মুক্তিযুদ্ধ ও একটি জীবনের গল্প – জীবন চমকপ্রদ এক যাত্রা! এই যাত্রায় একজন মানুষ তাঁর জীবনের কতটুকু কথা সবার সামনে তুলে ধরতে পারে। ঠিক ততটুকুন যতটুকু বলা যায়। মানুষ তাঁর এক জীবনের সব কথা সবার সামনে প্রকাশ করেনা,সব প্রকাশ করা যায় ও না, উচিৎ ও নয়! আমাদের সাথে জীবনের যাত্রাপথে দেখা হয় হাজারো মানুষের। এদের মাঝে খুব মানুষের জীবনের গল্প বা ঘটনা আমাদের মনের গহীনে দাগ কাটে। আর কিছু দাগ সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। কিছু আজীবন মনে থেকে যায়।
আজকের গল্প এমনি একজন মানুষের জীবন নিয়ে।তাঁর সাথে আমার পরিচয় হঠাৎ করেই। নুরুল হুদার মুখেই শুনুন মুক্তিযুদ্ধ ও জীবনের গল্প। সেখানে আছে উত্থান-পতন, আঘাত,মুক্তিযুদ্ধ আর অনুপ্রেরণার বাস্তব গল্প।২০১৮ সালের মে মাসের এক ভোরে আমার সাথে দেখা হয়েছিলো মোহাম্মদ নুরুল হুদার।আমাদের অফিসের নীচে থাকা একজন দারোয়ান হিসেবেই তাকে চিনতাম ।গেট দিয়ে ঢুকতে বা বের হওয়ার সময় আমাদের মাঝে সালাম বিনিময় হত সবসময়। চাচা বলে সম্বোধন করতাম তাকে। খুব বেশি কথা হয়নি কখনো সেদিনের আগ পর্যন্ত। হাজার-বিয়াল্লিশ নম্বর বাসার গেট দিয়ে ঢুকে তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় সেদিন কেন জানি তাঁর পাশে খালি চেয়ারটায় বসতে মন চাইলো। ইচ্ছে হল তাঁর সাথে কিছুক্ষন গল্প করার।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম -চাচা,আমি কি এখানে বসতে পারি?
তিনি বিড়বিড় করে কিছু পড়ছিলেন। ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। আমি অনেক্ষণ বসে ছিলাম। তিনি নিজেই কথা শুরু করলেন,
-তো সাব কেমন আছেন?
আমি সাব(সাহেব) শুনে বললাম- আমি সাব-টাব কিছু নই। সাবদেরকে আমার অপছন্দ।আপনার কথা বলেন কেমন আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এই বয়সে আল্লাহ যেমন রাখছেন ভালোই রাখছেন।
তিনি কিছুক্ষন চোখ বন্ধ রেখে বললেন, -তবে জীবন তো এমন হয়ে যাবে ভাবিনাই। জীবনের গল্প অন্য রকম হতে পারত। যাক,সবি আল্লাহর ইচ্ছা।
এই পর্যায়ে আমি ভাবতে লাগলাম তাঁর জীবনে কোন গভীর গল্প আছে। সবার জীবনেই গল্প থাকে,তবে অনেকের গল্পটা ধরাবাঁধা নিয়মেই চলে । কেন জানি মনে হলো ওনার জীবনের গল্পটা অন্যদের মত সাধারণ নয়। সেদিন তাঁর নাম আর পরিবার সম্পর্কে কিছু কথা জেনেছিলাম। জেনেছিলাম তিনি কোরানে হাফেজ। তিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে আজ দারোয়ান। জেনেছিলাম অতীতের কথা।
এরপর আমি একমাস ধরে নুরুল হুদার সাথে কিছু সন্ধ্যায় সময় কাটিয়েছি। তাঁর জীবনের অনেক কথাই জেনেছি । পুরোটা বলতে গেলে একটা অন্যধরনের গল্প! জীবনের গল্প! মুক্তিযুদ্ধ এর গল্প।পাওয়া না পাওয়ার গল্প বা অনুপ্রেরণার গল্প।
গল্পটা এরকমঃ
তাঁর সম্পূর্ন নাম মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তাঁর বাবা মরহুম ইদরিস আলি মুন্সী। বাবার মৃত্য হয় ১৯৬৭ সালে। নুরুল হুদার কৈশোরের সময় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। নুরুল হুদার জন্ম ১৯৫২ সালে। নুরুল হুদা তাঁর কর্মজীবনে দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম শহরে ছিলেন দীর্ঘদিন, সে সময় তাঁর থাকার জায়গা ছিলো চট্টগ্রামের উজালা সিনেমা হলের পাশে মিশকা হোটেলের সামনের রেস্টহাউজে । সে কথায় পরে আসছি।
তাঁর জন্ম উত্তরবঙ্গের রংপুরে । তবে তাঁর বাপ-দাদার জন্মস্থান লক্ষীপুর। জন্মের পর থেকেই বেড়ে উঠেন রংপুরে ।কর্মের কারনে তাঁর জন্মের সময় তাঁর বাবা রংপুরে ছিলেন এর মধ্যেই এক সময় তাঁর বাবা নুরুল হুদা ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে যান চট্টগ্রামের, লক্ষীপুরের রামগতি থানায়।সেখানে যাওয়ার ৬ মাসের মাথায় তাঁর বাবা মারা যান। সেখানে কাটিয়েছেন জীবনের আটটি বছর। । তাঁর নানার বাড়িও ছিলো সেখানেই। ৬৭ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন লক্ষীপুরে। পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র। সেসময় নুরুল হুদাদের স্কুলে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছিলো বম্বিং হলে কিভাবে আত্মরক্ষা করতে হবে।
লক্ষীপুরে ৭৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন। কর্মের খোজে জীবন সংগ্রাম শুরু ৬৮ সালে তিনি এসেছিলেন চট্টগ্রাম শহরে । এখান থেকেই লক্ষীপুর যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন। এর মাঝে ১৯৭১ সালে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ।যুদ্ধের আগে সেখানে তিনি অফিস পিয়নের চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন।পড়ালেখায় কিছুটা ছেদ পরলেও এর মধ্যেই নিজ উদ্যোগে ভর্তি হয়ে যান চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে।ভর্তি হন সপ্তম শ্রেনীতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক ঘটনার সাক্ষী তিনি। সেখান থেকেই কিছু ঘটনা তিনি তুলে ধরলেন , এবং নিজেও যেন হারিয়ে গেলেন অতীতে।
মুক্তিযুদ্ধঃ
যুদ্ধ দেখেছেন, দেখেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎপরতা । তাঁর মুখ থেকে শুনলাম মুক্তিযুদ্ধ এর সময় চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার কথা। কিভাবে পাকিস্তানীদের জাহাজ ধ্বংস করা হয়েছিলো সে সম্পর্কে বললেন তিনি। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনায় , এবং কিছু করার জন্য তিনিও খবর রাখতে লাগলেন যুদ্ধের, এবং সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সহযোগীতা করতেন। ১৬ নবরে ছিল নুরুল হুদার অফিস। মানে তিনি যেখানে চাকরী করতেন।
মহিউদ্দিন চৌধুরী ও জহুর আহমদ চৌধুরী সম্পর্কে জানালেন। সে সময়ে মহিউদ্দীন চৌধুরীকে কে খুব কাছ দেখেছিলেন নুরুল হুদা, তাকেও মহিউদ্দিন চৌধুরী খুব পছন্দ করতেন। জহুর আহমদ চৌধুরীকে নুরুল হুদা নানা বলে সম্বোধন করতেন। তিনিও নুরুল হুদাকে খুব আদর করতেন।
১৯ বছরের কিশোরের চোখে সেদিন ধরা দিলো যুদ্ধের বর্বরতা। সেদিনটার কথা নুরুল হুদার খুব মনে আছে। যখন আর্মি ঢুকতে শুরু করল পঙ্গপালের মতন এবং নির্বিচারে মানুষ কে গুলি করা শুরু করলো। চট্টগ্রামের স্টেশন রোড়,ওয়ার নিজাম রোড , নিউ মার্কেট সহ অনেক জায়গায় মর্টার শেল, এল এম জি, কামানের গোলা,মেশিনগানের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত নগরী। দেখেছেন পড়ে থাকা বাঙ্গালীর অগণিত লাশ। পাকিস্তানীদের বর্বরতা বেড়ে গেলে অনেকেই শহর ছাড়তে শুরু করে সেসময়। সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে তখন।
