পুতুলের সংসার

Please log in or register to like posts.
পোস্ট
পুতুলে_সংসার, জীবন, জীবনী, দেশ, bio, biography

বিষয়টা অনেকদিন ধরেই হবে হবে করেও হয়ে উঠছিলোনা। অবশেষে রফিউল বারির ভাগ্যাকাশে এক টুকরো  চাঁদের  উদয় হলো। এর আগেও কম কথা হয়নি, কিছু কিছু সম্পর্ক ঐ কথা পর্যন্ত গিয়েই থেমেছে। এবার রফিউল বারির সীদ্ধান্ত থেকে তাঁকে কেউ সরাতে পারেনি। মল্লিকার সাথে তাঁর যুগল সম্পর্কের শুরু হলো, দাম্পত্ত জীবনের সূচনা হলো হঠাৎ করেই। যেন কাঠফাটা রোদে এক পশলা  বৃষ্টি। 

 

রফিউলের দাম্পত্তজীবনের দশম দিন চলছে। তাঁর অর্ধাঙ্গীনীর নাম মল্লিকা নয় মোটেও ্র রফিউল তাকে মল্লিকা বলে ডাকে । নাম টাও সম্পর্কের মতই হঠাৎ পাওয়া। একটা ক্ষুদ্র ঘটনার কারনে মেয়েটাকে রফিউল মল্লিকা বলেই ডাকে।  

 

মল্লিকার বয়সের তুলোনায় দায়িত্ব অনেক। যে সদ্য কৈশোর পার হওয়া মেয়ে বাস্তবাতার দিবালোকে মাত্রই পা রেখেছে  তাঁর কাছে বিয়ে নামক বিষয়টা অপ্রত্যাশিত ছিলো। এ যেন পুতুল খেলা করতে করতে হঠাৎ বুঝলো আজ পুতুলের নয় তাঁর বিয়ে। সে মেয়ে সংসারের যাতনা আর চাপ কি বুঝবে, যার মন এখনো পরে আছে  বাড়ীর পুকুর ঘাটে, পুকুর ঘাটের পাশেই ছায়া  দেওয়া গাছেগুলোতে। মল্লিকা বিয়ের দিন বারবার চিন্তা করছিলো তাঁর বাড়ির চিলেকোঠার কবুতর গুলোর কথা।কবুতর- স্বপ্ন যার মনে -তাঁর মস্তকে হঠাৎ করেই বিয়ের আসর চেপে বসলো। তাঁর পরিচিত পৃথিবী তাঁর কাছে অচেনা লাগে। যে মেয়ে পুতুলের বিয়ে দিত, আর ভাবত তাঁর একদিন পুতুল এর মতই সুন্দর গোছানো, মজার এক সংসার হবে সে আসল পৃথিবীর বিয়ের কিছুই তখনো জানেনা।   

 

প্রথম যেদিন মল্লিকা রফিউলের বাড়িতে আসে, সে তখনো বুঝে উঠতে পারেনি তাঁর উপর অর্পিত হতে যাচ্ছে কঠিন দায়িত্ব । মায়ের বড় আদরের মেয়ে মল্লিকা।  মার কাছে আদর-শাসন সবি পেয়েছে।  সংসারে এসেই রফিউলের বড় বোনের খোটাটা সে ঠিক ধরতে পারলোনা।  রফিউলের বড়  ভাই এর বৌ  শারমিন কাকে যেন নিচু স্বরে বলছিলো” আমাদের সাথে তাদের যায়না বুঝলেন,স্ট্যাটাসে অনেক তফাত আছে।” 

পাশ থেকে কে জানি বলে উঠলো “কেন, কি হলো?”

ঠিক এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই বুঝি ছিলেন শারমিন। কুচক্রির মত মাথা নিচু করে কিন্তু মল্লিকা শুনতে পায় মত করে বললেন” সেগুনের নাম করে ফার্নিচারে পচা  কাঠ ধরিয়ে দিয়েছে, আর তাঁর বাবা-মার আচরন ভালোনা, ছোটলোক বুঝলেন?”

মল্লিকা সব না বুঝলেও ছোট লোক কে ঠিক বুঝে ,নতুন বৌ  ঘোমটার  ভেতর নিজেকে আরো গুটিয়ে ফেলে। তাঁর বাবাই তাঁর বিয়ের সময় নিজের যত ফিক্সড ডিপোজিট ছিলো সব ভেঙ্গে ফেলে। তাঁর বাবা তাঁর কাছে অনেক কিছু, তাদের নিয়ে কিছু বললে তাঁর রাগে গা কাপে। প্রতিবাদ করতে না পেরে মন কাঁদে । মল্লিকার কোমল গাল বেয়ে দুফোটা অশ্রু  নেমে আসতে চায়।চোখ ছল ছল করে । 

 

হঠাৎ তাই দেখে বুঝি শারমিন বলে উঠে ” ওমা বৌ  এর বোধয় সমস্যা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, আমরা বোধয় তাঁর অসুবিধা করছি, হুহ চলো যাই” ।

মল্লিকার  মুখের ভাষা অশ্রু হয়ে নেমে আসে। সব-অপরিচিতের ভিড়ে বাবা-মার চেহারা খুজে সে, কই পায় না তো! 

মল্লিকার ইচ্ছে করে বলতে” আমি বাড়ি যাবো, মায়ের কাছে যাবো। কই বলতে পারেনাত! এক অদৃশ্য হাত যেন তাঁর গলায় চেপে বসছে। 

 

মল্লিকা এত টুকু বুঝতে পারছে আবেগের কথা বলার অধিকার সে  এই বাড়িতে এসেই হারিয়েছে। এখন মায়ের কাছে যেতেও অন্যের আদেশের অপেক্ষা করতে হবে। নিজেক খাচায় বন্দী পাখির মত মনে হয় তাঁর। 

এর মাঝে রফিউল আর তাঁর মা-ই শুধু মল্লিকাকে আপন করে নিয়েছে। রফিউলের মায়ের বয়স হয়েছে ,বলতে গেলে শারমিন ই বাড়ির হর্তাকর্তা। মল্লিকার  অজস্র  দোষ  চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় শারমিন। তাঁর নিজের এত দোষ মল্লিকা আগে জানতনা! মল্লিকা সব মেনে নিয়েও মেনে নিতে পারছিলোনা নিজের বাবা-মা পরিবার নিয়ে ফিসফাস। 

                                               ***************************************************

জিহাদ তাঁর মায়ের কাছে প্রথম শুনলো শিউলি  মেয়েটার কথা। ইন্টারে থাকতেই শিউলিবিয়ে হয় তাদের দূর-সম্পরকের পরিজন রফিউল বারির সাথে।  বিয়ের সাত দিনের মাথায় তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো রফিউল আর তাঁর বৌ। জিহাদের ইন্টার চলছে। এই বয়সে একজন সংসার করছে আর জিহাদ কিনা সবার কাছে এখনো ছোট্ট ছেলে। জিহাদের মেয়েটাকে হিংসা হয়। জিহাদ মেহেমান এর সাথে দেখা না করেই ইচ্ছে করেই বের হয়ে যায়।

                                                 *************************************************** 

কিছুদিন পর জিহাদ শুনলো শিউলি মেয়েটা আইসিউতে । জিহাদ হিসেব মেলাতে পারেনা।  তাঁর মায়ের সাথে শিউলি মেয়েটার বেশ ভাব জমেছিলো। মেয়েটা  প্রায়-ই বলত শশুর বাড়ি আসার পর থেকে এই একজন কে খুব আপন করে পেয়েছে। 

 

মায়ের কাছ থেকেই জিহাদ সব শুনত । কিভাবে একটা সদ্য কৈশোর পার হওয়া মেয়ে সংসারের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে  ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।  নিজের বয়সি বলেই কিনা কে জানে জিহাদের মনে ব্যাপারটা গভীর দাগ কেটে যায়।  তাঁর মার কাছে জিহাদ শিউলিউ সম্পর্কে আরো জিঘগেস করে। 

তাঁর মা তাঁকে জানায়,” মেয়েটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, কাউকে কিছু বলতে ও পারছেনা, শারমিনহ নিজের বড়ত্ব প্রমান করছে। আর শিউলিকে সহস্র উপায়ে মানসিক নির্যাতন করছে। মেয়েটার যদি কিছু হয় শারমিনকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবোনা”। 

