একজন মানুষের জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে । অনেকের জীবনের প্রদীপ শিখা হঠাৎ নিভে যায়, অনেকের নিভতে নিভতে আবার আশার প্রদীপ জ্বলে । হাফসার বাবা জিয়া উদ্দীন তালুকদার জানতেন না ,তার সদ্য জন্ম হওয়া সন্তানের ক্ষেত্রে কি ঘটবে। তিনি তার চেষ্টা টা অন্তত করেছেন ।
এটা যখনের কথা তখনো হাফসার নামকরন হয়নি, একটা সদ্য জন্ম হওয়া শিশুর নাম করন হতে কিছুটা সময় লাগে। যদিও বা আগে থেকে ঠিক করা থাকে তবুও আকিকা করে নাম রাখতে কিছুদিন সময় তো লাগে। একটা শিশুর জন্ম হলো, জিয়া উদ্দীন বাবা হলেন ,কিন্তু খুশির বদলে কোথায় যেন একটা হাহাকার,একটা কালোছায়া । যে শিশুর জন্ম হলো তাকে নিয়ে সবাই যখন আনন্দ করার কথা, ফুটফুটে শিশুর নাম করন করার কথা, সে সময় শিশুটি ভুগছে প্রি ম্যাচিউর বার্থ এর সমস্যায়।
হায়! একটি ফুটফুটে শিশুর কান্নায়-হাসিতে মুখরিত না হয়ে তাদের পরিবার শিশুটির জীবনের জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে, যখন শিশুটির জন্যে নতুন জামা কেনার কথা, তখন শিশুটি চিটাগং মেডিকেলের শিশুদের জন্যে রাখা আলাদা কক্ষে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এত টুকু শরীরে তার রক্তের বড় অভাব । নিয়মিত রক্ত না পেলে হয়ত বাচবেনা, বা রক্তের প্রয়োজন মিটলেও একমাত্র সৃষ্টি কর্তাই পারেন তাকে সুন্দর জীবন উপহার দিতে।
হন্যে হয়ে জিয়া উদ্দিনরা যখন শিশুটির রক্তের প্রয়োজন মেটাতে সবার কাছে বলছে, তখনো ফুটফুটে শিশুটির জীবন অনিশ্চিয়তার দোলায় দুলছিলো। জিয়া উদ্দিনের সাথে পরিচয় হয় একজন রক্ত দাতার। সে রক্ত দাতা মনে করেছিলো একবার রক্ত দিবে, এর পর কাজটা শেষ। সে এম্নিতেই ৩ মাস অন্তর রক্ত দেয়। কিন্তু বিধাতার স্ট্রেটেজি ছিলো অন্যরকম, একটি অচেনা শিশুর সাথে জড়িয়ে গেলো একজন সদ্য যৌবনে পা রাখা ছেলের জীবন। ৪০/৫০ এম.এল করে বছরের মধ্যে ৪/৫ বারের উপর সেই শিশুটিকে ব্লাড দিতে হলো।
সেই ডোনার সে বছরটায় আর কাওকে ব্লাড দিতে পারেনি। ছোট্ট শিশুটার কথা ভেবে আর কাওকে ব্লাড দেয়নি। যখনি বাচাটার ব্লাড লাগতো, সেই একি ডোনার হাজির। এদিকে হাফসার বাবার মুখে অন্ধকারের ছায়া যেন সরছেই না। অনেকবার ব্লাড দেওয়ার পর ও ডাক্তার বলছেন, আবার লাগতে পারে। জিয়া উদ্দিন থেমে নেই, আপ্রান চেষ্টা চলছে তার । বাচ্চাটার রক্তদাতা হয়ত সেদিন বুঝতে পেরিছিলো, মা-বাবা হওয়া কতটা আনন্দের আবার কতটা কষ্টের ।
রক্ত দাতা প্রতিক্ষার প্রহর গুনছিলো, বাচ্চাটার এই যন্ত্রনার হয়ত একদিন অবসান হবে, এককদিন হয়ত বাচ্চাটা হেসে উঠবে, তার সাথে হাসাবে সবাইকে। রক্তদাতা যে ঘন ঘন রক্ত দিতে গিয়ে মাঝ খানে বিরক্ত হয়নি এমন্টাও নয়। কিন্তু যখন ৩য় বার রক্ত দেওয়ার পর বাচ্চাটাকে , নিঃসাড় পড়ে থাকতে দেখলো, ফুটফুটে ফুল্টার মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেখলো, ছোট শরীরের যন্ত্রনা দেখলো, আর চলে আসার সময় বাচ্চাটার চোখের পাপড়ি যখন নড়ে উঠে দেখলো, ততক্ষনে ডোনারের সীদ্ধান্ত নেওয়া শেষ, এই বাচ্চার যতদিন রক্ত লাগে ,যতবার রক্ত লাগে সে দিবে ।
বাচ্চাটার জন্যে সবাই যুদ্ধ করছিলো। বাচ্চাটা কি জানত ? হয়ত বুঝতে পেরিছিলো কোমল হৃদয়ে , তাকে নিয়ে সবার উদ্বেগ , জল্পনা-কল্পনা। শিশুটা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে আসে নি । সৃষ্টিকর্তা তাকে হয়তবা আলাদা ভাবেই রহমত করেছিলেন। তাইতো, যে ফুলের মুখে হাসি নেই, জন্মের পর থেকে যে বাচ্চা মৃত্যুর সাথে লড়ছে, সেই শিশু ও তার পরিবার হাল ছাড়েনা।
রক্তদাতা অপেক্ষায় ছিলো,কখন বাচ্চাটার একটা ভালো খবর শুনবে, শুনবে বাচ্চাটার আর লাইফ সাপোর্টের দরকার হবেনা, বাচ্চাটা সুস্থ। একদিন সেই খবর এলো, ডোনার চোখ দিয়ে অজান্তে অশ্রুকনারা নেমে এলো ,ছুয়ে দিলো তার হৃদয়কে । বাচ্চাটাকে এর পর ডোনার আর দেখেন নি।কিন্তু যেদিন শুনেছিলো বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর যেদিন শুনলো,বাচ্চাটাকে বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ,কারন শিশুটা এখন সুস্থ সেদিন রক্তদাতার কোথায় যেন একটা টান লেগেছিলো, মনে হচ্ছিলো আপন কেও ,রক্তের কেও দূরে চলে যাচ্ছে।হাফসার বাবার সাথে পরবর্তিতে রক্তদাতার একটা বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, সে কথা অন্যদিন বলবো ।
বাচ্চাটা ধীরে ধীরে বড় হবে, তার শরীরে রক্তদাতার রক্ত নিয়ে বাচ্চাটা বেড়ে উঠবে, ভাবতে ভাবতেই রক্তদাতার গাল বেয়ে আবার অশ্রুধারা নেমে আসে, এই আনন্দের অশ্রু লুকানোর নয়, আবার কাওকে বুঝাবার ও নয়।
জন্ম সম্পর্কিত আরো লেখা পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-
একজন মজলুম জননেতার জন্ম ও কিছু কথা