স্বর্ণালী অতীত

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

 

 হালুয়া- রুটি, আতশবাজি আর রাতজাগা ইবাদতের এই উৎসবকে ধরা হত রমজানের বার্তাবহ। বাবারা রোজার বাজারে ব্যাস্ত হতেন, মা‘রা সাহরী ইফতারের ভিন্ন ধারার রান্নার মশলাপাতি সাজাতেন। তাকের উপর থেকে নামানো হত বড় বড় ডেকচি হাঁড়ি। গৃহস্থবাড়িতে কিছু বেশি ইফতারের আয়োজন হত। রমজানে কাউকে ফেরানো যাবে না যে। তারপরও দু’এক লোকমা বেঁচে গেলে মসজিদে যাবে। ক্লান্ত পথিক পেট ভরে খাবে।

আমরা ছোটরা মহাখুশি। পুরো একমাস স্কুল বন্ধ। পাড়ার সবাই একসাথে মসজিদে যাওয়া, হুজুরের কাছে কোরআন পড়ায় একটু বেশি সময় দেয়া, সাহরি খেয়ে ঘুমের সাথে যুদ্ধ – ফজরের নামাজ জামাতে পড়তে হবে যে। হোকনা একটু দেড়িতে ঘুম থেকে ওঠা, হোকনা রোজার একবেলা ঘুমিয়ে কাটানো ।

পিপাসা পায় বলে ফুটবল ক্রিকেট বন্ধ। খেলার বাজেট তখন কেরমে। ফাঁকে ফাঁকে হোমওয়ার্ক আর গল্পের বই। সেযুগে গল্পের বই না পড়ার জন্য মা বাবাকে বাচ্চাদের পিছু ধাওয়া করতে হত। রবীন্দ্র – নজরুল থেকে টলস্টয় সব কিছু পড়ে ফেলত স্কুলছাত্ররা। আজকালের মত গুগল চেপে বই পাওয়া যেত না। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে রীতিমত চাঁদা তুলে বই কেনা হত। লটারী করতে হত কে আগে পড়বে।

আসরের নামাজের পর শুরু হত ইফতারের প্রস্তুতি। বাড়ি বাড়ি আর মসজিদে গিয়ে ইফতার দিয়ে আসার দায়িত্বটা পেতাম আমরা। মাগরিবের কিছূ আগে টেবিল সাজানো, অধীর হয়ে আজানের অপেক্ষা। ইফতারের কিছু পরেই তারাবি। খতম তারাবী কোন অবস্থাতেই বাদ দেয়া যাবে না। একূশ রোজায় তারাবি শেষে তবুরুক হাতে বাড়ি ফেরা, বিশ্বজয়ের আনন্দ।

ঈদে নতুন কাপড়ের প্রচলন তখনো ছিল। আমাদের শহরে মার্কেট বলতে বিপনিবিতান আর রিয়াজুদ্দিন বাজার। জিইসি প্রবর্তক তখনো চট্টগ্রামের প্রাণ হয়ে ওঠেনি। কোন এক দিন ঘন্টা দুয়েকের জন্য মার্কেটে গিয়ে পুরো পরিবারের ঈদের বাজার হয়ে যেত। রোজার মাসে রান্না বান্না, নামাজ রোজার অবসরে মা বোনরা কোরআন খতম দিতেন। হিন্দি চ্যানেল দেখে ঈদ ফ্যাসন তখনো শুরু হয়নি।

আস্তে আস্তে দিন বদলাতে শুরু করল। দূয়েকটি স্কুল রোজায় খোলা রাখা শুরু করল। যে মা’রা ছোট্ট ছেলে মেয়ে রোজা রাখলে ইফতারে দুয়েকটি আইটেম বেশি করতেন, তাঁরা বাচ্চাদের রোজা রাখতে বারণ করতে লাগলেন। সকাল আটটায় স্কুল, সাহরিতে উঠলে ভোরে উঠবে কিভাবে। তাছাড়া ক্ষুধার্থ পেটে ক্লাসের জটিল বিষয় বুঝবে বা কিভাবে। তারাবি গেল হোমওয়ার্কের চাপে। কোন কোন স্কুল বোঝাল তাদের শিক্ষকরা স্বেতচর্ম সভ্য, আর সভ্যরা ছুটি নেয় ডিসেম্বরে ক্রিসমাসে আর জুলাইয়ে, যখন আটলান্টিকের দূপারে শীতের দাপট কমে। এলিট অভিভাবকরা মহাখুশি – নামাজ রোজা তারাবিতো অসভ্য, পুরোন। হালকা ধার্মিকরা বললেন আল্লাহতো রমজান মাসে স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ রাখতে বলেননি। ঘটে এতটুকু বুদ্ধি নেই যে, ভূগোল আর আবহাওয়াভেদে কোন দুটো দিন এক নয়। শীত গ্রীস্মে যে তিনি নিজেই ভিন্ন পরিমাণ জলপান করেন তাও ধারাণার বাইরে।

গরম, লোডশেডিং, আর যানজটের চাপে ইদানিং আবার রমজান মাসে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকছে – রোজাটা মূখ্য নয়। স্কুল না থাকলে কি, কোচিং আর পরীক্ষাতো আছে। পি এস সি, জে এস সি – শত পরীক্ষা। ধর্ম নৈতিকতা চুলোয় যাক, এসব পরীক্ষায় সুসাহিত্যও উপেক্ষিত। সৃজনশীলতার চাপে মুজতবা আলির ‘রসগোল্লা’ রবীন্দ্রনাথের ‘আমার ছেলেবেলা’ বই থেকে গায়েব। সমারসেট মম, মারজোরি কিনান রোলিংসদেরতো ইংরেজি বই থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি বহু আগে। পাছে ‘গিফট অব দা মেজাই’ পরে কেউ ধার্মিক হয়ে যায়, হোক সে খ্রৃষ্টধর্ম।

দশ এগারো বছর বয়সে আমরা নামাজ রোজায় অভস্থ হই। এখন চতূর্থ শ্রেনীর ছাত্ররা সারা বছর চিন্তা করে পঞ্চম শ্রেনীর ভর্তি পরীক্ষার। আর পঞ্চম শ্রেণীতে নির্য়াতন, পি. এস সি।

ধর্ম, নৈতিকতা, সাহিত্য, খেলাধুলা সবকিছু বাদ দিয়ে যে খটোমটো সৃজনশীল জাতি আমরা তৈরি করছি তারা যে তিনযুগ আগে পাশ করা, এখন চল্লিশোর্ধদের তুলনায় অনেক বেশী অপরাধপ্রবণ তা বোঝাতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সহযোগিতার দরকার হবে না।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া