মানুষ বেঁচে থাকে কর্মে,একথার যথার্থতা বারে বারে প্রমান করে দিয়েছেন গুনীরা। সময়কে দাম দিলে সময় সে দামের মূল্য পরিশোধ করে এর সত্যতা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।
মানুষের ইতিহাস মানুষের অমূল্য সম্পদ তাঁর অতীত । সে সম্পদের দাম যে না দেয়, তাঁর অনেক কিছু থেকেও নেই, পাওয়ায় অনেক কিছুই তাঁকে হারাতে হয়। যুগে যুগে আমাদের অতীত কে সংরক্ষন করেছেন আমাদের মাঝে থাকা আমাদেরি মত কিছু মানুষ। আমাদের মতই মানুষ হলেও তাঁদের কর্ম তাঁদের আমাদের থেকে আলাদা করেছে।
আজকে এমনি একজনের জীবন নিয়ে কিছু লিখব। তিনি এক নামে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ( ১১ অক্টোবর ১৮৭১-৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩) নামে পরিচিত। একটা মানুষের জীবন হয়ত গল্প নয়, বা গল্পের চেয়ে বেশি কিছু।কিছু মানুষ আছে যারা নিজের জীবন নয় বরং অন্যের, সমাজের, জীবন ও গল্প তাঁদের সাধনার মধ্যে দিয়ে সংরক্ষন করেন। এমনি একজন মানুষ আবদুল করিম। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানের বরেন্য বাঙ্গালীদের মধ্যে তাঁর নাম আলাদাভাবে উচারিত হয়।
তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে কথাটা শুনতেই ভালো লাগে। নিজের দেশের লোকের প্রতি সবার অজানা টান কাজ করে , আর সেটা যদি হয় নিজের জেলার মানুষ তবে তো কথাই নেই। তাই,এই ক্ষেত্রে আমাকে দোষ দেওয়া যাবেনা নিশ্চই?
আবদুল করিম জন্মগ্রহন করেন ১৮৭১ সালে। চট্টগ্রাম জেলার, পটিয়া উপজেলার সুচক্রদন্ডী গ্রামে। তাঁর প্রাথমিক পড়ালেখার শুরু সেখানেই। ১৮৯৩ সালে এন্ট্রান্স পাশ করেন পটিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে। পেশা হিসেবে আবদুল করিম বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে । চট্টগ্রামের মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনের যাত্রা শুরু করেন ১৮৯৫ সালে। পরবর্তিতে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরে কাজ শুরু করেন। এরপর বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। অবসর নেন ১৯৩৪ সালে।
সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর প্রবেশ বীর চট্টলা সহ সমগ্র বাংলার মানুষের জন্য এক প্রাচুর্যে ভরা ইতিহাস সংগ্রহের পথ রচনা করেন। তিনি আমৃত্যু নিরলসভাবে পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মধ্যযুগের মুসলিম সাহিত্যিকদের কর্ম। তাঁর সংগ্রহ করা পুথির মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম কবিদের রচিত। এসকল পুঁথি সযত্নে রক্ষন করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে। তাঁর সংগ্রহ করা হিন্দু কবিদের পুঁথি রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষনা জাদুঘরে সংরক্ষন করা হয়েছে। (১৯২০-২১) সালে তাঁর লেখা বাংলা পুথির তালিকা ‘বাঙ্গালা প্রাচীন পুথির বিবরন” শিরোনামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিশদ থেকে প্রকাশিত হয়।
আবদুল করিম গ্রন্থ সম্পাদনা ও প্রকাশের কাজ ও করেছিলেন। তাঁর সম্পাদিত ও প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকায় রয়েছে ১১ টি গ্রন্থ। “ইসলামাবাদ গ্রন্থটি” তাঁর লেখা চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপর লেখা বই। তাঁর চেষ্টায় অতিতের এমন ১০০ জন মুসলিম কবি পরিচিতি পায়,যারা এর পূর্বে অজ্ঞাত ছিলো। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সম্পাদিত পুঁথি সমূহের মধ্যে “জ্ঞানসাগর”, “গোরক্ষবিজয়”, “মৃগলব্দ”, “সারদা মুকুল” সর্বজন সমাদৃত। আবদুল করিম ও মুহম্মদ এনামুল হক মিলিত প্রচেষ্টায় “আরাকান রাজসভার বঙ্গালা সাহিত্য” শিরোনামে গ্রন্থ রচনা করেন।
সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য তাঁকে “সাহিত্য সাগর” উপাধি দেওয়া হয় “নদীয়া সাহিত্য সভা থেকে”। এছাড়াও চট্টল ধর্মমন্ডলী তাঁকে “সাহিত্য বিশারদ” খেতাব প্রদান করে। সাহিত্য বিশারদ খেতাবটি তিনি নামের সাথে সংযুক্ত করে ব্যবহার করতেন। চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের গর্ব আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ সালে প্রান ত্যাগ করেন।