
একটা দীর্ঘ সময় পাঠ এবং পাঠশালা উভয় থেকে দূরে আছি।কাছে থাকারও উপায় নেই।কারণ হাতে একটা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়।”নে বাবা, তোর বুড়ো বাপের ঘামের মর্যাদা দিয়েছি; এইবার মুড়ি খা”। আমি বলি গলাধাক্কা! এই সার্টিফিকেট চাকরির নিশ্চয়তা না দিলেও, বুঝিয়ে দিয়েছে ” ডিগ্রি কমপ্লিট হয়ে গেছে। এই পাঠশালাতে তোমার আর থাকার থাকা হবে না”।
গ্রাম থেকে বাবা এখন প্রায়শই কল করে। জানতে চায় কিছু হয়েছে কিনা?
কীভাবে বলি,”বাবা, এখানে কিছু হয় না। যা হয় তা গ্রহণ করার সামর্থ্য তোমার নেই”।
এই অল্প কয়দিনে বুঝে গেছি সারিসারি গাড়ি আর আকাশচুম্বী অট্টালিকার রহস্য। শুনেছি “চোরের বাড়িতে দালান উঠে না”। মেঝের আধভাঙ্গা আরশির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি “এই শহরের কোন দালানে চুরির পয়সা নেই”?
এখন আমি শার্টের ভেতরে গেঞ্জি পরি না।প্যান্টের ভেতরে ছোট্ট কাপড়টা ছিঁড়ে গেছে সেই কবে।বন্ধুদের জুতোগুলো যত বড় বা ছোট হোক, দিব্যি পা গলিয়ে ছুঁড়তে পারি অফিস থেকে অফিসে!
একটা চাকরি পেয়েছি। ঔষধ বিক্রি কাম ছেলে পড়ান। এক্কেবারে আস্ত একটা গবেটকে পড়াই। ফার্মেসির মালিকের ছেলে;নাম রবিন। আমার দেখা মনুষ্য গাধা। যা পড়াই তা এই কান দিয়ে ঢুকে আর ওই কান দিয়ে বেরিয়ে যায়।মাঝেমধ্যে মনে হয় কানে ঢুকেই না। রাজ্যের যত কিচ্ছা-কাহিনী মনে থাকে,শুধু পড়াটা মনে থাকে না। মাঝেমধ্যে রাগ হয়,ইচ্ছে করে কষে কয়েকটি দিই। তার ফ্যালফ্যাল করা মুখের দিকে তাকিয়ে তা আর করা হয়ে উঠেনি। অবশ্য অন্য একটি কারণও আছে “লটকন”। রবিনের বড় বোন। অভিভাবকদের আশংকা মিথ্যে নয়। আমার মতো বেকার যুবকদের নজর যতটা না বইয়ের দিকে থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে বউয়ের চিন্তা। রাজ্যসহ রাজকন্যা, যদি লাইগা যায়। লটকন নামটা নিয়ে মেয়েটি প্রায়শ বিব্রত হয়। রবিন ইচ্ছে করেই আমার সামনে খুব সুন্দর করে লটকন আপু বলে ডাকে; কারণে অকারণে। আমি হাসি আর লটকন রেগেমেগে বুনমোষের মতন গোঁ গোঁ করতে থাকে। একবার তো আমার সামনেই হাতের পাঁচ আঙুল বসিয়ে দিয়েছিল।
ইদানীং লটকন সুযোগ পেলেই আমাকে আর রবিনকে টিপ্পনী কাটে। রবিন লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র,ওকে পড়াতে পড়াতে আমি নাকি গাধা হয়ে যাচ্ছি!! তার সাথে সুর মিলিয়ে যখন বলি “রবিন, তুই বড় হয়ে কী হবি”?
চটপট উত্তর “ইঞ্জিনিয়ার”।
এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হলে জাতির কপালে দুঃখ আছে। ব্রিজ বানালে গাড়িশুদ্ধ ভেঙে পড়বে। বাড়ি বানালে ওটা তাজমহল টাইপের স্মৃতিসৌধ হয়ে যেতে পারে।
আচ্ছা, দ্বিতীয় পছন্দ কী?
চঞ্চল হয়ে উত্তর “ডাক্তার”।
ডাক্তার!! ডাক্তার হবি নাকি ডাকাত হবি? তুই ডাক্তার হলে তো রোগী মরার আগেই মরে যাবে। গজ-ব্যান্ডেজ, চাকু রোগীর পেটেই থেকে যাবে।
আমার কথায় ও খুব অভিমান হল। বলল,”স্যার,আপনাকেই আমি প্রথম রোগী বানাব।
আমাকে রোগী!! দোয়া নাকি বদদোয়া? আমি তোকে পড়াচ্ছি আর তুই আমাকে রোগী!!
ও কিছু একটা বলতে গিয়ে বলতে পারছে না। আমি বুঝে গেছি ওর মনে কোন পাপ নেই।বয়স কম তাই কথাটা বুঝিয়ে বলতে পারেনি। মাথায় হাত বুলাতে গেলে দ্রুত সরিয়ে নেয়। ভেবেছে মারব।
রাস্তাঘাটের অবস্থা ভয়ঙ্কর। কে কোথায় কাকে মারছে তা আঁচ করা যায় না।এইসব আন্দোলন, রাজনীতি আমাদের পোষাবে না।তারচেয়ে রাজকন্যাকে কীভাবে সোনার খাঁচায় বন্দী করা যায় ওই চেষ্টা করা উত্তম।
সতর্কতার সাথে চিপাগলি আর মোড় পেরিয়ে কিনে নিলাম একটা কবিতার বই। শুনেছি এটা নাকি খুবই রোমান্টিক। লটকন প্রেমের বিষয়টা বুঝলেও বুঝতে পারে।
বাড়ির সামনে দেখি একঝাঁক কচিকাঁচার মেলা। কিন্তু ওরা কাঁদছে কেন!?
লটকন আর তার বাবাকে কোনভাবেই আটকান যাচ্ছে না। বিলাপ করতে করতে লুটিয়ে পড়ছে রক্তমাখা একটা স্কুল ড্রেসের উপর। তার মা সম্ভবত হাসপাতালে।
আমি চেয়ে আছি রবিনের মুখের দিকে। ওর ক্ষতবিক্ষত দেহের রক্তের দাগগুলো বলছে,”তুমিই আমার প্রথম রোগী”।
পড়ে গেল কবিতার বই। হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম
“মুক্তি চাই”।