পেশাদার জীবন!

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

হার্ট এটকের পর ডাক্তারের পরামর্শে মেডিকেল কলেজের সি. সি. ইউতে ভর্তি করালাম বাবাকে। কয়েকঘন্টা পর বাবাকে পাশের রুমে ট্রান্সফার করে দেয়া হল – তাঁর অবস্থা তেমন গুরুতর নয়। কিন্তু সি সি ইউতে এই কয় ঘন্টায় যা দেখলাম তাকেই হয়ত বলে যমে মানুষে টানাটানি। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে। বেশিরভাগই অত্যন্ত সংকটাপন্ন। প্রতিটি স্ট্রেচার ঢোকার সাথে সাথে রোগীর কাছে দৌড়ে যাচ্ছেন ডাক্তার, নার্স। কখনো কখনো একেবারে মৃতপ্রায় মানুষ বেঁচে উঠছে। কাউকে কাউকে বাঁচানো যাচ্ছে না। ধনী গরীব সবার জন্য একই মমতায় কাজ করছেন ডাক্তাররা। ধারণ ক্ষমতার দিগুন রোগি সি. সি. ইউতে। ডাক্তারের সংখ্যা কিন্তু বেশি নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষ বাঁচানোর অসম্ভব এক যুদ্ধ। নিশ্চল মৃতপ্রায় মানুষগুলো যখন হাঁসিমুখে চোখ খুলত মনে হত সৃষ্টিকর্তা ডাক্তারের অবয়বে ফেরেশতা পাঠিয়েছেন।

এক রাতে বাবা বুকে ব্যাথা অনূভব করলেন। নার্সকে ডাকলাম। বললেন জীভের নিচে নাইট্রোমিন্ট স্প্রে দিতে। দিলাম। ব্যাথা কমল না। আবার ডাকলাম নার্সকে। আবার বললেন স্প্রে করতে। লাভ হলনা। আবার ডাকতে ধমক খেলাম। তারপরও অনুরোধ করলাম ডাক্তারকে ডাকতে। ধমকে বললেন ডাক্তার ডাকার মত কিছু হয়নি। অসম্ভব রাগ লাগল। জোড় করে দরজা খুলে ঢুকে গেলাম ডক্টরস রুমে। ভেবেছিলাম আরেকটি ধমক খাব। কিন্তু না ডাক্তার মনযোগ দিয়ে কথা শুনলেন, দৌড়ে আসলেন। ক্ষমা চাইলেন নার্সের পন্ডিতির জন্য। বললেন বাবার বুকে ব্যাথা হার্টের কারণে নয়। এজমার কারনে। নেবুলাইজ করতে হবে। আমার বাবা নেবুলাইজারে অভ্যস্ত নয়। সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করলেন নিয়ম কানুন। দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন সবকিছু ঠিকমত চলছে কিনা।

এই চমতকার ডাক্তার মানুষটির সাথে কথা বলে জানতে পারলাম তিনি এবং আরো যে কয়জন এখন ডিউটিতে আছেন তাঁরা আমরই বয়েসি। মাস্টার্স শেষ করে বেশ কয়েকবছর যাবত আয় উপার্য়ন করছি আমি। আর এরা এখনও পড়ছে। এম.বি.বি. এস শেষ করে এখন হ্রদরোগে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে বঙবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরাশুনার অংশ কিছুদিন এখানে কাজ। আবার ফিরে যেতে হবে। আরো অনেক পড়াশুনা বাকি। কথায় কথায় জানলাম তাদের যে বেতন দেয়া হয় তা আমার মত এভারেজ শিক্ষার্থীদের আয়ের অনেক কম। পড়াশুনা পুরোপুরি শেষ না করে চেম্বার করাও সম্ভব নয়।

আমার চেয়ে অনেক মেধাবীরা চান্স পায় মেডিকেল কলেজে। উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে তাদের পূরো মাত্রায় কর্মজীবনে প্রবেশ করতে সময় লাগে অনেক বেশী। তাছাড়া মেডিকেল পড়াশুনার চাপ্ও ভয়াবহ। পরীক্ষায় পাশ করা তো আরো কঠিন। আমরা যখন নিজেদের আয় উপার্যনের টাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছি এখানে সেখানে, আমাদের ডাক্তার বন্ধুরা তখন বঙবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের ভাঙা চকিতে শুয়ে ছাড়পোকা আর মশার কামড় খেতে খেতে নাক মুখ গুঁজে পড়ছে গাদা গাদ সব বই। এ ভয়ন্কর পথ পাড়ি দিয়ে যারা ডাক্তার হন তাদের কসাই বলতে আমি নারাজ। হাজার বারোশ টাকা নেয়ার অধিকার তাঁরা পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে অর্জন করে নিয়েছেন।

বছর খানেক পর বাবা আবার অসুস্থ। কিছু খেতে পারছেন না। না খেয়ে দূর্বল হয়ে গেছেন। হাঁটতেও কষ্ট হয়। আমার খালাত ভাই ডাক্তার। একটি ডায়াগনষ্টিক ল্যাবের ব্যাবস্থাপনার সাথে জড়িত। নিজেই করেন আল্ট্রাসনোগ্রাফি। দেখলেন বাবার পিত্তথলিতে কিছু পাথর দেখা যাচ্ছে। বললেন তেমন খারাপ কিছু মনে হচ্ছে না তবু একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করতে বললেন। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বললেন, তাঁরও তেমন সিরিয়াস কিছু মনে হচ্ছে না, দূ’দিনের ওষুধ দিলেন। বললেন না সারলে এন্ডোসকপি করতে। তবে সাবধান করে দিলেন, যেহেতু একবার হার্ট এটাক হয়েছে তাই এন্ডোসকপি করার আগে আমরা যেন অবশ্যই একজন কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ নিই। জানতে চাইলাম আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে যে পিত্তথলির পাথরগুলো দেখা যাচ্ছে তাতে ভয়ের কিছু আছে কি না। বললেন তাঁর অভিজ্ঞতায় এগুলোকে তেমন বিপদজনক মনে হচ্ছেনা, তবে সার্জারীর কারো সাথে দেখা করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। 

মেডিসিনের ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল সার্জারীর একজন সহযোগি অধ্যাপকের চেম্বার। গেলাম তাঁর চেম্বারে। পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বললেন “রোগীর অবস্থা অত্যন্ত সিরিয়াস। আপনারা এখনই এন্ডসকপি করে আনুন। তারপর বলছি কি করতে হবে।”। বললাম মেডিসিনের ডাক্তার কার্ডিওলজিস্টের সাথে পরামর্শ করে এন্ডসকপি করতে বলেছে। বললেন তিনি যে ল্যাবে আর যে ডাক্তারকে দিয়ে এন্ডসকপি করাবেন তাতে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ দরকার নেই। বলে দিলেন ল্যাবে গিয়ে, মেডিসিনের ডাক্তার নয়, তাঁর চিঠিটি দেখাতে। ওনার প্রেসকিপশন ল্যাবে দেখানোর মাজেজা তখন বুঝিনি।

এন্ডসকপি রিপোর্ট নিয়ে আবার সার্জারীর ডাক্তারের চেম্বারে। রিডিং গ্লাস নাকের ডগায় লাগিয়ে মনযোগ দিয়ে রিপোর্ট পড়তে পড়তে জানালেন, রোগির অবস্থা যতটা সিরিয়াস ভেবেছিলেন তারচেয়ে অনেক খারাপ। আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে করতে হবে অপারেশন। এই জটিল অপারেশনের প্রয়োজনিয় যন্ত্রপাতি একটি ক্লিনিকেই আছে, অতএব সেখানেই যেতে হবে। বিশাল খরচ সম্মন্ধেও জানালেন ডাক্তার। বললেন পরদিন সকাল আটটায় ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার সময়ই পরিশোধ করতে হবে পুরো টাকা। দূ:সংবাদটা সবাইকে জানালাম। আর্থিক সাহায্যও চাইলাম।

টেনশন নিয়ে যখন বাড়ির পথ ধরছি তখন ফোন করলেন আমার খালাত ভাই। যিনি বাবার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করেছিলেন। তাঁকে পুরো ঘটনা বললাম। বড় ডাক্তারের সাথে দ্বিমত করতে ইতস্তত করলেন। বললেন অপারেশন হয়ত করতে হবে তবে অবস্থা এত খারাপ হওয়ার কথা নয় যে কালকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। পরামর্শ দিলেন আরেকজন সার্জারী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়ার। মনে পড়ল আমার আরেক আত্মিয় তখন মিডফোর্ডে সার্জারির অধ্যাপক। ফোনে জানালাম তাঁকে, রিপোর্টগুলো পড়ে শোনালাম। বললেন অবস্থা তেমন গুরুতর মনে হচ্ছে না। আরেকজন সার্জারী বিশেষজ্ঞের ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বললেন, তিনি নিজেও ফোনে ওই ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিলেন।

সেই বিকেল থেকে পাঁচলাইশ গোলপাহাড় এলাকায় ডাক্তার চেম্বার আর ল্যাবে ঘুরছি। এখন প্রায় মাঝ রাত। দ্বিতীয় সার্জারী অধ্যাপকের চেম্বারে গেলাম। রিপোর্ট পড়ে হাসলেন। বললেন আল্ট্রাসনোগ্রাফি করলে যে কারো গলব্লাডারে স্টোন দেখা যেতে পারে, সমস্যা না করলে অপারেশন দরকার নেই। বললাম এন্ডসকপি রিপোর্টটা একটু ভালমত দেখতে। ওতেই গলব্লাডারে বেশি সমস্যা পেয়েছিলেন আগের ডাক্তার। হেসে জানালেন এন্ডসকপিতে গলব্লাডার দেখা যায় না, স্টমাক দেখা যায়। ওই রিপোর্টের সাথে গলব্লাডার অপারেশনের কোন সম্পর্ক নেই। বললেন রিপোর্টটি নিয়ে আবার মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে। সামান্য কাজ করেছেন বলে ফিসও নিলেন না।

মাঝ রাত পেরোতে আবার মেডিসিন বিশেষজ্ঞের চেম্বারে। এন্ডসকপি রিপোর্ট দেখে কিছু ওষুধ দিলেন, দু‘দিন পর বাবা সুস্থ। ওই অপারেশনের আর কোনদিন প্রয়োজন হয়নি।

দূটো ঘটনায় অনেকগুলো ডাক্তারের কাছাকাছি আশার সূযোগ হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনায় এক সন্ধায়ই কথা হয়েছে পাঁচ ছয়জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে। একজন ছাড়া জ্ঞানে, চিন্তায়, মানবিকতায় সবাই অসাধারণ। দূটো ঘটনায় শুধু একজন অসাধু ডাক্তার পেয়েছি। তবে দূ:খ একটাই, অন্য দূজন সার্জারী বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ না করলে হয়ত, টাকার লোভে প্রথমজন আমার বাবার অঙ্গহানি করে ছাড়ত। আচ্ছা পরের সার্জারী বিশেষজ্ঞওতো বলতে পারতেন অপারেশনটা তাঁকে দিয়ে করালে আরো ভাল হবে। তা না করে তিনি তাঁর নির্ধারিত ফি ও নিলেন না।

আসুন আমরা টাকার লোভে অঙ্গহানী করতে চাওয়া অমানুষটাকেই কসাই ডাকি, যমের হাত থেকে জীবন কেড়ে আনা যোদ্ধাদের নয়।

বিএমএ একটি অসাধারণ সংগঠন। ডাক্তারি পেশার মানুষগুলোকে রক্ষা করার জন্য লড়াই তাদের। মাঝে মাঝে মনে হয়, অন্য সব পেশাজিবিদের যদি এরকম সংগঠন থাকত তবে দেশের সব পেশাজীবি নিরাপদ বোধ করত। আশা করি মানুষ বাঁচানোর এ মহান পেশায় যে দূ‘একজন অসাধু লোক ঢুকে গেছে তাদের থেকে এ পেশাকে মুক্ত করবে তারা। কি ভালই না হত, যদি গুটিকয় অসাধু ডাক্তারদের চিকিতসা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিত এই সংগঠনটি।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া