আমাদের চারপাশে হাজারো মানুষ, ব্যস্ততার ভীড়ে সেই হাজারো মানুষের ভীড়ে থেকেও আমরা একা। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমরা নির্লিপ্ত, আমিও কি নির্লিপ্ত নই? তবুও মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে ব্যতিক্রম কিছু মানুষদের। যারা এখনো, জীবন-যুদ্ধে পরাজয় মেনে নেয়নি, বা ধরাবাধা পথে হাটেন-নি। তাদের দেখে গর্ব হয়।
হায়দার আলী তেমনি একজন। তার সাথে পরিচয় অনেক আগের, জানা-অজানা কথা হলো এই-মাত্র কিছুদিন আগে ।
আপনার যারা ঢাকার, উত্তরা ,থাকেন, বিশেষ করে উত্তরা ১৩ নাম্বার সেক্টরে, তাদের চোখে হয়ত পড়ে থাকবে এই দৃশ্য। উত্তরা , ১৩ নাম্বার সেক্টরের পার্ক সংলগ্ন মসজিদের পেছনেই, রাস্তার পাশে, একটা বড় গাছের শ্যামল ছায়ায় নানা রঙের, নানা রুপের চিত্রের পশরা সাজানো আছে।
প্রায় যাওয়ার পথে পথচারিরা একবারটি সেখানে দৃষ্টি বুলিয়েই যান। আমি সে পথে যতবার যাত্রা করেছি, ততবার কিছুক্ষনের জন্যে হলেও দাঁড়িয়ে ছবি গুলো দেখেছি, হাতের আঁকা বেশ কিছু ভালো ছবি দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু বিক্রেতা কে খুজে পাইনা। এ কেমন কথা! ।
গতকাল যাওয়ার পথে আরেকবার দাড়ালাম, পাশেই একটা চায়ের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এই ছবিগুলোর মালিক কে? চায়ের দোকানদার উঠে বলল,
-আমার ছবি এসব, কেন? কিনবেন?
-ছবি কিনবোনা,তবে আপনার ছবি তুলবো ।
-আমার ছবি তুলে কি হবে? গাড়িওয়ালাদের ছবি তুলেন।
-গাড়িওয়ালারা তো নিজেরাই ছবি ভাই, তাদের জীবনটাই ছবি, আমি ছবির মত মানুষের না,শুধুই একজন মানুষের ছবি তুলবো।
এরপর হ্যদার আলীর সাথে আরো কিছু কথা হলো। তাকে দেখে এই ভেবে ভালো লাগলো, তারুন্য এখনো বিপথে যায়নি, এখনো প্রত্যাশার আলো হারিয়ে যায়নি। ছবি তুলে তার সাথে, তার ছবি নিয়ে, তার জীবন নিয়ে আরো কিছুক্ষন কথা হলো।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার জীবনন সম্পর্কে, তার জীবন বোধ সম্পর্কে, আমি এখানে হায়দার আলীর সাথে আমার কথোপকথনটাই তুলে ধরব শুধু…
-আপনি এই কাজে কতদিন?
-অনেক বছর ৬/৭ বছর হবে।
-আপনার এই কাজে কেউ কি উৎসাহদাতা ছিলো?
-না আমি নিজেই নিজের উৎসাহ । নিজেই করেছি সব।
-কাজটা শুরুর সময় কেও কি কোন সাহায্য করেনি, বা অন্যকারো বুদ্ধিতে কি এই ব্যবসায় নেমেছেন/
-আমি মানুষের বুদ্ধিতে চলিনা,সব নিজের ভাই,।
-আপনি যখন প্রথম কাজ শুরু করেন তখন নিশ্চয় এত চিত্রের সংগ্রহ আপনার ছিলোনা?
-ভাই ২০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করসিলাম,এখন আল্লাররহমতে অনেক ভালো অবস্থানে আছি।
Ma art gallery, মা আর্ট গ্যালারী
এই পর্যায়ে হায়দার আলী আমাকে তার ভিসিটিং কার্ড বের করে দিলেন, আমি কিছুটা কি চমকাই নি? অবশ্যই ! পেটফোলা মানিগেই কি খালি ভিসিটিং কার্ড থাকবে নাকি! হায়দার আলীদের ও ভিসিটিং কার্ড দেওয়ার সক্ষমতা আছে, সেই যোগ্যতা আছে ।
নাম পড়ে দেখলাম ‘মা আর্ট গ্যালারী’ । দেখেই ভালো লাগলো। গাছের শীতল পরশের চিত্র সম্ভার ।
আরো কিছুক্ষন হায়দার আলীর সাথে কথা হলো, তার বিচিত্র চিত্রের, এই চিত্র সম্ভার নিয়ে।
-এই সব কোথায় পান ভাই?
-কিনে আনি।
-আপনি কি যারা ছবি আঁকে তাদের থেকেই কিনেন?
-জী,এখানে চারুকলার শীল্পিদের আঁকা অনেক ছবি -ই আছে ,কিছু কিছুর অনেক দাম।
হায়দার আলী, চিত্র-বিক্রেতা, আবার পাশেই দোকানে পান-চা বিক্রি করেন। এই বয়সে একজন কে এভাবে পরিশ্রম করে, উপার্জন করতে দেখে মনে হলো, এরাই পারে একটা দেশকে বদলাতে । শেষ বেলা চলে আসার সময় ছবি দেখলাম, নিতে খুব ইচ্ছে করছিলো। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো গত বার এর দাম জিজ্ঞেস করায় দেড় হাজার বলেছিলো। পকেটে ২৫০ টাকা নিয়ে আর যাই হোক দেড় হাজার টাকা দামের ছবি কেনা যায়না, তবে স্বপ্ন তো দেখাই যায়।
যে স্বপ্ন দেখেছি আমি হায়দার আলীর চোখে মুখে, সে স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ুক সব প্রানে।