রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম শখের বসে ।তখন একা একা ঘুরার খুব শখ । সন্ধার কিছু পর বাস থেকে নামলাম। চিন্তা করছিলাম এবার কোথায় যাওয়া যায়। পকেটের ৩৬০ টাকার মধ্যে আবার চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়ার বাজেট ১৩০ টাকা। আর থাকল ২৩০ টাকা। চিন্তা করতে করতে একটা রিকশার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।
‘মামা যাবা?’
‘কই যাবেন?’
নিজের মনে বিদ্যুৎ এর ঝলকের মত একঝলক চিন্তা খেলে গেলো। আসলেই কই যাব জানিনা । টাকা থাকলে চিন্তার কিছু ছিলোনা। পকেটে টাকা নাই, এখন সবকিছুই চিন্তার বিষয়। এক কাপ চা ও এখন চিন্তার বিষয় ।
বললাম, ‘ কোন সস্তা হোটেলে নিয়ে চল’
রিকশাওয়ালা কেমন ছুচালো মুখ করে বলল,’ উঠেন, নিয়ে যাই’
উঠে বসলাম রিকশায়, এই জা ভাড়া ঠিক করা হয়নি। ব্যাটা ভাড়া বেশি চেয়ে বস্অলে মুসিবতে পরবো। মাঝে মাঝেই চিন্তা করি আমার সব লেখায় ঘুরে ফিরে রিকশা আসে কেনো। আসলে রিকশা মধ্যবিত্তের পঙ্কখীরাজ বলে কথা। চলছে গাড়ি যাত্রা বাড়ি,ধীর লয়ে।
একটা ভাঙ্গা মত বাড়ির সামনে এসে থামলো রিকশা।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘ভাড়া কত?’
‘দেন একটা ইন্সাফ করে’
আমি ইন্সাফ করে ,সময়ের হিসেব করে ৩০ টাকা দিলাম, রিকশা ওয়ালা ছুচালো মুখ করে তাকিয়ে বলল, ‘ইন্সাফ করতে, বললাম,দিলেন তো গরীবের পেটে লাথি’
বুঝ লাম বেকায়দায় পড়েছি, পড়েছি মোগোলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে টাইপের অবস্থা। শেষ মেস ৫০ টাকায় রাজি করানো গেলো। সালটা ২০০৯ বা ১০ হবে। সে সময় কম দামের হোটেলে ৪০ টাকার কামরা পেয়ে গেলাম। যদিও কিছু বেকায়দা পরিস্থিতিতে পরে কিছু মন গড়া কথা বলে ভাড়া নিতে হয়েছিল। হোটেলে ঢুকলাম,রিসেপসনিস্ট আমার দিকে তাকিয়ে তার প্রথম প্রশ্নবান ছুড়ে দিলো।
‘কি লাগে?’
‘একটা রুমের দরকার ছিল, দুই দিনের জন্য’
‘সাথে কে আছে?’
‘আমি একা”
‘একা কেনো?’
‘সাথে কেও নাই বলে, একা আসছি’
‘সাথে বড় কেও নাই? বয়স কত?’
যদিও ১৮ ছুই ছুই , আমি বাড়িয়ে বললাম ২০ যাতে রুম তা ভাগ্যে মেলে। আর আমি তখন থেকেই দেখতে বড় ছিলেম,এটা একটা সুবিধা ছিলো।
আমি বললাম, ‘বয়স ২০ বছর ৩ মাস ১৩ দিন ,রুম আছে নাকি বলেন নাহয় অন্য কোথাও দেখি’
‘হুম কথায় তো পাকা মনে হয়, রাত বিরাতে বের হওয়া যাবেনা ,আগেই বলে রাখলাম’ বলেই লোক টা একটা চাবি দেখিয়ে বলল, ‘দিন প্রতি ৫০ টাকা, রুমে একটা খাট,একটা টেবিল আছে, বাথরুমের ব্যাবস্থা নিচে, কমন বাথরুমে’
মন্দের ভালো তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম। রাতে বিশেষ ঘুম হলোনা। একা থাকার অভ্যেস কম,কিন্তু ইচ্ছে ছিলো বেশি,দুটোর সংমিশ্রনে ঘুমের বাজলো ১২ টা।রাতে রুমের এ মাথা থেকে ওমাথা হাটা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করলাম না। একটা মোবাইল ছিল সাথে,কিন্তু চার্জার ছিলোনা। ভাবলাম সকালে কোথাও চার্জ দিয়ে নিব। সকালে তাড়া হুড়ো করে নামতে গিয়ে বিশেষ সুবিধে হলোনা, মোবাইল টা হাত থেকে পরে ভেঙ্গে গেলো।সে সময়ের হিসেবে মোবাইলটা বেশ দামি ছিল। মটোরোলার সেট ছিল।লাল রঙ্গের,আমার খুব পছন্দের,পাতলা একটা সেট। রাঙ্গামাটি বিশেষ চিনতাম না। খুজে খুজে একটা মোবাইলের দোকানে গেলাম, সার্ভিসিং এর জন্যে। বলে কিনা ৫০ টাকা লাগবে। নাস্তা খেয়ে পকেটে যা আছে তা দিয়ে একদিনের রুম ভাড়া আর চট্টগ্রাম যাওয়ার গাড়ি ভাড়ার বেশি কিছু হবার নয়, হলেও তা কষ্ট সাধ্য,একেবারে কানায় কানায় হিসেব যাকে বলে । দুঃখে চোখে যদিও বা পানি আসে,সংবরন করলাম আবেগ কে।অনেক হিসেব নিকেশের পরে মোবাইল টা ঠিক করালাম।
এখন প্রশ্ন হলো,আমি কেন একা একা ঘুরছিলাম, তাও আবার কম বয়সে। ব্যাপারটা আমাদের সমাজে হারহামেশাই ঘটে। অনেকে সে পথে গিয়ে হারিয়ে যায়, অনেকে ফিরে আসে । আমি কতটুকু ফিরে এসেছি জানিনা, তবে কিছুটা এসেছি এইটুকু বলতে পারি। কৈশোরের যাতনায় ঘর ছেড়েছিলাম, মনে ভয় ছিলনা, দোটানা ছিল। তবু ঘর ছেড়েছিলাম,যদিও পথের হতে পারিনি।এই রাঙ্গামাটিতে ঘটে গিয়েছিল জীবনের ভয়ঙ্গর দুটো ঘটনা। সে দুটো পরের জন্যে তোলা থাকলো । আজ বলব অন্য একটি ঘটনা ।
রাঙ্গামাটি থেকে বিপর্যস্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম গামী বাসে উঠলাম। কেনো বিপর্যস্ত ছিলাম,সেটা ভয়ঙ্কর দুটো ঘটনার একটার ফল,সে ঘটনা অন্য দিন বলবো। বাসে উঠেই মনটা হালকা হয়ে গেলো,চট্টগ্রামে যাচ্ছি, কথায় আছে চিনা জায়গায় লম্বা পথ ও ভালো। এক ভদ্র লোক পাশে বসেছিলো। অনেক্ষন কথা হয়নি। যখন কথা হলো বেশ ভালই লাগলো। বেশ একটা মাই ডিয়ার টাইপের ভাব আছে।
আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি শুনে বলল , ‘আমি ও সেখানেই যাচ্ছি, একসাথে যাওয়া হবে তাহলে’
আমিও খুশি যেতে যেতে কথা হবে সময় কাটবে বেশ। কথায় কথায় জানালাম আমার মোবাইলের কথাটা, সার্ভিসিং এর পরেও কিছুটা সমস্যা ছিলো,মোবাইল অন হচ্ছিলনা,গাড়ি তে উঠার আগে থেকেই । লোকটা বলল সে মোবাইলের কাজ জানে। মোবাইল টা দেখতে চাইলো । তাকে দিলাম, সে সেটা দেখে পকেটে রেখে দিলো,বলল যেতে যেতে যেতে দেখবে। আমার কেমন জানি সন্দেহ হলো । কিন্তু তখন অতিমাত্রায় ভদ্র ছিলাম, আর ফল সরুপ বলতে পারছিলাম না যে মোবাইলটা দেন।
কিছুক্ষন পর সে বলল সামনে বিরতি ,খেতে খেতে মোবাইল টা দেখবে। আমি ভদ্রতা দেখিয়ে কিছু বললাম না।
গাড়ি বিরতিতে থামলো। লোকোটা নামলো,আমি তার পিছু পিছু। সবাই খেতে বসেছে যে যার মত।লোকটা আমার দিকে চেয়ে একগাল হেসে বলল,
‘আসো দুই ভাই এ মিলে দুটো ডালপুরি খাই’
‘হে চলুন,মোবাইল টা …’
‘আরে নিবা আরকি,আগে খেয়ে নি, কি বলো?মোবাইল তো আর আমি খেয়ে ফেলছিনা, হেহে’
আমার মনে কু ডাকছিলো, বুঝতে পারছিলাম,একটু একটু করে জালে আটকা পরছি। খেতে বসলাম।সজাগ। লোকটা ও খাচ্ছে ।
লোকটা হঠাৎ বলল , ‘তুমি বস,আমি আমার বই গুলো গাড়ি থেকে নিয়ে আসি’
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম লোকটা জাল গুটিয়ে আনছে, আমার তখন মনে পরলো লোকটার কোন বই ছিলোনা।সন্দেহ আরো পোক্ত হলো। সমস্যা একটাই মোবাইল টা বন্ধ ,তাই দাবি করতে পারছিনা সেটা আমার। না হয় কল লিস্ট দেখালেই সবাইকে বুঝাতে পারতাম। কিন্তু মোবাইল,চালু না হওয়া মানি আমার প্রমানের অভাব।
লোকটাকে বললাম,’আপনার বই আনতে আমিও যাবো’
লোকটা বলল “ঠিক আছে, আগে বিল্ টা দিয়ে নি। “
বিলদেওয়ার পর লোকটা হাটা দিলো, আমিও পেছন পেছন গেলাম। গাড়িতে উঠে লোকটা তার একটা বেগ নিয়ে হাটা দিলো। তার পকেটে আমার মোবাইল। আমি তাকে ডাক দিলাম।
‘ভাইয়া,
‘কে?’
বললাম ‘আমি…, কোথায় যাচ্ছেন আমার মোবাইল টা দেন?
লোকটা যেন আকাশ থেকে পরলো, বলে উঠলো,
‘কে তুমি, কিসের মোবাইলের কথা বলছো?।।
‘বাসে আপনাকে দিলাম, আপনি ঠিক করে দিবেন বললেন’
‘আরে ধুর, চিনিনা তোমাকে’
আমি বুঝলাম, বিশ্বাসের দুনিয়াটা খুব ছোট, লোকটা হাটা দিলো, আমি রাগে, ক্ষোবে , দুঃখে কিছুক্ষন কিছুই বলতে পারলাম না।
একজন পুলিশ পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, তাকে বললাম , ‘আঙ্কেল আমার মোবাইলটা ওই লোকটা নিয়ে যাচ্ছে’পুলিশ সহ লোকটার পেছন পেছন যেতেই লোকটা একটা বাজারে ঢুকে পরলো।
৩০ মিনিট পর।
লোকটাকে পাওয়া গেলোনা। সেই লোকটা যাকে ভাই বলে বিশ্বাস করেছিলাম। সেদিন মোবাইল হারানোতে যতটানা আঘাত পেয়েছিলাম, বিশ্বাসের দেওয়াল টা ভেঙ্গে যাওয়ায় তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অঝোর নয়নে কেঁদেছিলাম । সবাই হয়ত ভাবছিল মোবাইলের জন্য, কিন্তু আমি জানতাম আমি কাঁদছিলাম কারো উপরে ভরসা করতে পারছিলাম না বলে। চতুর্পাশের মানুষ গুলোকে মনে হচ্ছিল ভালো মানুষের মুখোশের অন্তরালে অবিশ্বাসের এক একটা দানব। সেদিনের পর থেকে কেও আমি তোমার ভাইয়ের মত, বা বোনের মত বললে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
আব্বু একটা কথা প্রায় বলে” বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,তর্কে বহুদুর’ । তাই মানুষ্ কে আজো বিশ্বাস করি, কিন্তু এখনো সেই ঘটনার আগে মানূষ কে যতটা আপন ভাবে নিতাম ,আর নিতে পারিনা। মানুষ খুবি জটিল,আবার খুবি সরল। মানুষ কে বোঝা মানুষের বড় দায়। তাই এখনো বিশ্বাস করি, তবে এ বিশ্বাসের সাথে মিশে থাকে এক শীতল সতর্কতা।