জীবনের কিছু আফসোস আর কিছু প্রাপ্তির গল্প

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

একটা মানুষকে প্রথম দেখায় জানা যায়না, বোঝা যায়না তাঁর পরিচয়। অথবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটা মানুষকে  শুধু চেনার চেষ্টা করেই যেতে হয়। এই ভবের বাজারে মানুষ চেনা বড় দায়।

 

প্রথম দিন দপ্তরে ঢুকলাম। রান্নাঘরের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় চোখে  পরলো মাথায় ক্যাপ টাইপের কি যেনো আর কোমরে লুঙ্গির উপর গামছা পেচিয়ে তিনি রান্নায় মশগুল। প্রথম দেখেই মনে হলে এই লোক কথা কম বলে।  সেদিন তাঁর আর টিকিটিরও দেখা পেলাম না। এর পর আমি কিছুদিন বাদে জিনিশ পত্র নিয়ে উঠে আসলাম অফিসের পাশের রুমে। রুমের ভেতর বসে থাকি, কাজ করি ,রুমেই থাকি  বেশির ভাগ সময় টা । ভাতের টাইমে দরজা খুলি , হাফিয ভাই এসে খাবার দিয়ে যায়, আর প্রতিবার জিজ্ঞেস করে “কেমন হইসে”    । তাঁর রান্নার হাত বেশ ভালো, মাঝে মাঝে খাবারের মালমশলায় গন্ডগোল হয় । মাঝে মাঝে লবন একটু কম বেশি হলে আর বলিনা । সবদিন তো আর সমান যায়না।

হাফিয ভাই এর সাথে খাবারে বাইরে কথা কম হত। আর তাঁর খাবার বেড়ে দেবার ধরন মাশাল্লাহ। এক টুকরা গোস্ত, দুই টুকরা আলু, আর এক চামচ ঝোল ।  বোধকরি সবাইকে এক মাপে ঝোল তরকারি দেওয়ার ইচ্ছে তাঁর। মাঝে মাঝেই অবশ্য তা হয়ে ওঠেনা। কম বেশি হয়েই যায়। তবে তাঁর চেষ্টা প্রশংসার যোগ্য। তাঁর প্রতি একটাই আকুতি , থাকে এখন আমার , “আরেকটু ঝোল আর এক পিস আলু দেয়া যায় না?” হাফিয ভাই এর সাথে দেখা হওয়ার পর মাঝে মাঝে এক আধবার ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা হলেও তাঁর জীবন সম্পর্কে থেকে গিয়েছিলাম অগোচরে । একদিন  কথায় কথায় অনেক কথা হলো, সে কথার ফাকফুড় গলে তাঁর জীবনের নানা কথা বেরিয়ে এলো।

তাঁর গ্রামের বাড়ি হোগলা বুনিয়া ,পিরোজপুর জেলায় । একটা মানুষ কে প্রথম দেখায় চেনা যায়না, বা সারাজীবনেও চেনা যায় না।  প্রথম যেদিন হাফিয ভাই এর সাথে সাক্ষাত হয়েছিল সেদিন উনি কেমন আমি বুঝতে পারার কথা না। এতদিন পরে অনেক জানার পরেও সম্পূর্ন বোঝার ক্ষমতা নেই আমার। সবকিছু একমাত্র আল্লাহ জানেন। বলছিলাম হাফিয ভাই এর কথা। তার সাথে কথা বলে মনে হয়েছে তার জীবনের সম্পুর্ন বিষয় টাই তার কাছে আফসোসের। অন্য রকম জীবন হতে পারত হয়নি, এটা একটা বড় আফসোস।  হাফিয ভাই ঢাকায় আছেন দীর্ঘ ২২ বছরের মত হলো। তার প্রথম ঢাকায় আসা বড় ভাই মকবুলের হাত ধরে। বড় ভাই আর হাফিয ভাই এর মধ্যে বড় ধরের টান ছিল এতা তার কথায় বোঝা যায় । ১৯৯৭ এ প্রথম ঢাকায় আসা। বড় ভাই স্কুল শিক্ষক ছিলেন।

 বড় ভাই নিজের সম্মানের কথা চিন্তা করে হাফিয ভাই কে ঢাকার থেকে হয়ত দূরেই রাখতে চেয়েছেন। পরবর্তিতে কিন্তু সে বড় ভাই এর কারনেই তার ঢাকায় আসা। বড় ভাই বলে দিয়েছিলেন, গ্রামের বাড়ীতে তাদের যেমন একটা সম্মান আছে, সেটা যেন  বজায় থাকে। হাফিয ভাই এর নামে যেন কোন সুনাম বই দুর্নাম না আসে। হাফিয ভাই এর শুরু সেখান থেকে,জীবন যুদ্ধের। কাপড়ের কাজ করেছেন বেশির ভাগ সময় জুড়ে। ঝামেলা এড়াতে কথা কম বলতেন। কিন্তু কথা কম বলাটাই  আবার দোষের  পর্যায়ে পরল। হাফিয ভাই এর ভাষায়   ”কথা কইলে ও দোষ না কইলেও দোষ” । কেও বড় ভাই  এর কাছে হয়ত দোষ লাগালো “আপনার লোক কথা বলেনা” । এর মধ্যে একটা সময় তাকে ঢাকা ছাড়তে হয় শারিরিক দুর্বলতার কারনে। গ্রামেই সস্ত্রীক ছিলেন অনেক দিন।

হাফিজ ভাই এর কথায় একোটা আফসোস বড় হয়ে দেখা দেয়, ভাই হারানোর আফসোস।  গ্রামে থাকা কালিন হাফিয ভাই এর বড় ভাই এর মৃত্যু ঘটে। তিনি ছুটে গিয়েছিলেন মৃত ভাইকে দেখার জন্যে। ভাইকে জীবিত থাকা কালিন দেখার সুযোগ ছিলো, ভাই তাকে আসতে বলেছিলো। তিনি নানা কারনে যাননি ।এই আফসোস ও হয়ত তাঁর যাবেনা কোনদিন । এর পর তাঁর উপর তাঁর বড় ভাই এর পরিবারে ভার ও কিছুটা বর্তায়। কাপড়ের ফ্যাক্ট্রিতে  চাকরি করেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত । এর পর কিছুদিন কাজ করেন সেবায় । বর্তমানে আছেন ফুড হাটে ( Foodhut ) । এক সন্তানের জনক তিনি। রান্নার কাজ টা করেন মন দিয়ে। তবে মন দিয়ে না করলেই তাঁর রান্না মজা হয় বেশি -আরমান ভাই এর মতে।

তাঁর জীবনের প্রাপ্তি –  তাঁর প্রতি পরিবারের ভালোবাসা,আর তাঁদের জন্যে তাঁর দায়িত্ব গুলো। হয়ত যেমনটা হয়েছেন এটাই ভাগ্যে ছিলো, আর এটাই তাঁর জন্যে ভালো ছিলো।এর চাইতে বেশি কিছু পেতে পারতেন,সেটা পেলে হয়ত একটা পরিবার পেতেন না! দেনা-পাওনার হিসেব আর আফসোস আর প্রাপ্তির হিসেব কষে তাই লাভ নেই।  হয়ত তাঁর ভবিষ্যতে প্রাপ্তির খাতায় অনেক কিছুই এখনো বাকি আছে ।ঢাকার থাকেন সস্ত্রীক পোস্তগলায়। সপ্তাহের ৫ দিন কাজে থাকেন ,আর দুই দিন পোস্তগলায় পরিবারের সাথে কাটান। বৃহস্পতিবার মানেই আগামিকাল হাফিয ভাই এর ঈদের দিন-আরমান ভাই বলেন। তাকে বেধে রাখে ,ধরে রাখে কার সাধ্য ।রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তিনি ঘরের পথ ধরেন, সেখানে কেও হয়ত তাঁর অপেক্ষায় আছে। হয়ত কিছু দায়িত্বরা অপেক্ষা করছে তাঁর জন্যে।

একটা মানুষের সবকিছু জানা যায়না। হাফিয ভাই এর অজানা অনেক কথাই হয়ত অজানা থেকে যাবে বাকিদের মতই।থাক তিনি তাঁর মত , কিছু আফসোসেদের সাথে নিয়ে আর কিছু প্রাপ্তি নিয়ে।  

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন