আজ লেখার খুব ইচ্ছে হল। কী নিয়ে লিখবো ভাবতে ভাবতে ” জীবন ” নিয়ে লেখার আগ্রহ পেলাম।
জীবন ইংরেজিতে যাকে বলে Life!
” Men with feelings, works, happiness, worse, duties, responsibility, youth, waiting for being older & die is a life.”
আমাদের জীবন ভাবার জন্য অনেক বড় একটা বিষয়। এইখানে আপনি পাবেন দুনিয়াতে আসার পূর্ববর্তী জীবন, এর মধ্যকার জীবন, এর পরবর্তী জীবন। এর বাহার দেখতে গিয়ে আপনার মাথা হয়তো ক্রাশ করতে পারে। তাই আপনার হয়ে আমিই বলছি এই বিচিত্র জীবনের চরিত্রঃ
সন্তানঃ যখন মায়ের গর্ভে আস্তে আস্তে বড় হয়ে পরিপূর্ণ সময়ে পৃথিবীতে আসে তাকে বলা হয় শিশুসন্তান। তারপর শুরু হয় পৃথিবীময় অধ্যায়।
গর্ভপাত হবার পর থেকেই একটি জীবনের শিশুসন্তান জীবনের শুরু। এই জীবনে সে বাবা মায়ের কোলে কোলে চড়ে বেড়ায়, রঙ্গীন সব খেলনার রঙ্গে মত্ত থাকে, মা-বাবা, আত্মীয় স্বজনের নানারকম আদুরে বুলি শুনি, খিদার অভাবে চিৎকার করতে শিখে, মায়ের কোলেই শান্তি খুঁজে পায়।
তারপর সে এক মাস দু মাস করে নতুন বয়সের দিকে পা বাড়ায়।
তখন আমাদের শৈশবের স্কুল জীবন শুরু হত ছয় কিংবা সাত বছরে গিয়ে। আজকাল তো বাবা মায়েরা আদর দিয়ে সময় নষ্ট করতে চায় না।
আড়াই তিন বছরেই ভর্তি করিয়ে দেয় স্কুলে।
তারপর শুরু হয় তার স্কুল জীবন নতুন কিছু শিখতে জোর প্রচেষ্টা নানা কৌশলে।
অনেকেই এই বয়সে থিতু হয়ে যায়। আর যাদের কপালে লিখাই থাকে সে টেনেটুনে পাস করবে সে সেভাবেই থাকে।
এভাবে এক একটি দরজা পেরিয়ে তারা পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি, আরো কয়েক ডজন ট্রেডের বস্তাভর্তি সার্টিফিকেট সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। এরমধ্যে প্রত্যেকটা সার্টিফিকেট তার যোগ্যতা প্রমানের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত হয়।
এরসাথে কারো পরিবারের মানসম্মান জড়িত, কারো আবার দারিদ্রতা বিমোচনের চাবিকাঠি।
এরপর আসে চাকুরী জীবন।
আমাদের দেশে ভালো চাকুরীতে মেয়ে দেয়া হয়।
নয়তো ” সামনে এগিয়ে আবার চেষ্টা করুন ” এরকম একটা সাইনবোর্ড দেখা যায় মেয়ের বাবার চেহারায়।
তারপর আসে টাকাপয়সা,
বংশ-প্রতিপত্তি, শারীরিক কাঠামো। সবকিছু ঠিক থাকলে সেই সন্তান জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে বিয়ের তোরণের নিচ দিয়ে ঢুকার পর।
এখান থেকে শুরু হয় স্বামী স্ত্রীর জীবনের সূত্রপাত। আসুন দেখি এই জীবনে কি চলে।
স্বামী-স্ত্রীর জীবনঃ বিয়ের বাসর ঘর থেকে শুরু হয় এই ভিন্ন ভিন্ন জীবনের একটি রূপ।
এখানে বিয়েটা আসলে একটা পারস্পারিক সমঝোতা।
যে যাকে যতটা সেক্রিফাইস করে মেনে চলতে পারবে সেই সম্পর্কটা তত মজবুত।
আজকালকার বিয়ে তো ছোটবেলার বৌ-জামাই খেলার মত অনেকাংশে।
তা দেখে আমার মনে হয়..
সকালবেলা বিয়ে হল
বিকেলবেলা শেষ
তুমি তোমার
আমি আমার
এইতো আছি বেশ।
কিন্তু চিরাচরিত সমাজব্যবস্থা হতে আমরা দেখি একটি বউ অনেক দায়িত্বের সমাবেশ।
গ্রামের বধুর জীবন আর শহুরে বউয়ের জীবনে কিন্তু তেমন ফারাক নেই। গাঁয়ের বধু ভোর সকালবেলা উঠে উঠোন ঝাড়ু দেয়, থালাবাসন ধোয়, ভাত তরকারি রান্না করে, হাতে সময় আর মনে ইচ্ছে থাকলে কোনো এক পদের পিঠা বানিয়ে ফেলে।
তারপর স্বামীকে গিয়ে মাঠে সকালের ভাত দিয়ে আসে, গরু ছাগল দেখাশোনা করা, সন্তানদের পড়ালেখার জন্য জোড় দেয়া শ্বশুর শাশুড়ির যত্ন খাতির করা এই জীবন।
এরমধ্যে যদি ফসল উঠে ঘরে তবে তো কথাই নেই, রোজ মাঝরাত হয়ে যায় এই কাজ শেষ করতে।
শহরে বউ কিন্তু তখন প্ল্যানিং করছে কালকের বাজারটা কত কম খরচে করলে মাসটা পোষাতে পারবে।
শহুরে স্বামীরা আজকাল পরিবারের দায়িত্ব বলতে হাতেগোনা দু-একটা কাজ করে।
তবে তার দায়িত্ব কম নয়।
শহুরে বউ সকালবেলা উঠে, নাস্তা বানায়, বাচ্চাদের টিফিন, হাজবেন্ডের লাঞ্চ, বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসার পথে বেছে বেছে খরচ মিলিয়ে বাজার করে আনা।
তাদের এই বিশ্লেষণ দেখে তরকারীওয়ালা স্তব্ধ হয়ে যায়, কাঁচা মরিচ নিবে পাঁচ টাকার কিন্তু ভাঙ্গা কাঁচামরিচটা নিবে না,
আলু নিবে এক কেজি কিন্তু বড় সাইজের না মাঝারি সাইজের,
বেছে বেছে মাঝারী সাইজের নিবে যাতে বেশী পড়ে।
পেয়াজ ছোটটা নিবে না বড়টা নিবে কাটতে কষ্ট হয়।
ধনেপাতা ২টাকার নিবে বেশী নিলে পঁচে যায়।
এভাবেই তরকারীওয়ালা তার পন্য বিক্রয় করে সেই শহুরে বউয়ের কাছে। পিছন দিকে অনেক কিছুই বলে কিন্তু শহুরে বউ দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলে বাসার দিকে।
ঘরদোর পরিষ্কার, কাপড়-চোপড় ধোয়া, শুকাতে দেয়া, বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনা, খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়ানো, শুকনা কাপড়গুলো ভাজ করা, বাচ্চার প্রাইভেট টিউটর এর নাস্তা, এভাবেই কেটে যায় জীবন।
গায়ের বধু আর শহুরে বউয়ের জীবন শুনে একটু খটকা লাগতে পারে লেখক শুধু মেয়েদের নিয়েই লিখলো পুরুষদের কি জীবন নাই!!
আছে তারা হল সমাজের কর্তৃপক্ষ।
তাই তাদের টা পরেই বলছি।
গাঁয়ের চাষা,দিনমজুর জামাই আর শহরের কর্পোরেট হাজবেন্ডের মাঝে ফারাক শুধু পোষাকে।
গাঁয়ের জামাই খালি গায়ে কাছা মারা লুঙ্গী পরে মাঠে
কাজ করে আর শহুরে হাজবেন্ড শার্ট-প্যান্ট টাই পরে অফিসে কাজ করে।
গাঁয়ের জামাই খাদ্যপন্য উৎপাদনে রত থাকে শহুরে হাজবেন্ড তার সুষম বন্টন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে।
আসুন দেখি গাঁয়ের জামাইটি কি করেঃ
রোজ সকালে দুটা পান্তা ভাত আর পোঁড়া মরিচ খেয়ে মাঠে চলে যায়। তারপর সারাদিন ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত।
সারা দিনরাত মেহনত করে ফসল ফলাতে ব্যস্ত। আবহমনকাল ধরে কৃষক সম্প্রদায় ফসল ফলিয়েই আসছে। তাদের উদ্ধৃত ফসল বাজারে গিয়ে পাইকারদের হাতে তুলে দিচ্ছে।
আর পাইকারদের হাত দিয়েই আমরা পাচ্ছি হরেক ধরনের খাদ্য। বাজারে গেলেই দেখা যায় আমরা কোথায় থেকে কি পাচ্ছি। বিক্রমপুরে আলু উৎপাদন হচ্ছে আর আমরা বাসায় বসে সস দিয়ে সেই আলুর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছি। মুদি দোকানে গিয়ে বলি ভালো থেকে চাল দেন, ডাল চিকন টা দেন, পেঁয়াজ দেশীটা দেন। কখনো এটা বলিনা দিনাজপুরের কুদ্দুস চাষার চালটা দেন, নারায়ণগঞ্জের শ্যামলের ক্ষেতির চিকন ডালটা দেন, বা রফিকের ক্ষেতির পেঁয়াজটা দেন। আসলে এভাবে কেউ কোনোদিন বলবেও না।
কী অদ্ভুত এই কৃষক জীবনের !
শহুরে হাজবেন্ড তো মহাব্যস্ত লোক। আপাদমস্তক টাই শার্ট প্যান্টে পুরোদস্তুর সাহেব বাবু। এটা তার ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক।
সকালের ৭টার অফিসের বাস ধরতে সাড়ে পাঁচটায় তার ঘুম ভাঙ্গাতেই হয়। ঘুমের রাজকীয় একটা মুডকে জলাঞ্জলি দিয়ে যত দ্রুত স্টপেজ দাঁড়াতে পারে ততই লাভের। বস অফিসে হাজির হলে মনে সংশয় নেই আজ কিছু একটা হতে চলেছে।
সাহেব বাবুর মত ফিটফাট হয়ে চললে মানুষ ধরতেই পারে না যে শহুরে হাজবেন্ড কয়েক ডজন হুমকি বুকের ভিতর নিয়ে ঘুরে।
কর্পোরেট বসের হুমকি কোনো মাফিয়া ডন দেয় কিনা সন্দেহ আছে।
এসব তো তার অফিসের কথা।
তাকে ঘিরে পরিবারের গল্পটা আরো কষ্টের।
আজকাল ২০/২৫ হাজার টাকার চাকরিতে, ঘর ভাড়া, গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল, ডিশ বিল, বুয়া বিল, বাচ্চাদের স্কুলের ফিস, বাজার বিল, মেডিসিন, এর বাইরে আছে ভাইবোনের দেখাশোনা, পড়াশোনা, হাতখরচা, মাবাবার জন্য ঔষধ আরো কত পদের খরচ এই সীমিত বেতনে।
এইসব কিছু করার মাঝে নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা। সে এক বিশাল ব্যাপার। তাদের জায়গায় না দাঁড়ালে কর্পোরেট হাজবেন্ডের জীবনের গুরুত্ব বোঝা যাবে না।
এইভাবেই কিছু জীবনের গল্প আছে যা আমরা রোজ দেখি, হয়তো ভাবার মত ভাবিনা। কত শত সহস্র জীবনের গল্প হেঁটে বেড়ায় অলি গলিতে, বড় রাস্তার মোড়ে-মোড়ে, ছেঁড়া স্যান্ডেলে, দামী সোসাইটির ডাস্টবিনে। অন্যকোন দিন লিখবো সেই জীবন নিয়ে।