আপিসের গপ্পো : ০১

Please log in or register to like posts.
পোস্ট
আপিসের গপ্পো

নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি ইদানীং। নতুন নতুন মানুষ, নতুন পরিচয়, নতুন চরিত্র, নানান কথা, হরেক পদের গল্প। আনন্দময় গল্পের মতো দুঃসহ অনুভূতিও জমা হচ্ছে স্মৃতিকুঠিরে। দূর্বোধ্য অভিজ্ঞতার মতো আছে রোমাঞ্চও। আমি ভুলোমনা মানুষ। যত দ্রুত সব ভুলে যাই তত দ্রুত খাবারও হজম করি না মনে হয়! এইসব অভিজ্ঞতাও যদি তেমন ভুলে যাই তবে স্মৃতিবাড়িতে তো এই সময়ের চুন সুড়কিও আর পড়ে থাকবে না। তাই অভিজ্ঞতা বা স্মৃতিগুলোকে শব্দগুচ্ছের কয়েদখানায় যদি বন্দী না করি তাহলে আর উপায় কি?

শুক্রবারের ঘটনা দিয়ে শুরু করি। জেনারেল ডিউটি দেয়া হলো এদিন, কবে একদিন বন্ধ দেয়া হবে সেজন্যে সেদিনকার গতর খাটুনী এই শুক্রবারে উসুল করা হবে। । বন্ধ দেবে সে কারণে অন্য এক বন্ধের দিন কাটা! তাহলে সেটা আর ছুটি হয় কী করে? জানি না বাপু! ছোটো মাথা আমার। অনেক বড় মানুষদের বড় পয়সা কেন্দ্রিক ব্যাপারগুলো আমার সাধারণ মস্তিষ্কে প্রবেশাধিকার পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবু কেন যেন ঐ বড় পয়সা কেন্দ্রিক ব্যাপারগুলো সহ্য হয় না। মানুষের রক্ত-ঘাম আর অনন্যোপায়-কে পুঁজি করে, মানুষের প্রয়োজনটাকে জিম্মি করে সর্বনিম্ম বিনিময় দিয়ে নিজের সর্বোচ্চ তুলে নেয় যা, তা সহ্য হওয়ার কোনো কারণও নেই। অন্তত সুস্থ মস্তিষ্ক ও সু-বোধ যার রয়েছে তার সহ্য হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।

সে যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। তো শুক্রবার চাকুরেদের জন্য সাধারণ কর্মদিবস হলেও, ইমাম সাহেবের জন্য মনে হয় নয়। তিনি শুক্রবারে আসেননি। জুমা থাকায় যোহরের সময় নামাযঘরে ইমামের দরকার পড়েনি। তবে আছরের ওয়াক্তে পড়লো। অযু সেরে শার্টের হাতার বোতাম লাগাতে লাগাতে কাতার ধরছি, এই সময় একজন বলে উঠল- উনি হাফেজ সাহেব। নামায পড়াতে পারবেন।
আশপাশে তাকিয়ে তেমন পরিচিত কাউকে পেলাম না, যাকে নিজের বদলে এগিয়ে দিতে পারি। অগত্য ইমাম হতে এগুলাম। তখনো কারো আপত্তি উঠেনি। কথা প্রসঙ্গে ক’দিন আগে সাবস্টেশনের জেনারেটর অপারেটর বা টেকনিশিয়ান ভদ্রলোক জেনেছিলেন হিফজ করেছি। সেই সূত্র ধরে তিনি ইমামের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবেন তখন কীভাবে বুঝবো!

আচ্ছা এতদূর পর্যন্ত সব এগোলো ঝামেলা ছাড়াই। ঝামেলা বাঁধল নামায শেষে। নামাযের পর আমি আমার মতো কিছু দোয়া দরুদ পড়ে মুনাজাত সেরে উঠে দেখি- কেউ দাঁড়ানোতে, কেউ দরজার গোড়ায়, কেউ বসেই গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। একজন বলে উঠলেন- মুনাজাত করলেন না? আমি বোঝার চেষ্টা করছি পরিস্থিতি, কিছু বলার আগেই অন্য মুসল্লি বললেন- করেছেন মুনাজাত। আপনি শোনেননি আর কি!
এই কথার পর ব্যাপারটা মুহূর্তে অনেকটা চাপা পড়লেও ব্যক্তি পর্যায়ে পড়েনি। কারণ, বাইরে জুতোর ভেতর থেকে মোজা নিতে এসে শুনি- বয়স্ক কেউ নামায হলো কী-না সে সংশয়ে ভুগছেন। আরেকজন তাঁকে আশ্বস্ত করছেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মুনাজাত নিয়ে প্রশ্ন তোলা ভদ্রলোক বেশ রাগন্বিত স্বরে বলছেন- আমার না হয় কানে সমস্যা আমি শুনিনি। তাহলে মুনাজাত করলে এখানের অনেকেই কেনো শোনেনি!

নামাযঘরে পায়ে মোজা গলানোর সময়ও শুনি নানা কথা। আসরের নামাযের পর ইমাম মুসল্লির দিকে ফিরে বসেন। আমি বসিনি কেনো, সে-ই নিয়ে কথা। হাদীস আর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রসঙ্গও টানতে শুনলাম। বুঝলাম, আমার মতো সিধে সাধা মূর্খসুর্খ ইমাম পেয়ে এঁরা যে যার মতো রাগ ঝাড়ছে। পান্ডিত্য ঝাড়ছে। মুফতে জ্ঞান আহরণের সুতীব্র ইচ্ছাটাকে গলা টিপে হত্যা করে নত মস্তকে দ্রুত মসজিদ ত্যাগ করি। কে জানে কোন দিকে কোন জ্ঞানের গ্যাঁড়াকলে পড়ে যাই!

ঘটনা এখানে শেষ হতে পারত। আমি যেঁচে কারো সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে যাইনি, আবার এত লোক এত কথা বললেও, সরাসরি কেউ কিছু আমাকে বলেনি। ব্যাপারটা মজার। আমি নেহায়েত ৫৫-৫৭ কেজি ওজনের ছোটখাটো মানুষ, তামিল সিনেমার ষন্ডাটাইপ ভিলেন লুক নেই আমার মধ্যে। সাধারণ গোবেচারা একজন। চেহারা দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারেন- এই লোক আস্ত গবেট। সুতরাং গ্যাঁড়াকলে ফেলে ইচ্ছে মতো শায়েস্তা করা যায়। তবু সেই সময় কেউ আমাকে মোক্ষম দাওয়াই দেওয়ার আগ্রহ দেখায়নি কেন কে জানে!

দিন দুয়েক বাদে আমাদের ডিপার্টম্যান্টেরই একজন ওয়ার্কার এসে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে- আপনি কী আহলে হাদীস?
শুনেই হাসি পায় আমার। হেসে দিইও। প্রতিউত্তরে পাল্টা জিজ্ঞাসা করি, কেন?
সে তখন শুক্রবারের ঘটনা টানে। আচ্ছা আপনি কী মাযহাব মানেন?
মাযহাব না মানার কী আছে ভাই… হেসেই উত্তর দিই। আরো যোগ করে বলি, মাযহাব এসেছে পরে ইসলাম এসেছে আগে। তাই ইসলাম ঠিক রাখাটা জরুরী। বুঝলে?
সে আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারে না। আবার জিজ্ঞেস করে, আপনি সব মাযহাব মানেন? নির্দিষ্ট একটা নয়?
জবাবে ছোট্ট করে বলি, আমাদের এখানে তো হানাফি মাযহাবটাই অনুসরণ করা হয়।
এবার তাকে সন্তুষ্ট মনে হয় খুব। সে নানা কথার ফিরিস্তি নিয়ে বসে। সেদিন কে কী বলেছে না-বলেছে, এবং তার অভিমত কী… এসব একটার পর একটা বলতে থাকে। বুঝছেন এক লোক বলছিল, দাড়ি লম্বা রাখলেই কী ইমামতিতে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে? কোত্থেকে আসছে না-আসছে না জেনে ইমামতি দেয়া ঠিক কি না! তো আমি বললাম… সে তার মতো করে কথা শোনায়। আমি চুপচাপ শুনে যাই, মাঝে মধ্যে এক-দুটো কথা ছুঁড়ে দিই।
একসময় গিয়ে সে থামে। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচি।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

One comment on “আপিসের গপ্পো : ০১

মন্তব্য করুন