উচ্চশিক্ষতি চা-ওয়ালার একাল সেকাল ( সম্পূর্ন )

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

বহদ্দারহাট বাজারের ভেতরটা সবসময় সরগম থাকে। দিন হোক বা রাত, বৃষ্টি বা রোদ। কাঠ ফাটা রোদ্দুরে যেমন মানুষের আনাগোনা তেমনি বৃষ্টির  মাঝেও থাকে হরদম কেনা বেচা। আমি আর বন্ধু মাহামুদ আমাদের বাসায় ছিলাম। আমার পিতা-মাতা গিয়েছিলেন পরিজন ভ্রমনে। মাহামুদ ব্যাচেলর মানুষ, একা থাকা তাঁর ধাতে আছে। আমার ধাতে নেই,গাতেও সয় না।

 

সে ছিলো বলে ভরসা। দুপুর বেলা দুমুঠো খাওয়ার একটা  আশা আছে। এ না থাকলে হয়ত চা-আর বিস্কুট খেয়েই বেলা পার করতাম।  যাক বন্ধুর সাথে হাটছিলাম বাজারের পথ ধরে। মাহামুদের বাজারে আবার বিশেষ ধরন । সারা বাজার ঘুরে  এখান থেকে আধা কেজি, ওখান থেকে আধা-পোয়া, ওখান থেকে ২০০ গ্রাম, সেখান থেকে ১ কেজি। একটা সব্জির ১ কেজি নিবে কিন্তু ভালোমত বাজিয়ে নেবে। পোকা আছে কিনা, সবজি তাজা কিনা , ভাংলে পটর পটর শিমের আওয়াজ হয় কিনা সব দেখে নিবে। যাক অনেক গবেষনার পর এক দুই ঠোঙ্গা বাজার করে আমরা বাসার পথ ধরলাম।  

 

আমার চায়ের তেষ্টা পেলো। মাহামুদের আবার তেষ্টা খুব কম, যা খাবে ঘরে। তবুও তাকে নিয়ে একটা দোকান খুজে পেয়ে ঢুকে পরলাম।  

 

দুটো চা আর বিস্কিট এর অর্ডার করলাম। দোকানের চায়ের কাপে বিস্কিট চুবিয়ে চুবিয়ে খেতে একটা আলাদা মজা আছে। এ মজা গ্রিল চিকেন ছিড়ে খাওয়ার থেকে বেশি, এ আয়েশ অন্যরকম। চুবিয়ে দুটো বিস্কিট খেয়ে আরেকটি চাইতেই, মাহামুদ বলে উঠে,”দুইটার বেশি না, “excess of anything is bad”

, আজকে  দুইটা খাবি, কালকে দুইটা”

 

আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম যে”কালকে না খাই, আজকে চারটি খাই”। নাহ সে বুঝবেনা। দোকানদার আমাদের অবস্থা দেখে  হাসছে।

 

আসার আগে দোকানদার  জিজ্ঞেস করলো, “বাড়ি কোথায় আপনাদের ?  হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম কিছু মনে করবেন না যেন”   ।

 

আমি আর মাহামুদ হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। নাহ আমাদের প্রশ্ন করেছেন বলে নয়। সে প্রশ্নটা করেছে নির্ভুল ইংরেজিতে। আমরা খানিকটা অবাক হয়েই নিজেদের পরিচয় দিলাম। বাশখালী গ্রামের অন্তর্গত কালীপুরে আমার জন্ম, আর মাহামুদ সাতকানিয়ার।  

 

মনের মধ্যে প্রশ্নটা খচ-খচ করছিলো , কিন্তু জিওজ্ঞেস করতে পারছিলাম না। এভাবে ইংরেজি জানা,শিক্ষিত দোকানদার এর সম্মুখীন খুব কম হয়েছি। তাই ধুম করে প্রশ্ন করে বসতে ভয় লাগছিলো বটে। লোকটা মধ্যবয়স্ক,মাথায় চুল কম,কিন্তু চোখ দেখে মনে হয় বুদ্ধি বেশি। লোকটা সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ”বাবার নাম কি?”

 

আমি সাধুর মত বলে দিলাম,”নাজিম উদ্দিন”

 

‘তোমার বাবাকে আমার সালাম দিবে, উনি আমার স্যার”

“আপনি কি…?”

“হ্যা আমি বাশখালী ডিগ্রী কলেজের ছাত্র ছিলাম”

 

“ও” আমি এর বেশি কিছুই বললাম না। মনে মনে চিন্তা করছিলাম নিশ্চই ইয়ার ড্রপ দিয়ে এখন দোকানের পথ ধরেছে। আবার এর কাছে আসতে হবে ,এর পুরো গল্প জানার জন্য। একদিনে সবটা জানতে চাইলে হয়ত কিছুই জানা  হবেনা।

 

সেদিনের মত বিদায় নিয়ে চলে আসলাম।

 

পথে নেমে আমদের ইয়াদ হলো লোকটার নাম ই  আমরা জানিনা। আবার ফিরে যাবো কিনা ভাবছি, পরে ঠিক করলাম, কাল আবার আসবো। মাহামুদ আর আমি হাটছি, লক্ষ্য করছি মাহামুদের ধুমধাম ইংরেজি বলা কিছুক্ষনের জন্য বন্ধ হয়ে আছে। সম্ভবত ওই লোকটার তুখোড় ইংরেজি তাঁর এই হাল করেছে।

 

বাসায় এসে আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্প করছি। বলাই বাহুল্য গল্পের বিষয় নাম-না জানা সেই তুখোড় ইংরেজি বলা চা-ওয়ালা। আমরা সহমত হলাম, লোকটা বিনা কারনে চায়ের দোকান দিয়ে বসেনি,এর পেছনে নিশ্চই কোন গূড় রহস্য রয়েছে।  

 

পরদিন আমার স্কুলের চাকুরী ছিলো, সেখানে গিয়ে স্খুল শিক্ষিকাদের একজন কে ঘটনাটা বলল। তারা এতটাই উৎসুক হলো যে তারাও যেতে চাইলো। কিন্তু মেয়ে নিয়ে বাজারের মাঝ দিয়ে  যাওয়া ঝামেলা বলে আমি এ কথা সে কথা বলে কথার মোড় ঘুরিয়ে তাদের ওই চাওয়ালার কাছে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান্টা বানচাল করলাম।

 

সেদিন বিকেলেই আমি আর মাহামুদ আবার গেলাম দোকানটায়। এবার চানিয়ে জাকিয়ে বসলাম , আজকে পুরো ঘটনা না শুনে যাচ্ছিনা আর!

 

দোকানে অন্য মানুষ ও ছিলো, তারা চলে যাওয়ার জন্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করলাম। এরপর আরো এক কাপ চায়ের ফরমায়েশ দিলাম আমি। চা পান করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম,”কিছু মনে করলে ,আপনার নামটা জানতে পারি?”

 

A tree is known by its fruit; a man by his deeds”

”।

“জী তবুও জানতে চাইলাম”

“ নাম শুনার আগে আমার জীবন কেমন ছিলো জেনে নিন, নাম দিয়ে কি হবে”

জানতে চাওয়ার আগেই লোকটা বলতে শুরু করলো,” বাশখালী ডিগ্রী কলেজ থেকে বিয়ে পাশ করেছি, ভালো একটা কোম্পানীতে চাকরি করতাম, একদিন ছেড়ে দিলাম”

 

লোকটা চাকরি ছেড়ে দিলাম বলে চুপ করে গেলো। চিন্তা করছিলাম আমার কি জিজ্ঞেস করা উচিৎ হবে কেনো ছেড়ে  দিলেন? আবার একটা মানুষ চাকরি কি কারনে ছাড়লো জিজ্ঞেস করাটা কেমন যেন লাগছিলো ।

 

পথটা সোযা করে দিলো বন্ধু। দুম করে একগাল হেসে বলে বসলো”চাকরিটা কেনো ছাড়লেন আঙ্কেল?”  সে এমন ভাবে হাসলো যেন চাকরি ছাড়াটা একটা মজার ব্যাপার।

 

লোকটা  আমাদের কাছে এসে বসলো। বলতে লাগলো,”যে কোম্পানিতে চাকরি করতাম, সেখানে জিএম সাহেব খুব কড়া ছিলো। কথায় কথায়  খারাপ কথা বলত” আমার কি দরকার পড়ালেখা করে গালি খাওয়ার,বা আরেকজনের কথায় উঠবস করার, তাই চাকরি ছেড়ে দিলাম,এরকম আরো দুটো চাকরি ছেড়ে সীদ্ধান্ত নিলাম আর চাকরি ই করবোনা, বিনা নোটিশে চাকরি ছেড়ে বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে গেলাম”

 

আমি বোকার মত জিজ্ঞেস করলাম “এই ব্যবসায় নামছেন?”  

জিজ্ঞেস করা উচিৎ হয়নাই কারন,লোকতা বিভিন্ন ব্যবসার কথা বলেছিলো। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে লোকতা বল;এ উঠলো    ”Every work is important to me,don’t you think so?”

 

আমি শুধু বললাম”yes,I think so” । সে সময় আমার একটা স্টেশনারী দোকান ছিলো। অনেকেই সেটা নিয়েই আজেবাজে বলত। এই লোকটার কথায় আমি বেশ একটা ইন্সপাইরেশন পেলাম।

 

কথায় কথায় জানলাম তিনি স্যার হিসেবে শুধু আমার বাবা কে নয়, আমার বাবার বড় ভাই জহির উদ্দিন আর ইউসুফ জাফরকেও চিনতেন।  

 

তাঁর সাথে অনেকটা ফ্রি হয়ে গিয়েছিলাম,তাই জিজ্ঞেস করলাম এতো জায়গা থাকতে এখানেই কেনো দোকান, তাঁর ব্যবসায়িক জীবন কেমন চলছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

লোকটা যা বলল তাঁর সারমর্ম এরকম, তিনি চাকরি ছেড়ে প্রথমে পোল্ট্রির ব্যবসায় নামলেন,পরে  সে ব্যবসায় লাভ করে পরে কাপড়ের ব্যবসা ধরলেন। এখন বয়স হয়েছে তাই ব্যবসা ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজে চায়ের দোকান দিয়ে বসেছেন। শান্তিতে সময় কাটান এখন। কিছু না করলে ভালো লাগেনা, এটাই ভালো লাগলো,তাই এটাই শুরু করলেন।

 

মুগ্ধের মত শুনলাম, আর জীবন সম্পর্কে কিছু নতুন ধারনা পেলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো, মাহামুদ তাড়া লাগালো চলে যাওয়ার জন্যে। আমরা বের হয়ার পথে সেই চাওয়ালা কে জিজ্ঞেস করলাম আপনার নামটা বলবেন?

 

তিনি হেসে বললেন,”কালকে আপনাদের দুজোনের চায়ের দাওয়াত, দাওয়াতেই বলবো” ।

 

কি আর করা দাওয়াত গ্রহন করে আচ্ছা বলে চলে আসলাম।

 

পরদিন আর আসেনা। দিন যায় রাত যায়, অকর্মের কর্মযজ্ঞে  আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। প্রায় মাসখানেক পর মাহামুদ আর আমি এক বিকেলে বসে চা পানের জন্যে বের হলাম। কোথায় যাবো চিন্তা করতে করতে  মনে পড়লো সেই বিয়েপাশ চা-ওয়ালার কথা। সেই পথে হাটা দিলাম আমরা । বাজারের পথ ধরে কিছুদুর গেলেই দোকান ।

দূর থেকেই দেখলাম দোকানটা খোলা, চায়ের কেটলি থেকে ধোয়া উঠছে ,চা-ওয়ালা বোধয় ভেতরে। গিয়ে দেখলাম নতুন একজন দোকানদার। জিজ্ঞেস করলাম আরেকজন কই?

বলল “কে? আরেকজন নাই আমি একা”

মাহামুদ জিজ্ঞেস করলো”একজন আঙ্কেল দোকানে ছিলোনা?”

“ও উনিউ তো গত ১০ দিন আগেই দোকান  বেঁচে চলে গেছেন”

“ওহ, ওনার নামটা বলতে পারেন?”

“নাহ আমি আরেকজন থেকে দোকান নিছি,,যার থেকে নিছি তাঁর থেকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত জানতে পারবেন’

 

আমার কেন জানি তাঁর নাম আর জানতে ইচ্ছে হলোনা। আর লেখাটার নাম উচ্চশিক্ষিত চা-ওয়ালা কেনো দিলাম নিজেই এখন চিন্তা করছি। চা বিক্রেতা বিয়ে পাশ বলেই কি? তা বোধয় নয়। পড়ালেখা করলেই সবাই শিক্ষিত হয়না, তাঁর মত কিছু  স্বশিক্ষিত উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের বড় দরকার।

 

তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছেন, চাকরীর পরোয়া না করে বাঁচতে চেয়েছেন, তিনি তাঁর মত থাক, তাঁর নাম জেনে কাজ নেই,”Man lives in deeds not in names”।যদিও আসল প্রবাদ টা ছিলো ‘Man lives in deeds not in years” ।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া