৪ মে, ১৯৫৩ সালে একজন শিশুর জন্ম হলো মৌলভিবাজারের বড়লেখার মিশন হাউজে। শিশুটির পিতার নাম মোহাম্মদ আব্দুস শুকুর , পেশাগত দিক দিয়ে তিনি ছিলেন ডাক্তার। ডাক্তারের ছেলে ছেলে ডাক্তার হবে বাবার এমন স্বপ্ন থাকতেই পারে, কিন্তু যে শিশু-আতাউল এর জন্ম হলো তাঁর নিয়তিতে হয়ত ভিন্ন কিছুই ছিলো।
মোহাম্মদ আতাউল করিমের শিক্ষাজীবনের শুরুটা হয় বড়লেখার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বড়লেখার বিখ্যাত পিসি হাই স্কুলে অধ্যয়ন শুরু করেন । ১৯৬৯ খৃস্টাব্দে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১ম শ্রেনীতে ৪র্থ স্থান অর্জন করেন চট্টগ্রাম বোর্ডে। সিলেটের এমসি কলেজে শুরু করেন উচ্চমাধ্যমিক অধ্যয়ন । সেখান থেকেই ১৯৭২ খৃস্টাব্দে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ১ম শ্রেনীতে ১ম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ধাপে ধাপে নিজেকে আরো অন্য উচ্চতায় নিতে থাকেন তিনি। তাঁর গন্তব্যে পৌছুতে তাঁর নিরলস জ্ঞান সাধনা চলে বা বলা ভালো নিয়তি তাঁকে নিজের দিকে টেনে নেয়। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে বি,এস,সি ( অনার্স) এর শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
১৯৭৬ সালে এই বিদ্যাপীঠ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বি,এসসি ( অনার্স) ডিগ্রী লাভ করেন। এর পর শুরু হয় বিদ্যার জন্য দূরত্বকে হারমানানোর পালা। তাঁর জ্ঞানকে আরো শানিত করার উদ্দেশ্যে অনার্স পরেই মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের পথে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স অফ সায়েন্স এবং এলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স অফ সায়েন্স এই দুই ক্ষেত্র সাফল্যের সাথে পার হন যথাক্রমে ১৯৭৮ এবং ১৯৭৯ সালে। এখানেই থেমে থাকেনি আতাউল করিমের বিদ্যার দৌড় । ১৯৮১ খৃস্টাব্দে ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি।
অধ্যয়ন শেষ করে শুরু করেন অধ্যাপকের কর্মজীবন। আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন শিক্ষা জীবনের শেষে -১৯৮২ খৃস্টাব্দে। উইচিটা স্টেট উনিভার্সিটিতে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাবে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৯৮৩ খৃস্টাব্দে । সেখানেই কর্মরত ছিলে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। ইউনিভার্সিটি অফ ডেইটনে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৯৮৬ সালে। ধীরে ধীরে তাঁর অভিজ্ঞতার মাত্রা বাড়তে থাকে । কর্মক্ষেত্রেও বৃদ্ধি পায় তাঁর সুনাম। তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন ১৯৮৮ সালে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সাফল্যের ধারা অক্ষুন্ন রেখে ১৯৯৩ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।
পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ববান ছিলেন তিনি। আতাউল করিম ডেইটন বিশ্ববিদ্যালয়েই ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এলেক্ট্রো-অপ্টিক্স প্রোগ্রামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সেখানে তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। ও’হিওর রাইট প্যাটার্সন বিমান ঘাটিতে এভিওনিক্স পরিচালক হিসেবে যোগদেন ১৯৮৮ সালে এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেখানে তিনি কর্মরত ছিলেন। তিনি টেনেসী বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদেন ১৯৯৮ সালে। সেখানে ২০০০ সাল পর্যন্ত কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তিনি সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদেন ২০০০ সালে। নিষ্ঠার সাথে তিনি তাঁর জীবনে সকল কাজু করেছেন এবং এর প্রতিদান ও পেয়েছেন। আতাউল করিম সিটি উনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের প্রকৌশলের ডিন হিসেবেও কর্মরত ছিলেন বেশ কিছুদিন। পরবর্তিতে ২০০৪ সালে আতাউল করিম, নরফোকে অবস্থিত ওল্ড ডোমিনিয়ন ইউনিভার্সিটির তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
১৮ টির মত বই তিনি রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত বইগুলো বিভিন্ন দেশে পাঠ্য-পুস্তক হিসেবে পড়ানো হয়।
তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলোঃ Electro-Optical Devices and Systems (1990), and Digital Design: Basic Concepts and Principles (2008), Optical Computing: An Introduction (1992), Electro-Optical Displays (1992),Continuous Signals and Systems with Matlab (2001, 2009),Digital Design: A Pragmatic Approach (1987) ।
“ফাইবার অপটিক কাপলিং সিস্টেম”( ১৯৮৯), “ট্রাইনারী এসোসিয়েটিভ মেমোরী”( ১৯৯৩) তাঁর আবিষ্কারের দুটো উল্লেখযোগ্য পেটেন্ট । শুধু কি তাই? তাঁর অধীনে ৫৭ জনের ও অধীক শিক্ষার্থী মাস্টার্স ও ডক্টরেট পর্যায়ে গবেষনার প্রতিবেদন রচনা করছে। তাঁর প্রকাশিত লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ “বিবর্তন কাহিনী”, এবং “সাম্প্রতিক” ।
ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন কম্পিউটার এন্ড ইনফরমেশন টেকনোলজির আয়োজন বাংলাদেশের জন্য তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান বলে পরিগণিত হয়। এই সম্মেলনের ফলে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা তাঁদের কাজ ও উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে, তথা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলে ধরতে পারছেন।
তাঁর গবেষনার বিষয় সমূহের মধ্যে অন্যতম -বায়োফিজিক্স, ম্যাগ্লেভ ট্রেন, প্যাটার্ন রিকগনিশন , অপটিকাল ও হাইব্রিড ইলেক্ট্রো অপ্টিকাল সিস্টেম ডিজাইন, অপটিকাল কম্পিউটিং, ইলেক্ট্রো অপটিকাল ডিস্প্ল্যাজ, ননলিয়ার ইমেজ প্রসেসিং ইত্যাদি। তাঁর গবেষনা সাফল্যের মুখ দেখায়, এবং এর আরো অগ্রগতির জন্য অর্থ ব্যয় করছে যুক্ত্রাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগ , রাইট প্যাটার্সন ল্যাবরেটরি , মার্কিন সেনাবাহিনী, অপটিক্যাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটস, ন্যাভাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি সহ প্রথম সারির সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো।
দেশের বাইরে থেকেও যারা দেশের জন্য অবদান রাখছেন তাঁদের মধ্যে আতাউল করিম অন্যতম।