আমার হিসাববিজ্ঞানের গুরু – জনার্দন স্যার

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

 এক

২০১১ সালে এসএসসি পাশ করে সবেমাত্র বড়খাতা ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়েছি।আমি দেখতে একটু বেঁটে আর পিচ্চি সাইজের ছিলাম। কলেজে উঠে কমার্স(বাণিজ্য) শাখা নিলাম। সবার মধ্যে পিচ্চি হওয়ায় কয়েক দিনের মধ্যে সবার মধ্যে একটু পরিচিত হলাম। বাংলা স্যার একটু রাগী ধরনের, ইংরেজী নিতেন মুকিত স্যার এবং সুজন স্যার,হিসাব বিজ্ঞান- আব্দুল হামিদ স্যার, ব্যবস্থাপনা – রাজ্জাক স্যার,আর সবশেষে কম্পিউটার নিতেন জনার্দন স্যার। আমার আজকের লেখা সবার শেষের জনার্দন স্যারকে নিয়ে। তিনি আমার হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষাগুরু। বয়সের দিক দিয়ে তিনি মাঝবয়সী,ছিপছিপে গড়নের। কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়ের ক্লাশ নিলেও তিনি মুলত ছিলেন হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক। কলেজে উঠে হিসাব বিজ্ঞান কিছুই বুঝতাম না। তাই আলাদা ভাবে পড়ার জন্য শিক্ষক হিসেবে পেয়ে যাই জনার্দন স্যারকে। তার পাঠদানের মাধুর্যে আমি জাবেদা গুলো এতটাই রপ্ত করেছিলাম যে,অনার্সে উঠেও সেই বিদ্যা তুখোড় ভাবে কাজে লেগেছিলো। স্যার যখন কম্পিউটার ক্লাশ নিতেন, তখন আমি প্রচুর দুষ্টামি করতাম। তিনি আড়চোখে শুধু আমাকে দেখতেন,আর ইচ্ছে হলে হেসে হেসে মিষ্টি শাসন করতেন।

একদিন ক্লাশে বই রেখে আমি কলেজের পুকুরে গোসল করতে নেমেছি, যথারীতি তিনি ক্লাশ শুরু করেছেন।আমি তড়িঘড়ি করে পুকুর থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে ক্লাশে আসার জন্য দরজায় এসে স্যারের অনুমতি চাইলাম। কিন্তু স্যার আমাকে অনুমতি দিলেন না। বললেন তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে ক্লাশে ঢুকতে দেবেন। তিনি যে প্রশ্ন করলেন, সেই পাঠ তিনি ক্লাশে সেইদিনই পড়াচ্ছিলেন। আর আমি ক্লাশে ছিলাম না। আর কেন জানিনা আমি তার আগেরদিন সেই পড়াগুলো পড়েছিলাম। প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিলাম,তিনি বললেন এক পা এগিয়ে আসো। আমি এক পা এগিয়ে এসে আরেক পা তুলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম( বকের মত)।  আর ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেলো। শেষমেশ তিনটি প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পেরেছি সেদিন। যাহোক,ক্লাশ আর কলেজ দুটোই মোটামুটি চলতে লাগলো। বিশেষ করে বাড়ির পাশেই কলেজ,তাই সবদিনই কলেজে উপস্থিত থাকতাম। জনার্দন স্যার এতটাই বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতেন যে, আমি তাঁকে সকাল বিকাল ফোন করে বিরক্ত করতাম। কলেজের প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় স্যারের খাতায় আমি দুইটা প্রশ্নের উত্তর অন্যভাবে লিখেছিলাম” এই প্রশ্নের উত্তর পাইনা” আরেকটা ” কি প্রশ্ন করছেন স্যার?”। স্যার বড় বড় গোল্লা দিয়ে রেখেছিলেন খাতায়। খাতা দেখানোর দিন কত সুন্দর করে পিঠের মধ্যে সপাং করে দুইটা বারি দিয়ে বললেন,ফাজিল এইভাবে কেউ উত্তর লেখে?