জিহাদ রেগে যায়,”কেন কেউ কিছু করতে পারবেনা, একজন মহিলা চাইলেই কাউকে বিনা দোষে দিনের পর দিন কিভাবে মিথ্যা অপবাদ দেয়?” । 

তাঁর মা নত মস্তকে বলেছিলো,” আমাদের সমাজে মেয়েরাই মেয়েদের যম হয়,অসুখে যতটা না মরে  বিয়ের পর শশুর বাড়ির কিছু মহিলার মানসিক নির্যাতনে এর চাইতে বেশি মরে”।  

                                                      ***********************************************

জিহাদের মা প্রায় হাসপাতালে যেতেন শিউলিকে দেখতে। শিউলির একদিনের জন্য জ্ঞান ফিরেছিলো, সেবার রফিউলের  হাত ধরে সে শুধুই কেঁদেছিল ,মুখে কিছু বলেনি”। সে চোখের অশ্রুতে কি যে বেদনা লুকিয়ে ছিলো! আইসিউতে ভর্তি রফিউলের মল্লিকার চোখের অশ্রুও শারমিনের মন নরম করেতে পারেনা।  শারমিন সেইদিন ও  ইনিয়ে বিনিয়ে মল্লিকার  মা-বাবার দোষ 

  মল্লিকার কানে তোলে। শারমিনের মিষ্টি  কথার ছুরি আর নিজের মেয়ের হাজারো দোষের ফিরিস্তিতে মল্লিকার বাবা-মা বুঝে গিয়েছিলেন মেয়েকে  যমের বাড়ী পাঠিয়েছেন তারা বিয়ের দিন-ই। 

জ্ঞান ফেরার দিন শেষ রাতে জিহাদের মা ছিলো মল্লিকার সাথে । দুচোখে  অশ্রু নিয়ে মল্লিকা শিধু বলেছিল” রফিউলের কোন দোষ নেই,তিন ই কিছুই জানেন না,  কিন্তু ওনার ভাবির বলা প্রতিটা কথা,আমাকে তিলে তিলে মেরে ফেলছে। আমি আমার মা-বাবাকে নিয়ে দেওয়া মিথ্যে অপবাদ আর সইতে পারছিনা খালাম্মা”। জিহাদের  মা মল্লিকাকে বলেছিলো মন শক্ত করতে, নিজেকে অন্যের  নত না হতে। 

                                                        *****************************************

আইসিউতে মল্লিকার ১৩ তম দিন চলছে।  জ্ঞান ফেরার পরদিন মল্লিকা আবারো জ্ঞান হারিয়েছিলো। শারমিন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে চাইছে এ খরচ মেয়ের বাবা মার বহন করা উচিৎ ।  তাদের ডাকাও হলো। তাদের মেয়ে যদি মারা যায়  , তাঁর লাশ টা নিয়ে যাবে তারা, ও বাড়িতে তাদের মেয়ের লাশ ও যে শান্তি পাবেনা!  সত্য চাপা থাকেনা, শারমিনের অকথ্য নির্যাতনের কথা অনেকেই বুঝতে পারে। না হলে নিজের মেয়র লাশ চায় কোন মা ! 

 

কিছুদিন পরের কথা,   এদিন এক কুয়াশচ্ছন্ন ভোর।  ঘুম থেকে  উঠেই জিহাদ এর মন খুশি খুশি লাগে। মল্লিকা কে একেবারে সুস্থ দেখেছে সে, এটা মনে করেই আনন্দিত।   ব্যপারটা যে স্বপ্ন এটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড  লাগলো তাঁর। মাথাটা পরিস্কার হয়ে যেতেই সে মায়ের কাছে যায়।  সে মাকে বলে ,”দেখো মা, মল্লিকা বাঁচবে ” ।    

-তাই যেন হয়। 

জিহাদের মা সেদিন দুপুরেই মল্লিকাকে দেখতে গেলো। বিকেলে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলো তাঁর মা। জিহাদের মনের ভেতর থেকে কু ডেকে উঠলো। 

-মা, মল্লিকা কেমন আছে?

তাঁর মা হুহু করে কেঁদে উঠে, –“মল্লিকা বেঁচে গেছে,মেয়েটা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে”। 

অজান্তেই জিহাদের দুচোখ ভিজে যায়। শারমিনের কথা মনে পড়কে হাত মুঠোবদ্ধ হয়, গায়ের কেশ দাঁড়িয়ে যায়”। জিহাদের মা আবার কেঁদে কেঁদে বলে ডাক্তার রা বলেছিলো কোন কারন ছাড়া এমন হওয়ার কথা নয়। ভর্তির পরেই ডাক্তারের এই কথায়  শারমিন বলেছিলো,” শিউলি তো আমদের সাথে সুখেই ছিলো !” । 

জিহাদ দাঁতে দাত চেপে জিজ্ঞেস করে মেয়ের মা আসেনি? 

-এসেছিলো, মল্লিকাকে নিয়ে যাওয়ার সময়  শারমিন কে বলে গেছে , দেশের-দশের আদালতে হয়ত শাস্তি হবেনা, কিন্তু তাঁর মেয়ের মৃত্যুর জন্য শারমিন সারাজীবন দ্বায়ি  থাকবে। 

জিহাদের মন উথাল-পাতাল করে উঠে।  এভাবে কত শিউলি কত  রফিউলের মল্লিকা এদেশে মারা যায়।  এ খুনের বিচার কই। শারমিনের মত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, কেউ টের পায়না সদ্য কৈশোর পার হওয়া মেয়েটি কেনো মারা গেলো। জিহাদের খুব মন খারাপ হয়ে যায়।  মল্লিকা তাঁর সমান বয়সের বলেই হয়ত তাঁর বেশি খারাপ লাগছে। 

জিহাদ মনে করেছিলো সুস্থ মল্লিকাকে দেখতে যাবে। তার কথা মায়ের মুখে কত শুনেছে বলবে।  কিন্তু রফিউলের মল্লিকা চলে গেলো।  পুতুলের মত সংসারের   স্বপ্ন  শকুনের  চোখের দৃষ্টিতে ছাই হলো!  কেন জানি দুঃখ  ,কষ্টে জিহাদের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেলো। 

 

মল্লিকার সাথে দেখা হলোনা।

 

                                                                     ************************************

সে ঘটনার পর পাঁচ বছর কেটে গেছে।  রফিউল দু বছরের শোক পালন শেষে দিব্য বিয়েথা করে দুই বাচ্চার গর্বিত বাবা এখন।  মল্লিকার কথা ধীরে ধীরে সবাই ভুলে যাচ্ছে। এটাই হয়ত পৃথিবী,এটাই জীবন। 

 

তবুও এখনো একজনের  মনে  কুয়াশাচ্ছন্ন কোন ভোরে, মল্লিকার ঘোমটা পরা অবয়ব ভেসে উঠে। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়, ভারি করে তোলে পরিবেশ।  

 

হাজারো মল্লিকা পুতুলের মত সংসারেরে স্বপ্ন দেখে । শিউলির মত হাজারো  মল্লিকার সংসার জীবন পুতুলের মত গোছানো হয়না!   হয়ে ওঠেনা!  বা হতে দেয়না! 

 

এই লেখকের আরো লেখনী পড়তে ক্লিক করুন  

 এলন মাস্ক : একজন ব্যতিক্রমধর্মী এবং সফল উদ্যোক্তার গল্প

                                                              উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস এর জীবনী

একজন গরীব রাজার জীবনের চাওয়া-পাওয়ার গল্প

বেগম রোকেয়া:নারী জাগরনের অগ্রদূত

জীবন এর মোহ : আসলের মোড়কে নকল জীবন

সাকিব আল হাসান : বাংলদেশের ক্রিকেট কে বদলে দেওয়া নায়কের জীবনের জানা -অজানা তথ্য

মুনীর চৌধুরী – একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী , কারাগারের রুদ্ধ দুয়ার যার প্রতিবাদি কন্ঠ কে দমাতে পারেনি

ভয়াল শীতের রাত

নিশির ডাক

আমার জন্ম পরিচয়

হারানো শৈশব

যৌবন : মানুষের জীবনের স্বর্ণযুগ

আমার জীবনী

আবদুল্লাহ আল মুতী – কঠিন বিজ্ঞান কে শিশুদের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন যিনি

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জীবনী

নিশির ডাক

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া