একটা সময়ছিলো, যখন এই বাংলায় মাঝিরা একটা নিজস্ব স্বীকৃত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলো । মাঝিদের আগের সেই দিন আর নেই। তবুও খেটে খাওয়া মানুষেরা, যারা বংশানুক্রমিক ভাবেই এই পেশার সাথে জড়িত তারা কোন ভাবেই এই পেশা ছেড়ে যেতে নারাজ ।
কথা হলো এমনি একজন মাঝির সাথে, যার পূর্বপুরুষদের সবাই মাঝি , অন্তত তার জানা মতে । চট্টগ্রামের কর্নফুলীর জলে উৎফুল্ল শিশুর মত ছুটে বেড়াত আবু সালেক মাঝির বাবা। সালেক তখনো শিশু,কিন্তু সেই দিনগুলোর কথা সে কখনই ভুলবেনা হয়ত।
সেই স্বপ্নের মত অতীত, আর কর্নফুলীর জলের অমোঘ আকর্ষন সালেকের মত মাঝিরা কাটিয়ে উঠতে পারেনা,জলের জীবন জলেই কাটে, জলে ঘাটে দু পয়সা রোজগারে তাদের সংসার চলে । আবু সালেক কে জিজ্ঞেস করলাম তাদের সংসার খরচ কেমন চলে নাও এর টাকায় । সে শুধু বিষন্ন দৃষ্টিতে বলেছিলো –
– সেই দিন আর নাই, নাও এর চড়ার মানুষ ও নাই, নুনে ভাতে খেয়ে কোনভাবে টিকে আছি।এখন মানুষ সখের বসে নাও এ চড়ে,প্রয়োজনে না।
আসলেই প্রয়োজন যেখানে বিতাড়িত ,সভ্যতা সেখানে মাথাকুটে মরে। অথচ দেখুন এই আবু সালেকদের পিতা একটা সময় দিব্যি বইঠার জোড়ে সংসার চালিয়ে নিয়েছেন বেশ গুছিয়ে। সে সময় হয়ত যে কয়েকটা নৌকার মালিক মানি বেশ একটা সম্মানের ব্যাপার ছিল।
তাহলে আবু সালেকরা এখন চলেন কিভাবে? ওইযে সখের বসে মানুষ ঘাটে আসে, নৌকায় ঘুরার শখ চাপে, আপাতত মানুষের সখ ই আবু সালেকদের ভরসা। আবু সালেক কে জিজ্ঞেস করলাম,
-বৈঠা দিয়ে নৌকা চালান, মাঝে মাঝে চট্টগ্রামের নেভাল ২ নামে পরিচিত এই ঘাটেরে সৌন্দর্য পিপাসুরা চড়ে তাতে। আয় কেমন হয় আপনার ?
-আয় তেমন নাই, এক রাউন্ড ঘুরাই আনতে ৩০০/৪০০ টাকা নি।
-একটু বেশি হয়ে যায়না?
-ভাই, এই টাকায় সংসার চলে, আর আগে তো মানুষকে পারাপার করে দিতেই টাকা উঠে যেত, এখন মানুষ চড়লেও ,প্রয়োজনে ষ্টীম বোট করে পার হয়, নদীর উপর দিয়ে এখন ব্রিজ ও আছে।
-অন্য পেশায় যান না কেনো?
-বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারিনা, তবে আমাদের ছেলে পেলেরা হয়ত আর এই পেশায় থাকবেনা, নদী এখন আগের মত আর দেয় না কিছুই। তার পর এখন যা টাকা আসে তার একটা অংশ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া লাগে। আমাদের আর নিজের বলে কিছুই নাই।
-হুম, থাকেন কই?
-কই থাকবো, রাতে নৌকায় ঘুমাই, নৌকাই আমাদের ঘর, আমাদের সংসার ।
তাড়া থাকায় আবু সালেকের সাথে এর চেয়ে বেশি কথা হয়নি আর। এভাবেই হয়ত ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে একদিন বাংলার ঐতিহ্যবাহী আরেকটি পেশা, সে জায়গা দখল করে নিবে সভ্যতা।
ফিরে এলাম চট্টগ্রামের অভয়মিত্র ঘাট থেকে, যাকে অনেকেই নেভাল ২ বলে থেকে। দেখে এলাম ক্ষয়িষ্ণু এক প্রান-শক্তিকে। হয়ত প্রশাসনের সুনজরে আসলে, এই মাঝিরা আরেকবার আশার আলো দেখতে পাবে, আমাদের ঐতিহ্য কে ধরে রাখা আমাদের প্রশাসনের কর্তব্য, আমাদের কর্তব্য ।
অভয়মিত্র ঘাটের মাঝিকে নিয়ে চিনা করতে করতে শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদের একটা গানের কথা খুব মনে পড়ে গেলো—-
মাঝি বাইয়া যাও রে।
অকুল দরিয়ার মাঝে
আমার ভাঙা নাও রে।।ভেন্না কাষ্ঠের নৌকা খানি।
মাঝখানে তার বুরাআগার থাইকা পাছায় গেলে।
গলুই যাবে খইয়া রে।।দীক্ষা শিক্ষা না হইতে
আগে করছো বিয়া।
বিনে খতে গোলাম হইলে
গাইটের টাকা দিয়া রে।।বিদেশে বিপাকে যারও
বেটা মারা যায়।
পাড়া-পরশি না জানিয়ে
জানে তারও মা’য়ও রে।।
মাঝি বাইয়া যাওরে্,………