ভয়াল শীতের রাত

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

আরেক খন্ড স্মৃতি।

সময়টা শীত কাল। খুব  ভোরে উঠে গ্রামে মাঝে মধ্যেই হাটতে যেতাম। একদিন বন্ধুদের সাথেই প্ল্যান হল সকালে আজানের পর মানিক পাঠান যাবো। জায়গাটা সুন্দর। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সব কিছু ঠিক করে নিলাম। ওই বয়সে যা যা নেয় আরকি। নিজেকে তখন রবিন্সন ক্রুস , বা দূরদান্ত অভিযাত্রিক ভাবতে বাধা ছিলনা! ঘুম ভাংলো, বাইরে উকি দিয়ে দেখলাম হালকা আলো আছে। গভীর রাতে খুব একটা ঘুম ভাঙ্গেনা, তাই ধইরেই নিলাম একটু পরেই হয়তফজরের নামাজ এর আজান দিবে।  

 

বের হয়ে আসলাম। আনন্দ নিয়ে হাটছিলাম। অতি আনন্দ দুঃখ বয়ে আনে সেটা একটূ পরেই টের পাবো ভাবি নি। তিন জন যাওয়ার কথা ছিল। প্রথম বন্ধুর বাড়ির কাছে গেলাম। আশা করছিলাম, এখনি মুসল্লিরা বেরিয়ে আসবে। কই কেও আসেনা ! রাস্তায় অনেক কুকুর শুয়ে বসে আছে, কিছুক্ষন পর পর ডাক ছাড়ে, আমাকে ঘিরে ঘুরে। মনে মনে ভাবলাম, আজান দিবে একটু পরেই, ভয় কি, কুকুর গুইলোর দিকে তাচ্ছিল্য ভরে তাকালাম, ব্যাটারা ভয় দেখায়। প্রথম বন্ধুর দরজায় কড়া নেড়ে সায় পেলাম না। ব্যাটা ঘুমের ভান করে পরে আছে বুঝতে পেরে , রাগে হাটা দিলাম ২য় বন্ধুর বাড়ি্র দিকে।মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেলাম গেট তালা মারা। কিরে কই সবাই। তখন ঘড়ি পরতাম না, আর এসময়ের ছেলে মেয়েদের মত ক্লাস নাইন এ আমাদের মোবাইল ও ছিল না। ২য় বন্ধুর বাড়ি একটু দূরেই ছিল। সুজয়দের বাড়ি। হিন্দু পাড়ার ভিতর। আমি হাটা দিলাম,কুকুর গুলো ও পেছন পেছন আসতে লাগলো । কালিপুর গ্রামে,হরিতকি গাছ ছিল একটা , এখন ও আছে আগের জায়গায়। সেখান থেকেই ভিতরে ঢুকে যেতে হয়। ঢুকবো নাকি বাড়ি ফিরে যাবো চিন্তা করতে করতে, হাটা দিলাম সুজয় দের বাড়ির দিকে। আরেকটু পরেই তো আজান দিবে। ভাবনাটা মনে সাহস যোগাচ্ছিল। সামান্য হেটে মাঠে নেমে পরলাম। হিন্দুদের চিতা থাকে এর পাশে দিয়েই যাচ্ছিলাম। অন্য পথ চিনতাম না। রাতের বেলা, হিন্দুদের চিতার পাশে দিয়ে হাটতে ভয় লাগছেনা। কারন একটু পরেই আজান দিবে, আজান দিলেই সব ভয় শেষ,তারপর মানিক পাঠান

 

 

সুজয় দের বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়ালাম। সুজয় এর নাম ধরে কয়েকবার ডাকলাম । সাড়া নেই। এই বার ভয় লাগছিলো। আজানো দেয় না। কেও উঠেও না। আসলে এখন কয়টা বাজে। নিজেকে দুইটা লাথি মারতে ইচ্ছে হলো টাইম দেখে বের হইনি বলে। আর তখন গ্রামে ডাকাতের প্রাদূর্ভাব খুব বেশী। সহজে এত রাতে কেও দরজা খুলবেনা, যদি আমি ভুল সময়ে এসে থাকি।এতক্ষন মনে আননন্দ ছিল,তাই ভয় করেনাই। এখন অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে একজন বৃদ্ধা জানাল খুললো।  আমার দিকে কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। জিজ্ঞেস করলাম সুজয় আছে? বলল “ আছে, ঘুম, এতো রাতে কি কাজে আসছো?” তখন আমার মনে যে সন্দেহ ছিল তা ডানা মেললো। জিজ্ঞেস করলাম”কয়টা বাজে?” আসা করলাম চারটা ত্রিশ বা ৫ টা বলবে। কিন্তু যখন বুড়ি বলল এখন তিন টা বাজে আর বলেই দড়াম করে জানাল লাগিয়ে দিলো, তখনসেই রাতের আধারে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুবি অসহায় লাগলো। যতটুক পথ এসেছি সেই পথে ফিরে যাবো এখন ভাবতেই পারছিনা। জায়গায় দাড়িয়ে রইলাম ঠাই। কি করব! এতটা পথ দৌড়াইলেও তো ভয়ে হার্ট অ্যাটাক না আসলেও অন্ধকারে কোথাও বাড়ি খেয়ে মরবো। একেতো হিন্দুদের চিতা,   তার উপর চার দিকে গাছে ভরা। এই প্রথম অসময়ে প্রকৃতিতে নিজের উপস্থিতিটা ভালো ঠেকলোনা। সামনে ,পেছনে, ডানে , বামে যে দিকেই তাকাই ভয় লাগে। সেসময় ভাবছিলাম,যদি এটা দুঃসপ্ন হত। কিন্তু বাস্তবকে দূঃসপ্ন বলা যায় না। বাস্তব দুঃসপ্ন এর চাইতে খারাপ। যে পথে এসে ছিলাম সে পথ ছাড়া গতি নাই। তাঁর উপর আবার সুজয় কে ডাকলে বুড়ি ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করলে এমনেই বিপদে পড়বো। পদে পদে বিপদ বুঝে আমি ফেলে আসা পথ ধরার সিদ্ধান্ত নিলাম। আল্লার নাম নিয়ে হাটা দিলাম। খালি ভয় হচ্ছিল লম্বা চুলের মুখ ঢাকা কোন মেয়ে চিতা থেকে উঠে এসে বলবে, এই কই যাস? এত রাতে এইখানে কি? শুনেছিলাম জীনরা অনেক রূপ ধরতে পারে। সে ভয় টাও নিজেকে পেয়ে বসেছিল। চিতার পাশ দিয়ে যখন হাটছিলাম । রাস্তায় উঠে সোজা হাটা লাগবে। তারপর হরিতকি গাছ টা। কিন্তু রাস্তায় উঠার মুখেই দেখলাম একটা অচেনা কুকুর। অচেনা একারনেই, কারন গ্রামে নিদৃষ্টকিছু কুকুর থাকে যাদের বেশ ভালই চিনা যায়। এক এক পাড়য় এক এক দল কুকুরের রাজ চলে। এই পাড়ায় বা গ্রামাএ এরকম সাদা কুকুএর এর এর আগে দেখিনাই। আচরন ও অদ্ভুত। রাস্তা  আটকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দোয়া দোরুদ পড়ে হাটা দিলাম। আমি যত পা আগাই কুকুর টা ঠিক তত পা পিছায়, এভাবেই চলতে লাগলাম। এক পর্যায়ে কুকুরটা আমাকে ঘিরে ঘুরতে লাগলো। চোখের দৃষ্টীটা ও কেমনঅদ্ভুত, যেন আমি এই সময় এখানে এসে কারো ক্ষতি করে ফেলেছি। আমি হাটছি কুকুরটা আমাকে ঘিরে হাটছে। হরিতকি গাছের কাছে এসে দেখলাম মসজিদের ওখানের কুকুর গুলো সেখানেই বসে আছে। তাদের সাম্রাজ্য সম্ভবত সেখানেই শেষ। কুকুর গুলো সাদা কুকুর টা কে দেখে তারস্বরে চিৎকার দিল। সাদা কুকুরটা পাশের নিচু জমিতে লাফ দিল দেখলাম, কিন্তু নিচে পড়েই যেনো হাওয়া। ঝোপ ঝাড় নেই, কুকুরটা দৌড় লাগালেও দেখতাম। কিন্তু যেনো ককুকুরটা নাই হয়ে গেলো। বড় রাস্তায় উঠে , এক কদম দু কদম হাটলাওম, এর পর আর পারলাম না,মনের ভয়, সংশয় ফেলে, ঝেড়ে দৌড় লাগালাম, পিছনে মনে হচ্ছিল সাদা কুকুর টা নিঃশব্দে আসছে, অথবা বাড়ির গেইট এ হয়ত দেখব পথ আটকিয়ে দাড়িইয়ে আছে। কিছুই হলোনা। এক দৌড়ে বাড়ি, তারপর দরজায়, জোরে জোরে কিল ঘুসি মেরে সবাইকে ডেকে তুল লাম। দরজা খোলাই ছিল, কীন্তু খোলার চিন্তা ভয়ে মাথায় আসে নাই। দরজা খোলার পর আম্মু আর আব্বু কে দেখে , আর বোধয় ঘরের পরিচিত পরিবশে ফিরতে পেরে খুশিতেই কেদে দিলাম।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন