আজকে যার সম্পর্কে লিখব তার সম্পর্কে লেখার ইচ্ছে অনেক দিনের। সারা পৃথিবীবীর সব মানুষের মাঝেও আমি এই মানুষ টাকে ঠিকি চিনে নিবো। মাঝারি উচ্চতার ছেলেটা বারে বারে শুধু পিলে চমকে দিত সবার। ভদ্রতার বালাই ছিলোনা, আড়ষ্টটার স্থান ছিলোনা তার চরিত্রে। তবুও তাকে আমি মনে রেখেছি সবার চেয়ে আলাদা ভাবেই।
মেঘ না চাইতেই জলের মত, আর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই তার আগমন। বহদ্দারহাট বাস স্টেশনে ছিলাম সেদিন। রাত ১১ টা। উদ্দেশ্য ছিলো রাঙ্গামাটি যাবো। কেন জানি সেদিনের সব বাস না যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলোপ। সেসব আর মনে নেই এদ্দিন বাদে। যাক সে কথা রিপনের কথায় আসি। রাত ১১ টার একটু পরে যখন নিভু নিভু আগুন হাতে, ঝুম বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আমি দিক খুজে পাচ্ছিনা, দিশে হারা নাবিকের মত, তখন ম্যাচের আগায় বারুদের মাথার অধিকারি এক কিশোর বালকের প্রবেশ ঘটলো রঙ্গমঞ্চে।
কাছে এসেই আগুন চেয়ে বসলো , মেজাজ টা খিচড়ে গেলো। দুইদিনের ছেলে কিনা আমার কাছে আগুন খুজতে এসেছে। তবুও দিলাম আগুন। শুনেছি এই বয়সের ছেলেপেলেরা হাবিজাবি খেয়ে পকেটে ইয়ে টিয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সাবধানের মার নেই ভেবে দিয়ে দিলাম আগুন!
বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। মুশলধারার বৃষ্টিতে সব দিক যেন ভেঙ্গে যাবে । একজন ২৫ আর একজন ১৮ বছরের বালক কলুষিত করছে পরিবেশ ধুম্রজালের বুননে। ছেলেটা কে জিজ্ঞেস করলাম,এই তোর নাম কি?
“আসল নাম?”
“জানিনা”
“হুম, আপনের নাম কি?”
“আমার নাম আমি”
“অ আইচ্ছা”
অ আইচ্ছা বলে রিপন বিরস বদনে বৃষ্টির পানে চেয়ে রইলো। আমি তার সম্পর্কে আরো জানতে আগ্রহি ছিলাম। কিন্তু জিজ্ঞেস করার ভরসা পাচ্ছিলাম না। কোন সময় কোন কথায় কি মনে করে বসে বলা যায় না।
সে নিজে থেকেই বলে বসলো আমার বাড়ি নরসিংদি, সেখান থেকে পালায়ে আসছি। মনে কিছু নিয়েন না, আপনারে ভাল পাইসি তাই বললাম।
ভাল পাইসস মানি?
রিপন কিছু না বলে চুপ করে থাকে।কিছুক্ষন চুপ থেকে সে বলে উঠে “ভাল পাই মানি আপনাকে ভালো লাগসে” । সে কথার তুবড়ি ছোটায় ” পালায়ে আসছি সৎ বাপের মাইরের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে, মায়ে কান্দে বাপের মাইরে, আমি আর দেখতে পারলাম না, থাকলে ওই লোকরে । খুন করা লাগবে আমার,তাই চলে আসছি” ।
নরসিংদীর ছেলেদের বদনাম শুনেছিলাম এক বন্ধুর মুখে, তাই রিপনের মুখপানে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমি আমার বিচলিত মন কে শান্ত রাখার প্রয়াশ পেলাম। রিপনের এখন যে বয়স,এ বয়সে ধুম করে একটা খুন করে বসা কঠিন ব্যাপার না। এখন হচ্ছে তার বেড়ে ওঠার বয়স, মাথা গরম থাকতেই পারে।
ধুম করে একটা খুন করে বসলে, লোকে হয়ত বলবে “আরে বাদ দেন,ছোট ছেলে রাগের মাথায় মেরে দিসে” ।
আর আমার নিস্তেজ শরীর নেতিয়ে পড়ে রবে । এ আমি ভাবতেই পারছিনা, বাদ দি সে কথা।
রিপন কে সাহস করেই জিজ্ঞেস করলাম , “আসল বাবা কই গেসে?’
রিপনের নির্বিকার উত্তর সে আমাদের ছোট কালেই দেশ ছাড়ছে, কই গেসে ,ক্যান ছাড়ছে, আল্লাহ মালুম”
“হুম” আমি বিজ্ঞের মত বললাম। এটা ছাড়া আমি আর কিই বা বলতে পারি। জিজ্ঞেস করবো নাকি , কেমন খারাপ তার সৎ বাবা?
জিজ্ঞেস করার আগেই অবশ্য রিপন ঝেড়ে কাশলো, ” এক কাঠফাটা রোদের দিন শুনি মায়ে নতুন বিয়ে করছে, মনরে শক্ত করে কথাটা মাইনা লইলেও , দিনে দিনে সেই সৎ বাপের অত্যাচারে দুনিয়া আন্দার লাগে” ।
“গ্রামের শালিশে কথা উঠে নাই?”
“ওই লোক, চ্যায়ারম্যান, মেম্বার রে টেকা খাওয়াইয়ে পকেট করছে, হের শালিশ হইবোনা এই দুনিয়ার কোর্টে,তার আসল বিচার হাসরের ময়দানে হইব । তবে সুযোগে পাইলে আমি কোবায়ে খুন করতাম” ।
“হুম” , বৃষ্টিটা আরো বেড়েছে , এই বৃষ্টিতে ভিজতেও ইচ্ছে করছেনা, আবার এই রিপনের থ্রিলার শুনার ইচ্ছেও নেই, বাধ্য হয়েই তীর্থের কাক হয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আলগোছে মাথা সরিয়ে রিপনের দিকে চাইলাম। তার চোখ জোড়া ভাটার মত জ্বলজ্বল করছে। সে চোখে আদিম খুনের নেশা। পারে, এ মানুষ মানুষকে খুন করতেই পারে!
সময় কাটাতে রিপনকে জিজ্ঞেস করলাম,”সৎ বাবা কি করে? নাম কি?”
সে দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো, ” অনীল তার নাম, খামারের কাম-কাজ জানে, সেটাই কইরে খায়”
“হিন্দু?”
“হুম, রমজান নাম নিয়ে আমাদের সাথে আছে, আমারে গালি দেওয়ার সময় সেই নিজের মুক্ষে একবার বলসিলো”
রিপন কে তার পরিবার আর ফেলে আসা অতীত সম্পর্কে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। যার জীবনে সুখের ছোয়া নেই, জীবন যার পালিয়ে বেড়ানোর খেলা মাত্র তাকে অতীত জিজ্ঞেস করে কষ্ট দিতে নেই।রাত প্রায় ১ টা বাজে। রিপন ঘুমিয়ে পড়েছে , আমি থেমে আসা বৃষ্টির থেমে থেমে হয়ে যাওয়া কান্নার শব্দ শুনছি।
রিপন থেমে থেমে ফুপিয়ে উঠছে,যেন ঘুমের ভেতরেও অজানা কোন ভয় তাকে তাড়া করছে অথবা বুকের ব্যাথায় দুমড়ে মুচরে উঠছে শরীর। রাত টা কোন ভাবে কাটিয়ে সকালে বাড়ি ফিরে যাবো চিন্তা করছি। রিপনের চেহারার দিকে তাকিয়ে ঘরে ফেরার তাড়া অনুভব করছিলাম। ঘরের ছেলে পরের হলে কি যে দুঃখ তা রিপনকে দেখে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
বসে বসে আজে-বাজে ভাবতে ভাবতেই বুঝি চোখটা লেগে এলো। হঠাৎ একটা ফোপানির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে বসে দেখি রিপন বসে বসে কাঁদছে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে ২;৩০ বাজে। রিপনের বোধয় তার মায়ের কথা মনে পড়েছে। যত কষ্টই হোকনা কেনো, মাকে ফেলে আসা রিপনের মোটেই ঠিক হয়নি। তাকে বোঝাতে হবে ব্যাপারটা । তাকে ফিরে যেতে বলতে হবে মায়ের কাছে।
আমি কিছু বলার আগেই বিকার গ্রস্থের মত সে আমার কাছে এসে বলল, আমি পাপ করছি , আমি আপনারে মিথ্যা কইসি অনেক, আমারে পুলিশে দেন। আমি বন্যাপারটা বুঝতে পারলাম না ঘর থেকে পালিয়ে আসা নিশ্চই পুলিশে দেওয়ার মত পাপ নয়। আমি রিপন কে জিজ্ঞেস করলাম, কিসের অপরাধে তোমাকে পুলিশে দিবো?রিপন ছোট একটা উত্তর দিলো।
সে শুধু বলল,”খুন”।
“কাকে খুন করছ?” যদিও উত্তরটা জানতাম ,তবুও প্রশ্ন করলাম।
“ওই লোকডারে যে মাইয়েরে প্রতি রাতে মারত, ওই লোকড়ারে যে সবার সামনে মারে দেওয়ালে মাথা ঠুইকে বাড়ি খাওয়াইতো, ওই লোকরে যে মায়ের সব সম্পত্তি নিজের নামে কইরে নিয়ে মারে ঘর থেকে বাইর হইয়া যাইতে কইল ” ।
তাকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ নাকি যে সমাজের আস্কারা পেয়ে মানুষ এমন পশুর পর্যায়ে নেমে যায় সেই সমাজকে কাঠগরায় দাড় করানো উচিৎ আমি ভেবে পাইনা। রিপনের দোষ যদি হয় খুন করা, তবে এই সমাজ সেই খুনির স্রষ্টা হিসেবে চির-দায়ি থাকবে। (সমাপ্ত)
আরোঃ
রিপন কথন, ১ম পর্বঃ তার সাথে পরিচয়
রিপন কথনঃ৩য় পর্বঃ খুন রাঙ্গা জীবন
এই লেখকের আরো লেখনী পড়তে ক্লিক করুনঃ
জাভেদ করিম-ইউটিউবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা,পর্ব-১
আমার জীবনের গল্পটা অন্যরকম ও হতে পারতো
একজন জিহাদের বদলে যাওয়ার গল্পঃ সে প্রোডাক্ট নয়-একজন মানুষ
জাভেদ করিম-ইউটিউবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা,পর্ব-১
জাভেদ করিমঃ ইউটিউবের সহ-প্রতিষ্ঠাতাঃশেষ পর্ব
ভ্যালেরি টেইলর এর জীবনের গল্প-বদলে দেবে আপনার জীবন দর্শন