনিসুল হকের ছোট ছেলে শারাফ ও  আনিসুল হকের মা। একজন মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় না। বেঁচে থাকা মানুষেরা ,যারা তাঁর স্বপ্নকে বুকে লালন করে , তাদের হাত ধরে এগিয়ে যায় স্বপ্নেরা । আনিসুল হক ছিলেন বাংলার সফল ব্যক্তিত্ব , একজন সফল অ জনপ্রিয় মানুষ। তাঁর বুকে লালিত ছিল সুন্দর ঢাকার,একটি সুন্দর দেশের স্বপ্ন। তিনি তাঁর স্বপ্ন পুরন করে যেতে পারেন নি। আমাদের দায়িত্ব তাঁর স্বপ্নকে আলোর মুখ দেখানোর জন্যে নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করা।

রেফারেন্স ঃ http://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1494426/%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%B9%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A7%A7%E0%A7%A6-%E0%A6%AC%E0%A7%9C-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97-%E0%A6%A5%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%9B%E0%A7%87

https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%86%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2_%E0%A6%B9%E0%A6%95_(%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6)

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন