আমি সরল,পুরো নাম সরল মাহমুদ চৌধুরী।। বয়স ৩০। আমার নামের মতই আমি সরল সাধারন একটা মানুষ,এভারেজ টাইপ বলতে যা বুঝায় অনেকটা সেইরকম ।ছোটবেলায় ভাল ছাত্র ছিলাম, রেজাল্ট ভাল ছিল।পরিবার, আত্নীয় স্বজনের ধারনা ছিল জীবনে ফাটাফাটি লেবেলের কিছু হয়ে যাব।। কিন্তু দিনশেষে অন্য দশটা ব্রিলিয়ান্ট ছেলের মত আমার পরিনতি ও একই।।ছোটবেলায় এইম ইন লাইফ রচনায় আমরা অনেক বড় বড় কথা লিখলেও বড় বেলায় এসে এইম ইন লাইফটা বাস্তবতার বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় কেমন যেন বদলে যায়। বাস্তবতার পোস্টমর্টেমের পর লাইফটা ঠিক থাকলেও এইমটা আর এইমের জায়গায় থাকেনা।। আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। আপাতত আমার একটা চাকরী আছে, আছে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড আইফোন, আর একটা মাথা মোটা গার্লফ্রেন্ড।।
প্রেম করা যখন শুরু করেছিলাম তখন গার্লফ্রেন্ডের ওজন ছিল ৪৮,এখন ৭৫। গত তিন বছরে ওজন বেড়েছে ২৭ কেজি।। সে হিসেবে বছরে ৯ কেজি, মাসে ৭৫০ গ্রাম,দিনে ২৫ গ্রাম।। জীবন নিয়ে আমার আর তার চিন্তাধারা অনেকটা দন্ড চুম্বকের উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর মত। আমি অফিস শেষে বাসে ঝুলে ঝুলে বাসায় ফিরতে ফিরতে চিন্তা করি কিভাবে আয়টা বাড়ানো যায়। আর সে চিন্তা করে কি হবে এত টেনশন করে?? তার বাবার দেয়া হীরার লকেট আছে, স্বর্নের দুল আছে। প্রায় সময় সে বলে তার লকেটের দাম ২০ লাখ টাকা,বিক্রি করে দিব্যি সংসার চলে যাবে।। আর আমি চিন্তা করি যে জিনিস বছরে এক দুইবার গলায় ঠাই পাই,বেশীরভাগ সময় আলমারিতে পরে থাকে তার দাম ২০ লাখ, আর যে জিনিস ছাড়া মানুষের জীবন অচল তার দাম??????????? মানুষ বড্ড অদ্ভুত প্রানী, বছরে কয়েক ঘন্টার জন্য তার বিনিয়োগ ২০ লাখ, আর বিপর্যস্ত মানবতার জন্য?????? তারপর ও মানুষ ছূটে চলে, ছুটতে থাকে জীবিকার তাগিদে। হয়ত সারা জীবন কাজ করেও তার আয়ের ভগ্নাংশ ও সে জমাতে পারবেনা, তারপর ও পথচলা চলতে থাকে অবিরাম………….
এই পৃথিবীতে আমরা সবাই ছিপ হাতে ঘোলা জলে মাছ ধরতে এসেছি।। কেউ বা চাকরী করে আর কেউ ব্যবসার মাধ্যমে যার যার মাছ ঝুড়িতে ভরছে।। ফ্রেন্ডরা অনেকেই বড় মাছ ধরে ফেললেও আমি এখনো ছিপ হাতে বসে আছি । চাকরী নিয়ে আমার অতীত অভিজ্ঞতা অনেকটা ডালে চালে খিচুরির মত।। এই আছে তো এই নেই এই অবস্থায় থাকতাম সবসময়। আজ এই কোম্পানি তো কাল সে কোম্পানি। পৃথিবীতে সবাইকে একটা নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।।আমাকে হয়ত পাঠানো হয়েছে কেয়ারফুলি কেয়ারলেস থাকার জন্য, যেখানে কখনোই সিরিয়াস হওয়া যাবেনা।। আমি ও এখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে সেই দায়িত্বে আছি। জীবন নিয়ে আমার মতবাদটা ও তাই সিরিয়াসলি সিরিয়াসলেস।। সুখ যখন তার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন তার ফলাফলটা অনেকটা শুন্যে পরিনত হয়।। তাই সুখের ঘরে একটা বাউন্ডারি থাকা উচিত। আমি এখন অনেকটা সেই বাউন্ডারিতে আটকে আছি।।
প্রাইমারী জীবনে খেলার মাঝে এক বন্ধুর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম পাথর দিয়ে। এর আগে পর্যন্ত এলাকায় যথেষ্ঠ সাধাসিধে ছেলে হিসেবেই পরিচিত থাকলেও এই ঘটনা নামের সাথে দুরন্ত ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। পরের ঘটনাটা ঘটেছিল উচ্চ মাধ্যমিকে। তখন আমি ক্লাস এইটে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে এক ছেলেকে ল্যাং মেরে হাত ভেঙে দিয়েছিলাম।। স্যারকে না বলার জন্য চার টাকা দিয়ে ক্যান্টিন থেকে চারটা সিঙারা খাইয়েছিলাম তাকে।। তখন সিঙারা ছিল এক টাকা, কিন্তু স্বাদ ছিল অসাধারণ।। ছেলেটি কথা রাখেনি, ঠিকই বলে দিয়েছিল প্রিন্সিপালকে।। বাকিটা ইতিহাস……. এই দুটি ঘটনা ইচ্ছাকৃত থাকলেও পরেরটা ছিল সম্পুর্ণ অনিচ্ছাকৃত। তখন কাঠের বল দিয়ে ক্রিকেট খেলার অভ্যাস ছিল।যদিও সে সময় সবার দৌড় ছিল টেপটেনিস পর্যন্ত। ভালই খেলতাম বলতে গেলে। একবার খেলার সময় শর্ট নিতে গিয়ে বল সোজা এক কাজিনের মুখে, পুরাই রক্তাক্ত অবস্থা।। মনে আছে সেদিন বাবার ভয়ে দুই ঘন্টা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। সেটাই ছিল কাঠের বল দিয়ে খেলা আমার শেষ ক্রিকেট ম্যাচ।
দুরন্ত শৈশব বলতে যা বুঝায় আমারটা ঠিক সেটাই ছিল।। ছোট্ট আমি দুষ্টু আমি সে বুক ভরা আবেগটুকু নিয়ে হঠাৎ করে হয়ে গেলাম বড়। এখন কেয়ারফুলি কেয়ারলেস থাকাটা আর হয়ে উঠেনা । সিরিয়াসলেস শব্দটার শেষ অক্ষর গুলো বদলে গিয়ে জীবনটা এখন সিরিয়াসনেসে পরিপূর্ণ। একসময়ের দুরন্ত স্বাধীন ছেলেটিকে এখন সবকিছুর জন্য জবাবদিহি করতে হয়। তার স্বাধীন মনের রাজ্য থেকে কিছু মানুষকে ভালবাসার ট্যাক্স দিতে হয়। দিনশেষে তার মাথামোটা গার্লফ্রেন্ডকে ফোন দিয়ে আজগুবি কথা বলতে হয়…….
-হ্যালো বাবু,কেমন আছ??
-এইতো বাবু ভাল,তুমি??
-ভাল। খাইছ??
-হুম। তুমি সারাদিন আমাকে একটাও ফোন দাও নি।
-সরি বাবু,অনেক ব্যস্ত ছিলাম।
-সারাদিন কি কি করলা??
-কর্নেল হাটের মোড়ে আজ কতগুলা মশা ডিম পাড়ছে তা গুনলাম।
-সিরিয়াসলি?? হাউ ইন্টারেস্টিং!!
– হুম, অনেক।
– তোমাকে মশা কামড় দেয়নি??
-না বাবু,মশারা চর্বিওয়ালা মানুষকেই বেশী কামড়ায় । আমার তো তেমন চর্বি নাই।
-আমাকে একদিন নিয়ে যাবা?
-না বাবু।
-কেন?
– ঐ যে বললাম,মশারা চর্বিওয়ালা মানুষকে বেশী কামড়ায়।
-মানে?
-মানে আমার ঘুম পাচ্ছে খুব,কাল কথা হবে।
– ওকে বাবু, গুড নাইট।