আমার দেখা সুপার হিরো “আমার প্রিয় বাবা”
——————————————————
আমাদের পরিবারটি একটি উঠতি পরিবার। অসচ্ছল পরিবার থেকে কেবল সচ্ছল হতে শুরু করেছে। আমার বাবা আব্দুর রহমান আমাদের পরিবারে সুপার হিরোদের একজন। তাঁর অতিশয় কষ্টের জীবন যাপন। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি, তিনি যে কষ্ট করে এসেছেন তা সুপার হিরোদের হার মানানোর জন্য যথেষ্ট।পাঠক, আমার বাবা কিন্তু নাই-কলম পাশ। অর্থাৎ তিনি কোন পড়াশোনা করেন নি। ছোট থেকে মানুষের দোকানে কাজ করে বড় হয়েছেন।
আমাদের জন্মের পর থেকে, যখন বুঝতে শিখেছি, দেখেছি তিনি মানুষের দোকানে ১০০-১৫০ টাকা বেতনে কাজ করতেন। সারাদিন দোকানে কাজ করে যখন রাতে বাড়িতে আসতেন তখন দেখতাম তার ঘাম ভেজা শরীরে এক অন্যরকম প্রশান্তি। কারণ তিনি আমাদের দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। বাবার এই কঠোর পরিশ্রম আমাদের অনুপ্রাণিত করলেও, তিনি আমাদেরকে সেই কষ্টের ভাগীদার হতে দিতে চান নি। আমি যখন ছোট, তখন বাবা যে দোকানে কাজ করতেন সে দোকানের কাজ চলে যায়। ফলে আমাদের চলা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। আসলে মহান আল্লাহ মনে হয় আমাদের উপর রহমতের দৃষ্টি দিয়েছিলেন। কেননা সেই কাজ চলে যাওয়ার পর তিনি অনেক কষ্ট করে একটি ছোট চায়ের দোকান দেন( আমার আগের একটি গল্পে তুলে ধরেছি)। ফলে শুরু হয় এক নতুন লড়াই, উঠে আসার লড়াই।বাবা প্রতিদিন একা দোকান করেন। মাঝে মাঝে আমি আর ভাইয়া একটু করে সাহায্য করি, এভাবেই দিন চলে। তিনি কাজের লোক রাখতে চাইতেন না,কেননা কাজের লোক কে টাকা দিলে আমাদের আয় কম হবে বলে বাবা সারাদিন একা একা কাজ করে যেতেন।
একেকদিন তিনি দোকান বন্ধ করে এসে বাড়িতে প্রচুর ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে যেতেন, মা সাহস জোগাতেন, বলতেন কষ্ট করেই আমাদেরকে মানুষ করতে হবে। আমার সেই বাবা, বাজারের খোলা মার্কেট থেকে পুরাতন জামা কিনে পড়তেন,আর আমাদেরকে নতুন জামা কিনে দিতেন। বাবার জামা- লুঙ্গি ছিঁড়ে যেতো, আর মা অতি যত্নে তা টুকরো কাপড় জোড়া দিয়ে শেলাই করে দিতেন। বাবার জামা আর লুঙ্গিতে কতো গুলো যে তালি পড়তো তা আমি গুনতে সাহস পেতাম না। বড়খাতা কৃষিব্যাংকের সব লোক আমাদের দোকানে খাবার খেতো, পরে কাছাকাছি আরো দোকান, এবং ব্যাংক অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ায় আমাদের দোকানে ভাটা পড়ে যায়। দোকান ছেড়ে দিয়ে বাবা আবার অসহায় হয়ে পড়েন। সেই দিন গুলোতে নির্মম কষ্টের আঘাত বারেবারে ফিরে আসতো। পরে অবশ্য দুই জায়গায় জায়গা বদল করে বাবা বাজারের ভিতরে দোকানের জায়গা পেয়ে গিয়েছেন। আজো সেই দোকানটি চলছে।
যখন ভিতর বাজারে তিনি দোকান শুরু করেন, তখন আমি ক্লাশ নাইনে পড়ি। আমি দোকানে যেতাম, আমি থাকায় বাবা আশেপাশের ব্যবসায়ীদের বাকিতে খাওয়াতেন।আমিও ট্রেতে করে চা নিয়ে দৌড়াতাম দোকানে দোকানে। আর দিনশেষে খাতা নিয়ে দোকানে দোকানে ছুটতাম বিল নেওয়ার জন্য। চায়ের দোকানের প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে বাবা একদিকে দোকান সামলিয়ে অপর দিকে খাবার বানাতেন। আর আমরা স্কুল কলেজ শেষে দোকানে সময় দিতে চেষ্টা করতাম। কলেজ পাস করে আমি, ডিগ্রীর ফরম তুলতে চেয়েছিলাম। বাড়ির পাশে কলেজ তাই কোন কষ্ট হতোনা, কেননা বাবা এত কষ্ট করেন, আমি ভেবেছিলাম আমি যদি ডিগ্রীতে ভর্তি হই তাহলে তাঁর কাজে সাহায্য করতে পারবো। কিন্তু ভাইয়া, মা, আর বাবার ইচ্ছার কারণে অনার্স ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়ে যাই লালমনিরহাট সরকারী কলেজে। আর সেখানে চলে গিয়েছিলাম পড়াশুনা করতে।
পাঠক, যেদিন লালমনিরহাট পড়াশুনার জন্য যাই, ট্রেনের এক কোণে দাঁড়িয়ে একা একা কেঁদেছিলাম। শুধু একটাই চিন্তা ছিলো, আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি দূরে—-।
অথচ লালমনি আমার বাড়ি থেকে ৫০- ৫৫ কিলো দূরে। চলে আসার পর বাবা আরো বেশি একা হয়ে পড়েছিলেন।দোকান করতে খুব হিমশিম খেতেন।দুপুরে ভাত খেতে পারতেন না, দোকান সামলিয়ে সম্ভব হতো না। এখনো মাঝে মাঝে ভাত খাওয়ার সময় পান না।আর আমি এসব শুনতাম, প্রচুর অভিমানে বাড়িতে কারো সাথে কথা বলতাম না। ভাইয়া সারাদিন টিউশানিতে থাকতো, আর আমি বাইরে। তখন ছোট ভাই আল- আমিন দোকানে একটু করে সময় দেওয়া শুরু করে। আজ শাহী ভাইয়া পড়াশুনা শেষ করেছে,তার চাকরী হয়েছে আমার পড়াশুনা শেষের দিকে, আর ছোটভাই আল মনি তুরস্কে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
আর বাবা?সেই আগের মতই দোকানে যায়, দোকান করে। এখন আমরা কাছাকাছি থেকেও তিনি একা দোকান করেন।কিন্তু বাবার এখন আগের মত অত চিন্তা করতে হয় না। কেননা তার কষ্ট স্বার্থক হতে চলেছে। আর বেশিদিন নেই, যেদিন তাকে আমরা বলতে পারবো, দেখো বাবা আমরা তোমার সন্তান, আজ অনেক বড় হয়েছি, আমরা তোমার কষ্টকে স্বার্থক করেছি। তুমি সুপার হিরো হয়ে আমাদের পাশে ছিলে, আমরা তোমার হিরো হয়ে আজীবন তোমার ছায়ায় থাকবো। আমাদেরকে মনুষ্যত্বতায় মানুষ করেছো, স্যালুট তোমায় আমার সুপার হিরো বাবা।
লেখাঃ সাঈদ আল রবি রচনাকালঃ ২১শে মে ২০১৯।