বাঙালি জীবনের ইতিকথাঃ ক্রিকেটের আদি উৎস কি ডাংগুলি ?

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

যাচ্ছিলাম ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ট্রেনে করে। পাশের সীট টা খালি ছিলো তাই আরামে বসতে পারলাম। যাত্রি মনে হয় ট্রেন মিস করেছে বা কোন সমস্যায় হয়েছে। এমনো তো হতে পারে তাঁর আর ট্রেইনে যাওয়ার দরকার নেই সে ইতিমধ্যেই তাঁর গন্তব্যে পৌছে গিয়েছেন। এমন ভাবছি এ সময় এক বয়স্ক লোকের আবির্ভাব। ভদ্র লোক নিজেই জানালেন ভুল বগি তে উঠে পড়েছিলেন তাই আসতে এত লেট । বুঝলাম, এ দীর্ঘ যাত্রায় কর্ন দান না করলেও কর্নপাত করতেই হবে তাঁর কথায় । গুছিয়ে বসলাম , চিন্তা করছিলাম ঘুমিয়ে পার করে দিব সময়টা। বিধিবাম লোকটা একটা প্রথম আলো বের করলো। সেখানে দেখাচ্ছে টাইগারদের বিজয় উল্লাসের ছবি । সেখান থেকেই কথার শুরু ,শেষ যে কবে  কোথায় , কিভাবে হয়েছিলো আমার মনে নেই। শুরুটা করলেন সেই বয়স্ক লোকটাই।

 

“দেখেছেন কি কাণ্ড?”

আমি একটু অবাক হয়েই বললাম” কি কান্ড?”

 

“আরে এরা এত ক্রিকেট ক্রিকেট করছে ,নিজেদের খেলাটাই ভুলে বসে আছে”

“কি খেলার কথার বলছেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না”

 

“আরে তুমিও দেখছি একি দলের লোক “

আমি আসলেই বুঝতে না পেরে বললাম “কোন দলের?”

 

‘আরে ওইযে ক্রিকেট, আমদের সময় এ জিনিশ ছিলোনা, আমরা খেলতাম  ড্যাংবাড়ি”

আমার চোখ হাফ ইঞ্চি উপরে উঠে গেলো, “এ খেলার নাম আগে শুনিনি”

 

“আরে কি বলছ, তোমার বাবা কে জিজ্ঞেস করো সে জানবে”

“সে না হয় করবো, খেলাটা কি রকম একটু বললে বোধয় বুঝতাম”

“আরে  ওইযে দেড় দুই ফুট লম্বা ডান্ডা দিয়ে যে গুলি মারে”

“ আঙ্কেল ডান্ডা দিয়ে কেমনে গুলি মারে?”

“ কি দেশ ভাই, যে দেশের জনপ্রিয়  খেলা ড্যাংবাড়ি সে দেশের ছেলেই জানেনা এ কি রকম খেলা”

“আপনি কি ডাংগুলির কথা বলছেন? ওইযে ডান্ডা দিয়ে গুলি মারে, যদিও শুনতে গুলি গোল মনে  হলেও গুলি গোল নয় ওটাও দেড়/দুই ইঞ্চি লম্বা কাঠি যার দুই পাশে সূচালো থাকে। “

 

“এইত বেশ বুঝেছো, তা এতক্ষন বুঝনি কেন”

“আমাদের দেশে একে ডাংগুলি বলে”

“ও বুঝতে পেরেছি, তা দেখে তো বোধ্-হয় পড়া লেখা জানো, ডাঙ্গুলি যে এই দেশের জায়গা ভেদে গুটবাড়ি,ভ্যাটাডান্ডা্‌,ড্যাংবাড়ি, ট্যামডাং,  নাম,এ পরিচিত জানোনা?”

বলতে ইচ্ছে হলো পড়া লেখা করলেই কি সব জানা লাগবে? কিন্তু বললাম “না জানতাম না, ধন্যবাদ আজকে জানলাম”

“ধন্যবাদ দিয়ে কি লাভ, যে ছেলেরা নিজেদের খেলাকে ভুলে যেতে বসেছে ,তাঁদের দেখে  দুঃখ হয়”

“আঙ্কেলের এমন দুঃখ দেখে আমি নিজেই লজ্জিত হয়ে পরলাম, ইচ্ছে হল বলি চলেন আঙ্কেল ড্যাংবাড়ি খেলি”

ততক্ষনে আঙ্কেল ডাঙ্গুলির উপর লেকচার শুরু করেছেন,সে লেকচার শুনবেনা এ সাধ্য কার, আমি তো আমি সাথে পাশের কয় একজন ও কান বাড়িয়ে শুনতে লাগলো

 

“জানেন একসময়  ড্যাংবাড়ি কি জনপ্রিয় ছিলো?”

আমরা সমাই মোটা মুটি “হুম” টাইপের উত্তর দিলাম ।

 

মনে হচ্ছিলো ট্রেন থামলেও আঙ্কেল আজ থামবেন না।তাই আমাদের উত্তর সংক্ষিপ্ত করে সময় বাঁচানোর প্রয়াস ছিলো, মিথ্যা বলবোনা।

 

আঙ্কেল বলে চললেন…

“দুই বা চার- পাঁচ জনের দল করে এ খেলা খেলতাম , বুঝছেন?” আমাদের বোঝার তোয়াক্কা না করে তিনি আবার বলে চললেন…“ লম্বা টা কে ডান্ডা আর ছোট টাকে গুলি বলে, খেলার শুরুতে মাঠে একটা গর্ত করা লাগে বুঝলেন? তারপর সে গর্তের উপর গুলি রাখা হয়, যারা দান পায় তাঁদের একজন সেটাকে ডান্ডা মেরে দূরে পাঠায় যতটুক পারে, আর বিপক্ষ দল ধরে ফেললে সে মরা, মানে আউট আরকি” বলেই আঙ্কেল আমাদের দিকে চাইলেন, বুঝাই যাচ্ছে হুম না বললে বাকিটা বলবেন না। তাই আমরা কয়েকজন হুম টাইমের একটা আওয়াজ করলাম যেটা অনেক টা ঘোঁত করে ওঠার মত হলো।

 

এর মধ্যে উৎসাহী একজন জিজ্ঞেস করলো “ কোন দল কেমনে জিতে?”

এবার আঙ্কেলের ঘোঁত করে ওঠার পালা “আরে, খেলাই শুরু করলাম এখন, জিতবে কেমনে?” বলে আঙ্কেল চোখ বন্ধ করে আবার খুললেন বুঝলাম এবার আবার শুরু হবে …“ধরতে পারলে তো যে মারছে সে আউট আর না পারলে গর্তের উপর রাখা ডান্ডা লক্ষ্য করে সেই গুলি মারতে হবে , লাগাতে পারলে , যে প্রথমে ডান্ডার বারি দিয়ে গুলি ছুড়ে মারসিলো সে দান হারায়” ।

 

এত টুক শুনে আমার মাথা চক্কর দিচ্ছিলো, কি খেলারে বাবা। আঙ্কেল থেমে নেই ,আপন মহিমায় বলে চলছেন,রবির মত আপন শক্তিতে জ্বলছেন ।

তিনি বলে চললেন…

“আর যদি ডান্ডা লক্ষ্য করে মারার পর গুলি ডান্ডায় না লাগে তাহলে প্রথমে যে মারসিলো সে আবার চান্স পায় বুঝেন নাই?সে,ডান্ডা দিয়ে তুলে গুলিকে আবার মারে  –এই -এমনে বলে আংকেল কেমনে জানি দেখালেন ঠিক মনে নাই”

একটা জিনিশ বেশ বুঝছিলাম,কথার  স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে আংকেল ভাষার স্রোত হারিয়ে ফেলছেন। থাক ভাষা। শুনতে ভালোই লাগছিলো।

আমি নিজেই বললাম , “তাঁর পর কি হয়?”

আঙ্কেল এক গাল হাসলেন যেনো আমি প্রশ্ন করার জন্যেই তিনি এতক্ষন চুপ ছিলেন। তিনি বললেন, “ তারপর গর্ত থেকে গুলি পর্যন্ত মাপা হয় ডান্ডা দিয়ে, এই সাত পর্যন্ত মাপের আবার বিভিন্ন নাম আছে অঞ্চল ভেদে যেমন ধরেন বাড়ি,দুড়ি,তেড়ি,চাঘল,চাম্পা,ঝেক,মেক” ।

আমি জিজ্ঞেস করলাম “সাত ডান্ডার মাপ হলে কি হয়?”

“কি হয়?  বলে একটু হেসে তিনি আবার বললেন ,সাত মাপে এক গুট হয়, একে আবার ফুল ও বলে, আর সাত ফুলে হয় এক লাল ,  ভাঙ্গা ফুলের শেষ হলে পরের খেলা শুরু হয়। বাড়ি,দুড়ি ,তেড়ি এসবের রয়েছে আলাদা মারের নিয়ম, আউট না হওয়া পর্যন্ত একজন খেলোয়ার খেলতে থাকে, সে আউট হলে তাঁর দলের আরেকজন শুরু করে ,এভাবে সবাই আউট হয়ে গেলে বিপক্ষ দল শুরু করে”

 

“হুম, বুঝলাম” , আমি বললাম।

তিনি বললেন” কিছুই বুঝোনাই, কেও বোঝেনা, আরে ক্রিকেট এই সেদিনের খেলা, আর এটা তারো আগে বাংলা আর ভারতবর্ষে প্রচলিত খেলা”।

“তো?”

“তো চিন্তা করেই দেখ’

সারাটা পথ আমি চিন্তা করে আসলাম, শেষে ভাবলাম ক্রিকেটের আগে ডাংগুলির চল ছিলো, তো কি সমস্যা, এরপর ভাবলাম কিছুটা মিল-অমিলের খেলা আছে এই ক্রিকেট আর ডাঙ্গুলির মাঝে । অনেকটাই মিলে,ব্যাটসম্যান  আছে, এখনের ব্যাট তখন ছিলো ডান্ডা, এখনের বল সে কালে ছিলো গুলি ,যদিও গোল ছিলোনা তবে বলের কাজ টাই করত। তখন মনে আসলো ফুটবলো একসময় এতটা গোল ছিলোনা। আর বাকি থাকলো আউটের কথা ডাঙ্গুলিতে শুধু ক্যাচ আউট আছে  আর গুলি ছুড়ে ডান্ডা ছুয়ে বিপক্ষের দান বাতিল করার একটা অপশন আছে। ক্রিকেটে আউটের ক্ষেত্র অনেক ক্যাটাগরি রয়েছে । আরেকটা অমিল ক্রিকেটে বোলার আছে , ডাঙ্গুলিতে বোলার নেই, ব্যাটসম্যান নিজেই বোলার ডাঙ্গুলির ক্ষেত্রে ।  সে গুলির নিচে ডান্ডা দিয়ে দূরে ছুড়ে মারে, বা গুলির ছুচালো দিকে বাড়ি মেরে ২য় মাইরে গুলিকে দূরে পাঠায়।

আমি চিন্তা করছিলাম,এর মাঝেই হঠাৎ মনে হলো ক্রিকেটের আদি উৎস এই নাতো? ডাংগুলির নব্য সংস্করন ই কি তাহলে ক্রিকেট? ইংরেজরা সে সময় এদেশ শাসন করেছিলো , সে সময় এখান থেকেই ধারনা নিয়ে একটু সংস্কার করে নিয়ে, কিছু আউটের সংখ্যা বাড়িয়ে আর নিয়ম বাড়িয়ে ডাঙ্গুলিকেই ক্রেকেটে রুপান্তরিত করেনিত তারা? এমনটাই  বিশ্বাস যোগ্য ঠেকছিলো ।

আর এমন সময় মনে প্রশ্ন আসে আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গিয়ে বিজাতিয় সংস্কৃতি কে মেনে নিচ্ছি বেশ কথা, কিন্তু নিজেদের স্বকীয়তা কি এভাবেই হারিয়ে যাবে?ক্রিকেট যারাই আবিষ্কার করুক, আমরা তো আমাদের মূল ধরে রাখতে পারছিনা!  এভাবেই কি মূল থেকে দূরে সরে যাবো। একটা সময় ছিলো যখন ছড়া গানে ঘুম পাড়ানো হত, সাতচারা,মার্বেল,ডাঙ্গুলি খেলা হত। সে সব খেলাকে অপব্যাখ্যা দিয়ে ,যেমন মার্বেল খেলা কে খারাপ খেলা ব্যাখ্যা দিয়ে , বিজাতিয় সংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছি আমরা সমাজের কারনে।

মূল ই যদি না থাকলো,নিজের দেশের সংস্কৃতি ই যদি রক্ষা করতে না পারি, নিজের দেশের খেলার নিয়ম পর্যন্ত ভুলে গিয়ে বসে থাকি, তাহলে আর কি বাকি থাকে একটা দেশ হিসেবে আমাদের নিজেদের বলতে? আমি নিজেই এতদিন এত কথা জানতাম না। ডাঙ্গুলি খেলেছি সে আমাদের মত, কোনমতে নিজেদের মত, এই নিয়ম গুলো জানতাম না। জেনে আজ লজ্জিত হলাম। । চোখ মেলে তাকালাম,আঙ্কেল হাসছেন, আমিও হাসলাম,তিনি বোধয় আমার চিন্তায় ঘেরা চেহারা আর সাথে একটা পরাজয়ের আর গ্লানীর হাসি দেখে বুঝেছেন যে আমি বুঝেছি। এর পর আমি আর বিশেষ কথা বলিনি, ব্যাপারটা আমার মূলে আঘাত করেছিলো, কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, কোথায় সাত চারা,কোথায় জাতিয় খেলা  হা-ডু-ডু ? এখন কি আর ছোটরা কুত কুত আর গোল্লা ছুট খেলে  ?

কিছুটা সন্দেহ থাকলেও সে সময়  আমার বিশ্বাস আরো দৃড় হলো বাঙালির ডাঙ্গুলি-ই হচ্ছে  হালের ক্রিকেট ।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন