সংস্কৃতে একটা কথা আছে “পতির পূণ্যে স্বতীর সিদ্ধি। আমার দরকার উল্টোটা। স্বতীর পূণ্যে পতির সিদ্ধি।” কথাগুলো বলতে বলতে বইয়ে ঠাসা ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। সাথে তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া ইসলাম। সার্সন রোডের এই অংশে আমার আগে কখনও আসা হয়নি। এলিটদের এলাকায় যে একজন বিজ্ঞানী থাকে জানতামও না। সহজেই খুঁজে পেলাম পূরোন তিনতলা দালানটা। এপয়েন্টেড টাইমেই এসে অপেক্ষা করছি পুরোন আসবাব আর নতুন পুরোন বইয়ে ঠাসা ড্রয়িং রুমে। মিনিট পাঁচেক পরে এলেন বিজ্ঞানী। বসিয়ে রাখার জন্য দূ:খ প্রকাশ করে ব্যাখ্যা করলেন সংস্কৃত শ্লোক আওড়ানোর কারণ। রমজান মাস চলছে, অসুস্থ থাকায় কয়েকটা রোজা রাখতে পারেননি। কিন্তু তাঁর স্ত্রী নিয়মিত রাখছেন রোজা। বিজ্ঞানীর প্রার্থনা, স্ত্রীর গুনে যদি আল্লাহ তাঁর রোজা না রাখতে পারার গুনাহ মাফ করেন।
মহাবিশ্বের ভবিষ্যত নিয়ে গানিতিকি ব্যাখ্যার বই লিখে যিনি বিখ্যাত, তাঁর সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে কিছুটা নার্ভাসই ছিলাম। আমার কর্মস্থল সানসাইন গ্রামার স্কূল এন্ড কলেজের ছেলেমেয়েরা পরিবেশ সচেতনতায় “আর্থ ক্লাব” গঠন করে। সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থ ক্লাব গুলোর মধ্যে পরিবেশ রক্ষায় প্রজেক্ট পরিকল্পনা চাওয়া হয়। সবচেয়ে ভাল প্রজেক্টে ফাইনেন্স করবে আমেরিকান দূতাবাস। অন্যান্য ক্ষেত্রের মত এখানেও ভাল করে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা। দূটো প্রজেক্ট নির্বাচিত হয় – একটি সানশাইনের আরেকটি ঢাকার এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। এই সাফল্যের খ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে পরে যে, স্বয়ং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রি জিম মুর আমাদের কাজ দেখতে সানশাইন গ্রামার স্কুলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। আমেরিকান মন্ত্রি আসবেন আমাদের সাথে পরিবেশ আর বিশ্বের ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলতে আর আমাদের কেউ কিছু বলবে না তাতো হবে না। আমাদের শহরেও তো আছেন এমন বিজ্ঞানি যিনি মহাবিশ্বের পরিণাম নিয়ে মৌলিক গবেষণা করেছেন।
ফোনেই দাওয়াত গ্রহণ করেছিলেন, তারপরও ভাবলাম একবার গিয়ে দেখা করি। তাঁর গবেষণার বিষয় তাত্বিক পদার্থবিদ্যায় আমার জ্ঞান শূন্যের নিচে। সংস্কৃত শ্লোক দিয়ে শুরু আলোচনা সাহিত্যের দিকে আগানোয় কিছুটা নিরাপদ বোধ করলাম। তবে অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম বিশ্বসাহিত্যে তাঁর পড়াশুনার ধারেকাছে আমি নেই। অসাধারণ মূগ্ধতায় শুনছিলাম কথা। বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী, তাঁর স্ত্রী আর আমি, অতি সাধারণ একজন শিক্ষক। বিদেশে তাঁর পড়াশুনা, গবেষনা, শিক্ষকতা সম্মর্কে জানতে চাইলাম। হেঁসে বললেন তাঁর দুই মেয়ের জন্ম পৃথিবীর সেরা দুই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে – প্রিন্সটন আর মেরিল্যান্ড। দেশে ফিরে আসা প্রসঙ্গে বললেন তাঁর গবেষনায় বিদেশে থাকার প্রয়োজন নেই। বললাম বিদেশের মায়া ছেড়েতো আমাদের মেধাবিরা তাঁর মত ফিরে আসে না। তিনি মেধাবিদের দোষ দিতে চাইলেন না। বললেন তাঁর নিজের এবং পরিবারের শক্ত অর্থিক ভিত্তি থাকায় তাঁর ফিরে আসতে সমস্যা হয় নি। সবার ক্ষেত্রে এমনটা না। তাছাড়া আমরা আমাদের মেধাবিদের জন্য কর্মক্ষেত্রও তৈরি করতে পারিনি। মনে মনে ভাবলাম এই বিজ্ঞানীকেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি দিতে অনেক টালবাহানা করেছে। শেষমেশ তাঁর পছন্দের পদার্থবিদ্যার পরিবর্তে গনিত ডিপার্টমেন্টে জায়গা হয়েছে। এদেশে মেধাবিরা আসবে কিভাবে? পত্রিকায় পড়েছি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভিসির পরিবারের আটজন শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি ভিসি থাকা অবস্থায়। যাদের মধ্যে তাঁর শ্যালিকা আর শ্যালিকার স্বামীও আছেন। কোন এক রসিক বলেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে হলে এখন ক্লাসে প্রথম হওয়ার চেষ্টা না করে ভিসি মশাইর শ্যালিকার পেছনে ঘুরলেই ভাল।
বিজ্ঞানীর সাথে আলাপ চলতে থাকে। ধর্ম, দর্শন, সমাজ নিয়ে অনেক স্বপ্ন তাঁর। একাত্তরে লন্ডনে ছিলেন। বৃটিশ সরকারের কাছে চিঠি লিখে সোচ্চার হয়েছিলেন স্বাধীনতার দাবিতে। এখনো শেষ হয়ে যায়নি দেশ নিয়ে তাঁর স্বপ্ন। শিক্ষা ব্যাস্থার ত্রুটি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। জাতীয় শিক্ষা্ক্রমের আধুনিকায়ন ছাড়া যে অগ্রগতি সম্ভব নয় বারবার বললেন। অন্যসব বিজ্ঞানীর মত তাঁরও কিছুটা পাগলামি আছে। কম্পিউটারতো ব্যবহার করেনইনা, এমনকি ক্যালকুলেটরও না। জানতে চাইলে বলেন জটিল অন্ক নিজে করলে ব্রেনের চর্চা হয়। বুঝলাম আমাদের শুন্য জ্ঞানের কারণেই জ্ঞানীদের পাগল মনে হয়।
ভর দূপুরে এসেছিলাম এখন সন্ধা। অপরিচিত একজনকে অনেক সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে উঠলাম্। সাথে ইফতার করার আমন্ত্রন জানালেন। অর্থ বিত্ত মেধা – কোনভাবেই আমি তাঁর সমকক্ষ নই জানি তবু আলাপনে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না। মাটির মানুষ তিনি – প্রকৃত জ্ঞানের সাধক।
যথাসময়ে অনুষ্ঠাসস্থলে আসলেন বিজ্ঞানী। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশেরে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রিও আসলেন ঘরির কাঁটা ধরে নির্ধারিত সময়ে – সামনে পেছনে গাড়ী নেই, নিরাপত্তার অহেতুক বাড়াবাড়ি নেই। নির্ধারিত সময়ে শুরু হল অনুষ্ঠান। মার্কিন মন্ত্রির বক্তৃতার আগেই বক্তৃতা দিলেন বিজ্ঞানী। তুলে ধরলেন বর্তমান বিশ্বের করুন অবস্থা। পরিবেশ বিপর্য়য়ে মার্কিন সরকারেরও ভূমিকা আছে সেটি বলতেও ভুললেন না। ভাবলাম মন্ত্রী মহোদয় রেগে যাবেন। কিন্তু না, তিনিতো একটি গনতান্ত্রিক দেশের মন্ত্রি। মনযোগ দিয়ে শুনলেন বিজ্ঞানীর কথা। নিজের বক্তৃতায় ধন্যবাদও দিলেন তাঁকে।
জামাল নজরুল ইসলামদের মত প্রতিভাদের আমরা ডেকে আনিনি। দেশের টানে কেউ কেউ নিজেরাই ছুটে আসেন। এরা জ্ঞান সাধক – অর্থ বিত্ত ক্ষমতার মোহ নেই। তারপরও এদের আমরা ভয় পাই। যদি কোনভাবে এরা জাতিকে শিক্ষিত করে ফেলে। নীল সাদা হলুদের ভাগ বাটোয়ারায় যারা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক শুন্যতায় ঠেলে দিচ্ছেন, তাঁদের গদি যে উল্টে যাবে।