আমার বাবার নাম নাজিম উদ্দিন। ১৯৫৪ সালে বাবার জন্ম। মা এর চাইতে বাবা কে নিয়ে আমার শৈশবের স্মৃতি বেশি ,যদিও বাবার সাথেই দেখা হত কম। হয়ত যার সাথে দেখা কম হয় তার প্রতি টান বেশি থাকে। বাবা ছিলেন বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজের রসায়নের অধ্যাপক । ছেলে মেয়ে পড়া লেখা করছে কিনা এটা নিয়ে তার যত চিন্তা ছিল।
যখন শহরে থাকতাম তখনের একটা কথা বেশি মনে পড়ে, বৃহস্পতিবারের জন্যে অপেক্ষা করতাম, কারন সেদিন বাবা বাড়ি থেকে যেতেন। আর একটা কথা এখন মনে আছে। একদম ছোট বেলায় আমি ঘুমাবার আগে আব্বুর হাত টা বুকের উপর রাখতাম,না হলে ঘুম আসতনা। আব্বু হাত সরিয়ে নিলেই আমার ঘুম ভেঙে যেত। আবার হাত টা ধরে ফেলতাম । আব্বু খুব ভোরে উঠত আর ফজরের নামাজে যেত। মনে আছে একদিন আব্বু সকালে উঠে, আস্তে ধীরে মশারির বাইরে যাচ্ছিল, আমার চোখ খুলে গেলো। একটা কেমন জানি কানেকশন ছিল। আব্বু উঠলেই আমি যত্ ঘুমেই থাকতাম না কেনো টের পেয়ে যেতাম ঠিক ই। অত আগের কথা কিভাবে মনে আছে জানিনা। তবে অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি অনেকেরি শৈশবের , খুব ছোট কালের কিছু স্মৃতি, মনের কোনে এখনো জমে আছে।
শৈশবে ফুটবল,ক্রিকেট সবি খেলতাম, আব্বুর সাথে। বন্মধুদের কে পাওয়া না গেলে আব্বুর সাথে ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পরতাম। খেলতাম বলে, এটা ভাবা ঠিকি নয় যে শাসনের স্বীকার হইনি। আলবৎ হয়েছি। একবার মনে পরে আব্বু ছাত্র পড়াবার সময়, ডিস্টার্ব করায়, বাড়ির উঠোন জুড়ে দৌড়ে আমাকে তাড়া করেছিলেন। মারতে অবশ্য পারেন নি। আর আমাকে ফাইভ পর্যন্ত আব্বু পড়িয়েছিল। তখন উঠতে ,বসতে চুল টানা, আর কান মলা খেতাম। আর আঙ্গুল দিয়ে মুখের চামরায় কি একটা গুত দিত।ওহ! ভয়ঙ্কর ।
আব্বুর সাথে এখনো আমার যুক্তি নির্ভর তর্ক হয় বেশ। সে যুক্তির শেষ হয়না। প্রতিবার কেও না কেও সেটা থামিয়ে দেয়। যখন আমি ক্লাস ৯ এ উঠলাম সে সময় আব্বুরা ৫ জন, বড় দুর্ঘটনায় পরে। সে দুর্ঘটনায় মেজ আব্বু মারা যান। আব্বু শারীরিক এর চাইতে মানসিক আঘাত বেশি পান বড় ভাই এর মৃত্যুতে। বেশ ক বছর সে কষ্ট তাকে ভুগিয়েছে।
আর যদি বলি আব্বুর পেশা সম্পর্কে ,বলতে হয় সেটাই আমাকে শিক্ষকের পেশার প্রতি আগ্রহি করে তুলেছে। বাশখালীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সময় মানেন খুব। আমার জানা মতে, আব্বু কলেজ এ জাননি এমন দিন খুবি কম। চরম অসুখের মাঝেও তাকে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কলেজে যেতে দেখেছি। তার প্রতি তার ছাত্রদের টান,ভালোবাসা ,সম্মান আমাকে মোহিত করেছে সেই ছোট বেলা থেকেই। কলেজ জীবনে প্রাপ্য ছুটি থাকলেও তিনি কাটাতেন কিনা সন্দেহ। আর এখন এই অবসরে তিনি সে ছূটি কাটাবার আর সুযোগ ও পাবেন না। বেশ ক বছর আগে তিনি কলেজ থেকে অবসর নিয়েছেন। দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি একি কলেজে চাকরি করেছেন।বর্তমানে একটা স্কুলে অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন। এখানেও সেই নিয়ম মেনেই চলেন। কাটায় কাটায়।ঘুম ও যাওয়ার চেষ্টা করেন কাটায় কাটায় ১০ টায়। এখনো আল্লাহর রহমতে উঠেন ফজরের আজানের আগে।
ছোট বেলায় আব্বু অনেক ম্যাজিক দেখাতেন। এখন ছোট কাউকে যখন তিনি ম্যাজিক দেখান তখন আমি ফিরে যাই শৈশবের হারিয়ে যাওয়া দিন গুলোতে। এখন তার সাথে কথায় কথায় তর্ক হয়, অনেকে ঝগড়া ভাবে,আসলে ভুল এটা সেই শৈশবের তর্ক তর্ক খেলা। বয়স চলে যায় ,সে অভ্যেস ছাড়তে পারলাম কই। বাবারা যদি আদর্শ না হয় একজন ছেলের বেড়ে উঠা অনেক কঠিন, তবে ব্যাতিক্রম ও আছে। আমার বেড়ে উঠার পথে প্রিয় বাবার জীবনের ছায়া পড়েছে বৈকি! তার মত সময় আর নিয়ম মেনে চলা কঠিন, তবে মাঝে মাঝে চেষ্টা করি! নাহ পারিনা !