দুই

জনার্দন স্যার খুবই মিশুক প্রকৃতির। মানুষ ছিলেন। কলেজে আসলে সব সময় হাসিখুশি থাকতেন। আর আমি ফাজিলের ঘোড়া ছিলাম। স্যারকে লক্ষ্য করে ছোট নুড়ি পাথর দিয়ে ঢিল মারতাম। তার পরপর দৌড়ে পালাতাম। স্যার আমাকে খুঁজেও পেতনা। স্যার একদিন প্রাকটিক্যাল ক্লাসে নিয়ে কম্পিউটারের মাউস ধরিয়ে দিয়ে বললেন “বুঝলে সাঈদ এটা হলো মাউস!” আমি ফাজলামো করে বলেছিলাম” স্যার, তাইলে বিলাই কই? স্যার ফিক করে হেসে বললেন বিলাই যে ব্যবহারকারী সে। পরের দিন এক বান্ধবীর ফোনে বিড়ালের রিংটোন দিয়েছিলাম লুকিয়ে। আর স্যার আসার পর আমি সেই ফোনে কল দিলাম। আর কি কান্ড! সেই বান্ধবী ব্যাগ সমেত ঝাড়তে ঝাড়তে দৌড়! পরে আমার ফাজলামো ধরতে পেরে ঘন্টাখানেক দাড় করিয়ে রেখেছিলেন। কিছুদিন পর স্যার আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন,বলেছিলেন “সাঈদ দোয়া করি তুমি অনেক বড় হও।আমার সাবজেক্টে তুমি এ প্লাস পাও”।স্যারের আশীর্বাদে পুষ্ট হয়ে আমি সত্যিই কম্পিউটারে সহ এ প্লাস পেয়েছিলাম। যদিও আমাদের কলেজে এত ভালো রেজাল্ট হয় না, মফস্বল এর কলেজ বলে পাশের হারও কম ছিলো। আর হিসাব বিজ্ঞানে স্যারের হাতেখড়ি দেয়াতে আমি হয়েছিলাম হিসাববিজ্ঞানের পোকা।

২০১৩ তে কলেজ থেকে পাশ করে যখন বের হলাম, চান্স হলো লালমনিরহাট সরকারী কলেজে। সেখান থেকে প্রায় প্রত্যেক শুক্রবার বাড়িতে আসতাম। শনিবার স্যারের সাথে দেখা হতো, কুশল বিনিময় হতো। এখন বাড়িতে থেকেও দেখা হয় না। কিছুদিন আগে স্যারকে দেখে প্রায় দৌড়ে গিয়ে দেখা করলাম। কেন জানিনা খুব খারাপ লাগলো আমার। স্যার অনেকটা বুড়িয়ে গেছেন। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের জনার্দন স্যারের সাথে এখন অনেকটা অমিল হয়ে গেছে। তবে আগের হাসিটুকু রয়েই গেছে। স্যারের সাথে অনেক কথা হলো। আসার সময় বুক ভরা শূন্যতা নিয়ে ফিরে এলাম। মনে মনে বললাম, আমি আপনাকে অনেক অনেক মিস করি স্যার, আপনি যে আমার হিসাববিজ্ঞানের গুরু।আপনাকে তো দক্ষিণা দিয়ে ছোট করতে পারিনা। তাই মাঝে মাঝে আপনাকে দেখতে ছুটে আসি স্যার। আপনি আমার অনেক প্রিয় স্যার।

(সমাপ্ত)

                                                            লেখকঃ সাঈদ আল রবি। রচনাকালঃ ১১ ই ডিসেম্বর ২০১৮

আরো লেখনী পড়তে ক্লিক করুনঃ

আমার বিয়ে ও প্রেম-কথা

   আমি একজন প্রাইভেট টিউটর

       একটি অদম্য দম্পতির- জীবনের, অনুপ্রেরণার গল্প

একজন হার না মানা সবজিওয়ালা-মেধাবী শিহাব আহমেদ এর গল্প

মৌলানা আবুল কালাম আজাদঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক

রকিব চাচার গল্প

আমি ও আমার জীবন

একটি অন্যরকম বিয়ের গল্প

শালী ও পাঁচমিশালি

জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকঃ  চলমান বিশ্বকোষ ও জ্ঞানতাপস

একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর জন্ম ও কিছু কথা

বাংলায় ইসলামী জীবনের ইতিকথা

শ্রদ্ধেয় আব্দুল কাইয়্যুম নিজামী স্যার

কফি হাউজের সেই আড্ডা টা আজ আর নেই

মৃত্যু

তামিমের ডায়েরী থেকে…

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন