বিপদে তাড়াহুড়া যেন কাজকে আরো বাড়িয়ে দেয়। জ্যামের তিক্ত স্বাদের পর এখন ট্রেনের শিডিউল মিস। বিরক্তি ভরা মন নিয়ে প্লাটফর্মের আঁটসাঁট একটা বেঞ্চে বসলাম। আসেপাশে ঘরে ফেরা মানুষের আনাগোনা । কেউ বসে আছে, কেউ পরিবার পরিজনের সাথে কথা বলে বেকার সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু সবার মধ্যে আমার মতই ঘরে ফেরার তাড়া, ঠিক এখানেই সবার মধ্যে একটা অদৃশ্য মিল।
হাত দুটি দু-দিকে প্রসারিত করে বেঞ্চে হেলান দিয়ে একটু আরাম করার চেষ্টা করলাম । সকল ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করতেই এক বিস্বাদ অস্থিরতা আমাকে বিষন্নতার চাদরে মুড়ে ফেলল। কোনোমতে নিজে সামলে নিয়ে মনকে বুঝাতে চাইলাম, “আল্লাহ যা করে সব ভালর জন্যই করে”। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে মায়ের জন্য দোয়া করলাম যেন তাঁকে সুস্থতা দান করেন ।
ইদানীং মায়ের শরীরটা বেশ ভালই যাচ্ছিল। আগে হঠাৎ হঠাৎ অসুস্থ হতেন, এখন হঠাৎ হঠাৎ সুস্থ থাকেন। একটা সময় ছিল তখন কি পরিশ্রমটাই করতেন তিনি। বাস্তবতা বুঝার আগেই পিতৃবিয়োগের অভাব কখনোই বুঝতে দেননি। সবসময়ই একটা রক্ষণশীল ভুমিকা থাকতো আমাদের উপর। সঠিক সময়ে সঠিক জিনিসটাই তুলে দিতেন আমাদের হাতে। যখন সেই মমতাময়ী মাকে হারানোর আশংকা জাগলো বুকটা অসাড় হয়ে উঠে। আজ সকালের বড় আপার সাথে ফোনালাপের পর সেই ভয়টা যেন আরোও একটু বেড়ে গেল।
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার স্বভাবটা এখনো হয়নি। তাই প্রতিটি সকালে আমাকে তন্দ্রার অতলে ডুবে থাকতে হয়। তেমনি আজও হারিয়ে যাচ্ছিলাম তন্দ্রার অতলে। কিন্তু হঠাৎ… একটা শব্দ আমাকে প্রচেন্ড জোড়ে ধাক্কা দিল। মোবাইলটা ভু ভু করছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে মোবাইলের দিকে তাকাতেই বুকের ভিতর ছাঁৎ করে উঠলো। এই অসময়ে আম্মার ফোন ? নিশ্চিত দুসংবাদ ভেবে, ভয়ে ভয়ে ফোনটা ধরতেই ছোট-খাট একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেলো আমার কানের উপর দিয়ে…
-হ্যালো, এতো সকালে ফোন ?? কেমন আছো ?
মোটামুটি একটা বড় রকমের ঝারি খেয়ে বুঝলাম আসলে বড় আপা।
-তুই এখনো ঘুমাইতাছস, বেলা কয়টা বাজে, খবর আছে ???
মোবাইলটা কান থেকে চোখের সামনে এনে দেখে বুজলাম অনেক বেলা হয়ে গেছে।
-জী আপা, ১০টা বাজে কেবল ।
আপা অনেকটা আশ্চার্যান্নিত হয়ে বললেন
-কেবল ১০টা বাজে মানে ?? তারপর বলল…
-তুই জানিস আম্মা কতটা অসুস্থ?? কোনো খবর আছে তর??
আপার গলায় উদ্বিগ্নতার সাথে অসহয়াত্বের সুর। আমার বুজতে বাকী রইল না পরিস্থিতির ভয়াবহতা।
আমি কি বলবো বুজে উঠার আগেই আপা বলে উঠলেন…
-তুই তাড়াতাড়ি সদর হাসপাতেলে চলে আয়। আমি ইতিমধ্যে আম্মাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়েছি।
আমি সম্মতি জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম বিছানার একপাশে।
মেসের কাউকে কিছু না বলে বের হয়ে গেলাম। শুধু ফ্রেশ হতে আর কাপরের ব্যাগ গুছাতে যে সময় লাগে। ষ্টেশনে পৌঁছাতেই বাস পেয়ে গেলাম, মনে হলো কোনো ঝামেলা ছাড়াই হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবো। বাসে সিট ও পেয়ে গেলাম। বসে বসে সময় হিসাবটা করে নিলাম। কিছু দূর যাবার পর জ্যাম আমার সময়ের হিসেবকে বুড়ু আঙ্গুল দেখিয়ে এক সাগর দুশ্চিন্তা এনে দিলো। একদিকে জ্যাম, অন্যদিকে রেলস্টেশনে সময় মত পৌঁছানোর দুশ্চিন্তায় অস্থির। সময়ের অন্তরে দূরত্বের সমীকরণ যেন দীর্ঘ হচ্ছে। অস্থির দোলাচলে দোলতে দোলতে রেলস্টেশনের পৌঁছানোর খানিক পূবেই ট্রেন ছাড় অন্তিম সময় অতিক্রম হয়ে যায়। ঘুমন্ত ব্যারেকে প্রতিপক্ষের হঠাৎ আক্রমনে একজন নিরস্ত্র সৈনিকের মনের যে অবস্থা হয়, আমার মনের অবস্থা ঠিক তেমন বা তার চেয়েও খারপ হয়ে গেলো।
ব্যাথীত মনে দেহটাকে টেনে বাস থেকে নেমে চললাম প্লাটফর্মে উদ্দেশ্য। প্লাটফর্মে ঢুকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হলো না যে, কিছুক্ষন আগেই ট্রেন চলে গিয়েছে। কিন্তু অস্থির মনের এই ব্যাকুলতাকে অল্প অনুমানের আঘাতে স্থির করা যায় না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাছেই একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে দেখে তার কাছে গিয়ে, একরাশ হতাশা নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম…
-দয়া করে একটু বলতে পারেন, কিশোরগঞ্জের পরবর্তী ট্রেনটি কখন আসবে ?
-সিডিউল অনুযায়ী যে ট্রেনটি যাবার কথা ছিল তা যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে এখনো প্লাটফর্মের ছেড়ে যায় নি । কিছুক্ষন অপেক্ষা করুন । আপনি কি টিকেট নিয়েছেন ?
-না, এখনো নেই নি।
কর্তব্যরত লোকটি আমাকে টিকেট কিনার পরামর্শ দিয়ে চলে গেলো। আমি হতাশার অন্ধকারে একচিলতে সোনালি আলো দেখতে পেয়ে স্বস্তির সঙ্গে টিকেট কাউন্টারে চলে গেলাম। ট্রেন শিডিউল মিস করায় কাউন্টারে তেমন ভিড় ছিল না।
টিকেটা হাতে নিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় প্লাটফর্মের উত্তর পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। সময় যতই যাচ্ছে অপেক্ষার কালো মেঘ যেন ততই এসে জমা হচ্ছে। এদিক-সেদিক তাকালাম, চারদিকের অপরিচিত মুখগুলো যেন অপেক্ষার কালকে আরো দীর্ঘ করে তুলেছে। তাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য একটা জায়গা খুজতেই ফাঁকা পরে থাকা এই আঁটসাঁট বেঞ্চে এসে গাঁ-টা হেলিয়ে বসলাম।
হঠাৎ মাইকের অস্পষ্ট শব্দ আমার ভাবনাকে ছেদ করলো। মনোযোগটা মাইকে নিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে শুকরিয়া করলাম, “আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহ যা করে ভালর জন্যি করে”। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ট্রেনটি প্লাটফর্ম থেকে মাত্র দুই মিনিটের দুরত্ত্বে।
ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট সিটে বসলাম। ভাগ্যক্রমে সিটটা জানালের পাশে পরেছিল, তাই আশেপাশে কোলাহল আমাকে তেমন টানলো না। ট্রেন তার স্বাধীনচিত্তে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলছে। কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে, এক-একটা মিনিট যেন এক-একটা ঘন্টা। বিষণ্ণ মন নিয়ে জানালার ওপাশে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছি আর মনে মনে আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করে মায়ের সুস্থতা কামনা করছি।
সময় ও অবস্থানের ক্রমাগত পরিবর্তনে অবশেষে গন্তব্যে এসে পৌছালাম। পরিচিত কয়েকজনকে ছালাম দিয়ে, একটা রিক্সা চড়লাম সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্য। ততক্ষনে মাকে নিয়ে আপা হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছে। আমি হাসপাতালে পৌঁছে ক্ষিন সময়ের মধ্যেই মা ও আপাকে খুজে পেলাম। আমাকে দেখে মায়ের মুখে-চোখে একটু স্বস্তির ছায়া দেখতে পেলাম। মাকে সান্ত্বনার ভাষায় অভয় দিয়ে আপার কাছ থেকে গতরাতে মায়ের শারিরিক অবনতির বর্ননা শুনে পরবর্তী করণীয় ঠিক করে নিলাম। হাসপাতালে তেমন কোনো পরিচিত কেউ নেই যে, খুব তাড়াতাড়ি কার্য হাসিল করবো। তাই আউট-ডোরের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কোনমতে একজন ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি মিলল। ডাক্তার মায়ের শারিরিক অবস্থা শুনে তাঁর নিবির পর্যবেক্ষনের জন্য মাকে হাসপাতালে ভর্তি হবার পরামর্শ দিল ।
ভর্তি সেকশনে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি দেখে নিজেকে অনেক অসহায় মনে হলো। দীর্ঘ লাইন আর অব্যবস্থাপনায় আজকে ভর্তি হবার আশা ফিকে হয়ে গেলো। লাইনে অনেক্ষন দাড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে আমার এক কাছের বন্ধু “চয়ন”-কে ফোন দিলাম। তার ভাই আবার এই হসপিটালের একজন ডাক্তার। প্রথম ফোনটা ধরলো না, বুক ভড়া আশা নিয়ে দ্বিতীয় ফোনটা করলাম, রিং হচ্ছে , খট করে শব্দ হলো, “হ্যালো”
চয়নের সাথে কথা বলে নিরাশা সম্ভাবনায় রূপ নিলো। অবশেষে মাকে CC unit এ ভর্তি করানো গেলো। ভর্তি এবং ভর্তি পরবর্তী আনুসাঙ্গিক কাজ করেতে করতে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেলো। আপাকে আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। CC unit-এ রোগী ব্যতীত অন্য কেউ থাকার অনুমতি নেই বলে রাত্রীযাপনের জন্য সাধারন যে ইউনিট সেখানে আসলাম।
বারান্দায় ৫টা বেড আছে। তিনটি বেডে তিন জন রোগীসহ ৬-৭ জন । দুইটি বেড বিচ্ছিন্নভাবে খালি পরে থাকায় আমি সুযোগটা নিয়ে একটা বেড দখলে নিলাম। চারপাশের লোকগুলোর উপর ক্ষিন দৃষ্টি ক্ষেপন করে চিত হয়ে বিছায় শুয়ে একটু প্রশান্তি অনুভব করলাম। প্রচেন্ড ঝড়ের পর প্রকৃতিতে যে একটা শান্ত শান্ত ভাব থাকে ঠিক সেরকম ।শক্ত বিছানার উপর নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। এপাশ-ওপাশ করে ক্লান্তি দূর করার মিথ্যে চেষ্টা। হাল্কা-পাতলা শব্দ আর যন্ত্রণার মৃদূ মৃদু আওয়াজ মনকে আরোও বিষন্ন করে তুলে। কিন্তু আগামী কালের কার্যসিদ্ধির জন্য এখন বিশ্রামটা গুরুত্বপর্ণ। তাই শরীর ও মন দুটুকেই জোর করে বিছানার উপরিপৃষ্ঠে শয়ন করাতে বাধ্য করলাম।
টিক-টিক করে ঘড়ির কাটাও চলে যাচ্ছে স্বাভাবিক ভাবে। হঠাৎ একটা করুন আর্তনাদ মনোযোগ আকর্ষন করলো। এ-যেন মধ্যযুগীয় কোনো শিকারের শেষ আর্তনাদের সুর। মহিলাটি তার জীবনের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে যন্ত্রনা সহ্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু, কিন্তু সেও তো মানুষ ।মহিলাটির সিটটি ছিল আমার আমার সিটের বরাবর। মহিলাটি যতটা না বয়সের হিসেবে বৃদ্ধ তারচেয়েও বৃদ্ধ মনে হচ্ছিল সংসারের ভারে। হালকা গড়নের মহিলাটিকে একনজর দেখলেই বোঝা যায় রোগটি তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে শেষ করে দিচ্ছে।
যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষন পরপরই আঁতকে উঠে আর “আল্লাহ আল্লাহ, মা মা” বলে চিৎকার করছিল। কিন্তু এবারের চিৎকারটি একটু জোড়ে হলেও সুরটা করুন আর্তনাদে রূপ নিলো। তাঁর চিৎকারের শেষ টান-টুকু হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কিশোরীটি একটু ভৎসানার বশেই বলল…
– ‘মা, মা, এবার একটু থামো মা, অনেক রাত হইছে এহন একটু ঘুমাও মা।
(মেয়েটির চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। অনেকবার বারণ করা পরও যখন একই প্রশ্ন বার বার করলে মানুষ
যে বিরক্তির ভাবটি নিয়ে উত্তর দেয়, মেয়েটি ঠিক সেভাবেই তার মাকে কথাগুলো বলল।)
মহিলাটি বেঁচে থাকার আকুল নিবেদন নিয়ে বলল…
– মারে, আমি আর পারছি না-রে মা। আল্লাহ… আল্লাহ…
এই বলেই মহিলাটি চুপ হয়ে গেলো। নিরবতায় কিছুক্ষন কেটে গেলো। কিশোরীটিও তার মা হয়তো ঘুমিয়েছে ভেবে মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভোরের অপেক্ষা করছিল।
সময় যখন কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্ম দেয় তখন সে খুব নিষ্ঠুর হয়ে উঠে। তাই হয়তো কিশোরীটির অবচেতন মনে মা হারানোর আশঙ্কায় উঠলে “মা মা” বলে ডাকতে শুরু করে। কোনো প্রতিউত্তর না পাওয়ার মেয়ে আবার “মা, মা” বলে তাঁকে হালকা নাড়া দিল। ব্যর্থ চেষ্টার শুন্য ফল নিয়ে সাহায্যর আকুলতায় আমাদের দিকে তাকালো। মধ্য বয়স্ক একজন মোরুব্বি আমার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, বুঝতে পারলাম ডাক্তার বা নার্স কাউকে ডেকে আনতে হবে। এইভেবে আমি বিছানা ছেড়ে মহিলাটির কাছে গিয়ে বাম হাতটি ধরে পালস পরীক্ষা করলাম। কোনো প্রকার অনুভুতি না পেয়ে দ্রুত পায়ে ছুটে গিয়ে একজন নার্সকে নিয়ে আসলাম।
সে তাঁর পালস, চোখ পরিক্ষা করে কিছু না বলেই চলে গেলো। আমিও নিরবে সিটকে এসে বসে রইলাম।
নার্সের এই নিরব চলে যাওয়া কিশোরীটির মনে ভয়ের সৃষ্টি করলো, মেয়েটি কেঁদে কেঁদে “মা মা” করে ডাকে। মিনিট দুই-এক পরে একটি বাইশ-তেইশ বয়সের ছেলে রুমে ঢূকতেই মেয়েটির আর্তনাদ বেড়ে গেলো। ছেলেটি কাছে যেতেই মেয়েটি বলে উঠল
-ভাই, ভাই, দেখ মা যে কোনো সাড়াশব্দ করছে না। “ও মা, মা”…
ছেলেটির হাতে থাকা কিছু কাগজ আর ঔষধ বিছানার একপাশে রেখে কিছু একটা হয়তো বলল। এমন সময় একজন ইন্টার্ন ডাক্তার ও দুজন নার্স সরাসরি তাদের কাছে এসে মহিলাটির হাত ধরে পালস, চোখ, আর কি কি যেন পরিক্ষা করে নিরবে কিছুক্ষন দাড়িয়ে রইল। তারপর কিছু না বলে ছেলেটিকে সংগে নিয়ে চলে গেলো।
পাশের সিটে থাকা সেই মূরুব্বি লোকটা গুরুগম্ভীর ভাব-সাব নিয়ে আমার কাছে বসল। তিনিও এই নির্বাক চলচিত্রের আমার মত একজন নিরব দশর্ক। লোকটা এসে কিছুক্ষন বসে রইল। একটু পর নিরবতা ভেংগে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল
-”নাহ, মহিলাটা আর নেই, চলে গেছে, তুমি যেন কিশোরীকে কিছু বল না।”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতির ইঙ্গিত করলাম। লোকটা গুটিগুটি পারে তাঁর সিটে ফিড়ে শুয়ে গেলো। কিশোরীটির আহাজারি আস্তে আস্তে বাড়ছে।
ছেলেটি চলে যাওয়ার একটু পরেই বাহির থেকে ভেসে আসলো তার বুক ফাটা কান্নার আওয়াজ।
স্বজন হারা হৃদয় দহনের পোড়া গন্ধ তো আরেকটা স্বজন হারা হৃদয়-ই টের পায়। এ দহনের ধোঁয়া হয় না, না যায় দেখা, কেবল অনুভুব করা যায়।
এক জীবনে মানুষ তো কত যন্ত্রনাই সহ্য করে কিন্তু যে যন্ত্রনা সহ্য করা যায় না সেটাই কি মৃত্যু ??
সুনশান নিরবতা বারান্দার চারদিকে । কিন্তু এই নিরবতার ভাষা যেন অনেক কঠিন। প্রকৃতি যেন তার নিরবতার ভাষায় কিছু বলে যাচ্ছে। হাসপাতালে মৃত্যু কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। নিত্যদিনের সকল কাজের মতই এখানে মৃত্যু একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কাজেই এই মৃত্যুতে শুধু অনুতাপ ছাড়া কারো কোনো অনুযোগ ছিল না। কক্ষের সবাই নিজেদের মধ্যেই ব্যাস্ত। মরহুমার আত্নীয়-স্বজন কাছে যারা ছিল এসে তাঁকে নিয়ে গেলো।
নিজের সিটে বসে আপন মনে কিছু ভাবছিলাম। হাজারো দুর্ভাবনা ভিড়ে মন হারিয়ে যাচ্ছিল বিস্বাদের নীল সাগরে। নিজেকে সামলানোর জন্য ভাবলাম যে, মুরুব্বি ভদ্র লোকটার সাথে কিছুক্ষন কথা বললে হয়ত ভাল লাগবে। এইভেবে আমি ডান পাশে তাকালাম, দেখি তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন।