অমলের খুব মন খারাপ। কেন যে সে এত গরীব! ইশ তাঁর পকেটে যদি এত এত টাকা থাকত । গাড়ীতে করে ছেলেগুলো কেমন হুশ করে চলে যায়। তখন অমলের ভেতর থেকে ফুস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। তাঁর নিজের প্রতি মায়া হয়। নিজের জন্য মায়া হয়। আজ পকেটে টাকা নেই বলে পাঁচ টাকার ভাড়া বাচিয়ে দুই টাকার বাদাম খেয়ে আর তিন টাকা পরের দিনের জন্য জমা রাখতে হচ্ছে। অমল মাঝে মাঝে হিসেব করে সে গরীব নাকি মধবিত্ত!
অমলেরও ইচ্ছে করে, এসি গাড়িতে বসে, রংবেরং এর নকশাদার জামা পড়ে ঘুরতে। এ জন্মে বোধয় তাঁর ইচ্ছে আর পূরণ হবেনা । আচ্ছা একটা আলাদিনের চেরাগ পেলে কি হত! সে যদি পেত। হয়ত প্রতিটি শিক্ষিত গরীব আলাদিনের চেরাগের স্বপ্ন দেখে। একসময় চিন্তা করে পড়ালেখার একটা সোপান পার হয়ে, ভালো চাকরি করবে, দিন শেষে ঘরে ফিরবে। তাঁর জন্য কেউ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে। কিন্তু পড়ালেখার প্রতিটি ধাপের পর আরেকটি ধাপ এসে হাজির হয়। আর যুগে যুগে পড়ালেখার চাহিদা বদলায়। কোন বিদ্যার দাম বাড়ে,কোন বিদ্যার কমে। মাঝখান থেকে বলির পাঠা হয় অমলেরা। তাঁদের তো কেউ জানতোনা অমুক সময় তমুক পাঠের প্রয়োজন ফুরোবে!
তাঁরা বিদ্যার ঝুলি পিঠে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। শেষ পর্যন্ত চাকরী যদিও হয়, তাতে চলেনা। আর জায়গায় জায়গায় শুনতে হয়, এটা নিয়ে পড়ালেখা না করে ওটা নিয়ে পড়লে ভালো হত! আরে বাবা সবাই কি ভবিষ্যৎ দেখে তাঁর পর পড়ালেখা করে? তাই অমলরা আর অমল বাবু হয়ে উঠতে পারেনা!
অমল এই যে সেদিন টিউশনীতে স্টুডেন্টের বাবা কে বলছিলো একটা চাকরির কথা । স্টুডেন্ট এর বাবা বললেন, “বাবা,তুমি যে বিষয়ে পড়ালেখা করেছ সে বিষয়ের এখন দাম নেই” । অমলের খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো, দাম নেই নাকি, পড়ালেখার মান নেই? সে চুপ করে মাথাটা একটু কাত করলো শুধু। কিছু বললনা, সবে ধন নীলমণি টিউশনীটা খোয়াবার ভয়ে।
বাস থেকে নেমে পায়ে হেটে বাড়ি ফিরছে অমল। পাশে মৌমিতার গাড়ি দাড়ালো । মনে হয় গাড়ির ভেতর এইমাত্র কড়া সেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত লেমন ফ্লেবার। হালকা নাকে এসে লাগলো অমলের। সে না দেখার ভান করে হেটে যাচ্ছিলো।
মৌমিতা ডাক দিলো,” কিরে কই যাচ্ছিস?”
-ওহ তুই?! বাসায় যাচ্ছি( অমল এমন ভাবে কথাটা বলল যেন সে আসলেই দেখেনি, মধ্যবিত্তদের বেঁচে থাকতে গেলে অভিনয় টা করতে হয়, সকালের নাস্তা না করে বলতে হয় করে এসেছি)
-হুম, চল তোকে নামিয়ে দি,আমি তোর বাসা হয়েই যাবো।
-আমি আসলে বাসায় যাওয়ার আগে একবার বাজারে যাবো। ( এখানেও মিথ্যে, অমল বাজারে যাবেনা, কিন্তু হেটে যাবে তবুও মৌমিতার গাড়িতে যাবেনা,মধবিত্তদের মধ্যে এই জিনিশটা বেশি, কষ্টে বেঁচে থাকাতেই তাঁদের আত্মসম্মান)
-ওহ, ঠিকাছে,আবার হয়ত দেখা হবে!
-হয়ত!
অমল দাঁড়িয়ে থাকে, মৌমিতার গাড়ি হুশ করে বেড়িয়ে যায়। অমলের বিরক্ত লাগে কড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে। সে হাটতে থাকে। তেল চিটচিতে শার্ট থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। অমলের ইচ্ছে করে ঠান্ডা জলে একটা ডুব দিতে,যেখানে পৃথিবী নেই।
অমল এক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে,পরক্ষনেই তাঁর গা জুড়িয়ে যায় একটা জোড় বাতাসে। আহ কি শান্তি! কি ঠাণ্ডা ! অমল একটু ঠান্ডা বাতাস পেয়েই যেনো সব দুঃখ ভুলে যায়।