তখন ছোট ছিলাম অনেক। সে সময়ের যা স্মৃতি মনে আসে তাঁর কিছুটা ঝাপসা । যেন রংবেরং এর এক মায়াবী স্বপ্নের উপর হালকা কুয়াশার চাদর। অতীত আমাকে বার বার ফিরিয়ে নেয় তাঁর কাছে, আর বাস্তবতা হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে আসে বর্তমানের কাছে।
বর্ষাকাল ছিলো তখন। আমি শিশুতোষ আনন্দ আহরণে ব্যাস্ত। দিনটা শুরু হয়েছিলো ঝুম বৃষ্টি দিয়ে, দুপুর গড়াতেই রোদের ছড়াছড়ি। যেন কাল মেঘ ভেদ করে সূর্যের অরুণ দ্যুতির আগমন । যদ্দুর মনে পড়ে বাসায় ছিলাম -আমি, আম্মু আর আমার একজন খালা। আপু ছিলো স্কুলে। অন্যরা কাজে। সকাল থেকে বাইরে ছুটাছুটি শেষে বাসায় ঢুকলাম। সেই সময় ছুটাছুটি বলতে যা বোঝায় -বাসার বাইরেই আঙ্গিনায় হরদম দৌড়াদৌড়ি ।
দু-দিন ধরেই এই সময় একটা নিদ্দৃষ্ট ফেরি ওয়ালা কে দেখতাম গেইটের বাইরে। এইদিন ফেরি ওয়ালা নয় বরং খাকি কাপড় পরিধানে এক আগুন্তকের আগমন ঘটলো,হাতে কালো ব্যাগ। লোকটাকে বাসার দিতে অগ্রসর হতে দেখেই আমি পেছনের দরজা দিয়ে ছুটে বাসায় গেলাম। মনের মধ্যে কেনো জানি কু ডাকছিলো।
কেউ একজন দরজায় টোকা দিলো। বাসার কাজের মেয়ে নাম-জিজ্ঞেস না করেই হুট করে দরজা খুলে দিতেই দেখলাম লোকটা। খাকি কাপড় পরিধানে। লোকটা একটা সালাম দিয়ে বলল সে একটা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। কিছু কথা বলবে। কথা বার্তায় বেশ ভদ্র। কাজের মেয়ে বসতে বলল, আম্মু এসে এটা দেখার পরে কিছুটা বিরক্ত হলো। লোকটা সোফায় বসে নানা -কাহিনী বলা শুরু করলো। আমি আম্মুর পেছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে মা বলেছিলো তাঁর শুরু থেকেই অস্বস্তি লাগছিলো, কিন্তু দুপুর আর আমি ছোট বিধায় হুট করে বলতে পারছিলোনা, চলে যান। খারাপ লোক হয়ে থাকলে নিশ্চই প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।
এখন চিন্তা করছি, আসলেই দুপুর বেলা সেই জায়গা ডাকাতির জন্য আদর্শ ছিলো । এখন জন-বসতি বাড়লেও তখন এতটা ছিলোনা।
আম্মু সতর্ক চোখ রাখছিলো। লোকটা অস্বস্তিতে বার বার বাইরে তাকাচ্ছিলো। আর নিজের হাতে ধরা কালো ব্যাগটার দিকে। ইতিমধ্যে আম্মু চা বানাবার নাম করে সামনের রুম থেকে আড়ালে গিয়ে কাজের মেয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে পেছনের দরজা দিয়ে তানভীর মামা কে ডাকতে। আম্মু এসে আবার বসলেন। লোকটা নিজের কালো ব্যাগটা বারবার খুলতে চাইছিলো,আম্মু সেদিকে কড়া ভাবে চাইতেই হাত সরিয়ে নিচ্ছিলো। বেশ বোঝা যাচ্ছিলো লোকটা কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছে। ব্যাগে অস্ত্র থাকা বা আশেপাশের সাঙ্গপাঙ্গ দের ডাকার ব্যবস্থা ছিলো হয়তবা।
তানভীর মামা ঢুকলেন এসময়। লোকটা কিছুটা ইতস্তত করলো । তানভীর মামার ছিলো প্রচন্ড রাগ । তিনি ছোট-খাট পরিস্থিতে তেলে বেগুনে জবলে উঠতেন। আর নিশ্চই কাজের মেয়েটা তাঁকে এক-কাঠি বাড়িয়েই বলেছে। তিনি শুধু রাগলেনই না, হুমকি-ধমকি দিয়ে একটা পরিবেশ তৈরি করলেন যেটা খাকি পোশাক পরা লোকটার জন্য মোটেও বাঞ্চনীয় ছিলোনা। লোকটা সময় থাকতে কেটে পড়লো। গেটের কাছ থেকে টেক্সির ইঞ্জিন স্টার্ট এর শব্দ শুনে বুঝলাম কোম্পানীর প্রচারের জন্য লোকটা বেশ ভালোই সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসেছিলো।
পরে শুনেছিলাম, একি এলাকায় দুপুর বেলায় একটা ডাকাতি হয়। ডাকাতির আগে নাকি একটা ফেরিওয়ালা কে বার বার দেখা যেত সেই বাড়ির আশেপাশে । ডাকাতির পরে, এখন আর তাঁর টিকিটির ও দেখা মেলেনা। সেদিনের সেই মানুষ কি ডাকু ছিলো নাকি আসলেই কোন কোম্পানীর প্রচারের জন্য এসেছিলো জানা নেই, আজীবন রহস্য হয়েই থাকবে।
হয়ত ব্যাগ থেকে কোম্পানীর প্রচার বানী-ই বের করতে চাইছিলো । কে জানে!