নুরুল হুদা কিছুদিন পশ্চিম মাদার বাড়ি থাকার পর তাঁর অফিসের স্যারের লাভ্লেনের বাসায় তাঁর ঠিকানা হয়। স্যার চলে যান নরসিংদীতে তাঁর নিজের বাড়ি। লাভলেনের বাসায় রেখে যান ১৯ বছরের নুরুল হুদাকে। সেখানে থাকা অবস্থায় তাঁর সাথে পরিচয় হয় সিটি কলেজের ছাত্র হামিদের সাথে। তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মুক্তিযুদ্ধ এর খবর শুনতেন নিয়মিত।
তাদের বাসার নিচে থাকত বিহারিরা। তারা নুরুল হুদা আর হামিদকে ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে। নুরুল হুদাদের পরিচয় তারা মিলিটারির কাছে দিলো এভাবে – ” শেখ মুজিব কা লারকা হ্যেয়, মুক্তিকা আদ্মি হ্যায়” ।
নুরুল হুদা আর হামিদকে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। তিন দিন সেখানে তাদের রাখা হয়। চলে অমানুষীক নির্যাতন। নুরুল হুদাদের চোখের সামনে এভাবে আরো ১০০ জন কে ধরে আনা হয়। প্রতিদিন আট-দশজন করে গুলি করে কর্ণফুলীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত লাশ। আর বাকি ছিলো ১৯ জন। এদের মধ্যে ছিলেন নুরুলহুদা আর হামিদ। একদিন ব্রিগেডিয়ার আসলেন কেম্প ভিজিটে।
নুরুল হুদাদের দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- “ ইয়ে বাচ্চে লোগ কেয়া কসুর কিয়া?”
নুরুল হুদা জবাব দিলেন- ” হামকো মালুম নেহি হাম কেয়া কসুর কিয়া” ।
সাথে সাথে মিলিটারির কাপ্তান বললেন ব্রিগেডিয়ার কে “ইয়ে শেখকা আদ্মি হ্যায়,ইস্কে পাস হাতিয়ার হ্যায়”।
নুরুল হুদা সাহসে ভর করে বললেন ” কাপ্তান সাব ঝুট বলরায়ে”।
এরপর ব্রিগেডিয়ার জিজ্ঞেস করলেন “তোম লোগ মুসলমান হ্যায়?”
সেসময় ১৯ জনের মধ্যে ১ জন ছাড়া সবাই মুসলিম ছিলো। সবাই বল্ল তারা কলেমা জানে। হিন্দু যে সেও কলেমা বলল । নুরুল হুদা তাঁর বয়স যখন সাত তখন থেকেই কোরআন শিক্ষা পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছে। নুরুল হুদার বাবা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক এবং মসজিদের ইমাম। তাঁর বাবা কলকাতার আলীয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করেছিলেন।
নুরুল হুদাদের সন্ধ্যায় ছেড়ে দেওয়া হলো। ব্রিগেডিয়ার কেম্প ছেড়ে চলে গেলেন ঐ দিন-ই। সেই রাতে পাকিস্তনীরা আবার হামলা চালালো নুরুল হুদাদের এলাকায়। রাতের আধারে যারা নিরস্ত্র ছিলো তারা নির্মম ভাবে নিহত হলো। নুরুল হুদা তিন তলার বাসা থেকে নীচের ড্রেনে পড়লেন লাফ দিয়ে । সেখানেও সেই রাতের আঁধারে পাকিস্তানীরা টর্চের আলোয় গুলি চালালো। নুরুল হুদা সে গুলির ক্ষত এখনো বয়ে বেড়ান। তাদের অপরাধ তারা বাঙ্গালী, তারা স্বাধীনতা চায়, মুক্তিযুদ্ধ চায়! তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের খবর রাখে, যেভাবেই পারুক মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করে।
পরদিন সকাল। নুরুল হুদারা রক্তাক্ত অবস্থায় ছিলো। চারপাশে রক্ত। এর মধ্যেই চট্টগ্রামের এক চিকিৎসক সহযোগীতার জন্য এগিয়ে আসেন। নুরুল হুদাদের অনেক কষ্টে ড্রেন থেকে তোলা হলো। দীর্ঘ এক মাস চিকিৎসা চলল।
মুক্তিযুদ্ধ প্রায় ৬ মাস হতে চলল । সুস্থ হয়ে নুরুল হুদা চলে গেলেন লক্ষীপুরে। তিনি জানতেন না সেখানের খবর। তাঁর পরিবার ছিলো সেখানে। সারা দেশেই চলছিলো পাকিস্তানীদের হানাদার বাহিনীর উৎপাত ।
লক্ষীপুরেও পাকিস্তানীদের বর্বরতা চলছিলো। নুরুল হুদাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো জবাই করতে। সেখানেও তিনি এবং অনেকের ভাগ্যে আবার জীবন জুটলো। আবার তারা মুক্ত হলেন। থেমে নেই যুদ্ধ ।থেমে নেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতা। নুরুল হুদারা কয়েকজন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না করলেও, মুক্তিবাহিনীকে সার্বিক সহযোগীতা করলেন।
দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলো।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে নুরুল হুদা আবার ফিরে আসলেন চট্টগ্রাম শহরে ।এবারের গল্প জীবন সংগ্রামের। চট্টগ্রামে কিছুদিন পান-সিগারেটের ব্যবসা করলেন। ১৯৭৫ সালে মেট্রিক শেষ করে ঢুকেন পুলিশ বাহিনীতে। তাঁর পোস্টিং ছিলো চট্টগ্রামে। সেই সালেই ১৫ আগস্ট দেশের ইতিহাসের কাল দিন ঘনিয়ে আসে। খুন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে । চট্টগ্রামেই সিটি কলেজ থেকে তিনি পাশ করেন ইন্টার।এএসআই পদে পদোন্নতি হয়ে তাঁর পোস্টিং হলো দিনাজপুরে। দিনাজপুরে গিয়ে দিনাজপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করলেন।
উচ্চপদস্থ অনেকের টাকা ও মেয়েঘটিত বদভ্যাসের কারনে নুরুল হুদা বিরক্ত ছিলেন। হয়ত তিনি না চাইতেই এসবের সাক্ষী হতে চাইতেন না। দুই তিন মাস লজ্জানত অবস্থায় অনেক কিছু দেখেও সয্য করে গেলেন। পরে মায়ের সাথে কথা বললেন এ ব্যাপারে। নুরুল হুদা একজন ইমামের ছেলে হয়ে কুকাজের সাথে জড়িত থাকতে চাননি। মা কোরআন শপথ করালেন ছেলেকে যাতে এক টাকাও ঘুষ না খান। এই অবস্থায় এই চাকরি আর করা চলেনা! পরবর্তিতে পুলিশের ভালো পদে থাকা অবস্থায় তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন।
কারন মা বলেছেন” বাবা রিজিকের মালিক আল্লাহ ,তুই চাকরী ছেড়ে চলে আয়” । পরে আটকানি জমি চার কানির দামে বিক্রি করে গেলেন রংপুরে। সেখানেও বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে আরো অর্ধেক টাকা শেষ। ওদিকে পরিজনরা নুরুর হুদাদেরপরিবারকে প্রাপ্ত জমি দেয়নি। সে সময় বাবাও জীবীত ছিলোনা নুরুল হুদার। নুরুল হুদা সুবিধাভোগী পরিজনদের সাথে পেরে উঠেন নি। কিছুদিন ব্যাবসার পর চলে যান মালেশিয়ায়।সেখানেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নি। তিন বছর মালেশিয়ায় থেকে খরচের টাকা হতেই চলে আসলেন বাংলাদেশ। তাঁর জীবনের গল্প দ্রুত তাকে বিভিন্ন পরিবেশে নিয়ে ফেলে।
দেশে এসে চাকরী পেলেন এক ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে। যদিও এমে পাশ ছাড়া চাকরী দেয়না। তথাপি নুরুল হদুয়ার পুলিশে চাকরীর অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য অভিজ্ঞতাকে হিসেবে নিয়ে তাকে জেলা ম্যানেজারের চাকরী দেওয়া হয়। সেখানে চার পাঁচ বছর চাকরী করার পর প্রমোশন হয়ার কথা থাকলেও তা তাকে দেওয়া হয়নি ।
২০০০ সালে এরিয়া ইঞ্চার্জ পদে নিয়োগ পান। ভালই সেলারী পেতেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন ইসলামের নাম দিয়ে যে ওয়াদা দেওয়া হয় তাঁর কোনটাই রক্ষা করা হয় না। যে কারনে পুলিশের চাকরী ছেড়ে ছিলেন একি কারনে এই চাকরী ও ছাড়লেন। মুসলিম হয়ে ইসলাম বিরুদ্ধ কাজ তিনি করবেন না । রিজিকের মালিক আল্লাহ। গাড়ি আর আরাম আয়েশ ছেড়ে দিলেন। এখন তিনি কোথায় যাবেন? বা কি করবেন? আবার চেষ্টা করলেন বিদেশে যেতে। খরচ করে ফেললেন বাকি জমানো টাকা।
নুরুল হুদার বিয়ে হয় ১৯৭৪ সালে। তাঁর পরিবারে স্ত্রী ও এক ছেলে দুই মেয়ে আছে।তাঁর ছেলের জীবনের গল্প আবার অন্যরকম। ছেলেকে দুবাই যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন নুরুল হুদা। ছেলে সেখানে ভালোই টাকা কামাতো। বাংলাদেশি টাকায় ৭০-৮০ হাজার টাকা। কিন্তু নাটরের এক ছেলের কথায় সে ছেলে দেশে এসে ব্যবসা করতে উদ্বুদ্ধ হয়। দেশে আসার পর বিমানবন্দরে নেমে নুরুল হুদার ছেলের সাথে নাটরের সেই ছেলের আর যোগাযোগ হয়নি। দেশেও সে আর সুবিধা করতে পারলোনা।
ছেলে বিয়ে করেছে। তাঁর সংসারে এখন দুই মেয়ে ।একজন ক্লাস সেভেন এ পড়ে, আরেকজন এখনো ছোট। সে ছেলে আবার ওমানে কাজের চেষ্টা করে। সেখানে ১০ মাস থেকে সুবিধা করতে না পেরে আবার দেশে ফিরে আসে।
বর্তমানে্র গল্পটা অন্যরকম। সে ছেলে ঢাকার আর এফ এল কোম্পানীতে চাকরী করে। ছেলে আসার কয়েকদিন পর নুরুল হুদাও ঢাকায় এসেছেন। তিনি বর্তমানে আমাদের বিল্ডিঙের নীচে গেটকিপার হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর নাতিন নিয়ে তাঁর খুব গর্ব। তিনি এই জায়গায় বেশিদিন থাকবেন না। অন্য ব্যবস্থা হলেই চলে যাবেন। তখন হয়ত তাঁর জীবনের গল্প আবার ভিন্ন মোড় পাবে।
এই লিখাটা লিখা শুরু করার পর,একদিন ভোরে দেখালমা তাঁর জায়গায় নতুন দারোয়ান এসেছে।তিনি চলে গেছেন। চিন্তা করছি একদিন তাঁর ঠিকানায় গিয়ে তাকে চমকে দিবো। আরো কিছু জীবনের গল্প শুনবো তাঁর মুখে।
আমার নুরুল হুদাকে নিয়ে খুব গর্ব। যেখানে মানূষ টাকার জন্য চাটুকারিতায় ব্যস্ত,সেখানে তিনি দুহাতে কালো-টাকা সরিয়ে বেঁছে নিয়েছেন কঠিন পথ। তিনি চাইলেই হয়ত যে পেশা গুলো বয়কট করেছেন সে পেশায় থেকে অঢেল কামাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তিনি কঠোর ভাবে ইসলাম কে মেনে চলেছেন কাজে-কর্মে।
টাকাই সব নয়,মানুষি টাকাকে সব বানায়।কিভাবে খারাপের মাঝেও ভালোকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকা যায় তাঁর উদাহরণ নুরুল হুদা।আমাদের জীবনের গল্প কিছুটা আমাদের হাতে কিছুটা ভাগ্যের হাতে। তবে হয়ত কেমন হবে আমার বা আপনার জীবনের গল্প সেটার অনেকটা ভার আমাদের হাতে। তবে মাঝে মাঝে ভাগ্য সবকিছু বদলে দেয়।
নুরুল হুদার জীবন যদিও বা কঠিন কিন্তু সে জীবন যুদ্ধের,সে জীবন অনুপ্রেরণার। সে জীবন শিক্ষনীয়।