পিতৃত্ব

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

 

মাঝে মাঝে জীবনের লাভ ক্ষতির হিসাবটা মিলাতে বসে সে।সবকিছু কেমন যেন হযবরল হয়ে যায় তার। মস্তিষ্কের নিউরনে স্মৃতির পাখিরা কেবল ডানা ঝাপটাতে থাকে। মন খারাপেরা কেবল ডুকরে কেঁদে উঠে। অন্তরাত্মায় কেবল বাজতে থাকে হায় হায় বেলা যে বয়ে যায়।
কত কিছু করার ছিলো,কত কিছু বলার ছিলো,কত কিছু হওয়ার ছিলো। অবশেষে সকলই রইল বাকী।।
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন গলা পেঁচিয়ে ধরে বলে,
পাপা,,,,,
লুমেন এর ভাবনার আকাশে ছেদ পরে। সে তার হাত দুটি মাথার উপর দিয়ে চেয়ারের পিছনে দাড়িয়ে থাকা আগন্তক কে প্রচন্ড আবেগে পেচিঁয়ে ধরে।
আগন্তুক তখন হা,,হা,,হা,,,রবে লুটিয়ে পড়ে তার কোলে।
হিমমম। এ হচ্ছে তার সাত বছরের ছেলে নাবহান। তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
সে নাবহান কে কোলে তোলে নেয়। তার দুই গালে ইইইয়ায়া বড় বড় দুইটা ওম্মা দিয়ে দেয়।
নাবহান খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে পড়ে।
লুমেন এর সাথে তার কোন দেয়াল নেই। পাপা হচ্ছে তার বন্ধু।খেলার সাথী।সে নির্দ্বিধায় পাপার সাথে সবকথা শেয়ার করে।
আচ্ছা পাপা তুমি কম লেখাপড়া করেছো,
নাকি বেশী লেখাপড়া করেছো।
কেন পাপা?
আগে বলো না।
লুমেন দুষ্টুমির ছলে বলে কম করেছি।
ও,,হু তাইলে তোমাকে দিয়ে হবে না। মন খারাপ করে নাবহান।
কি হয়েছে?হোম ওয়ার্ক শেষ করোনি?
নাবহান ডানে,বামে তাকায়। তারপর লুমেনের মুখে হাতচাপা দেয়,গলার স্বরটা নীচু করে বলে আস্তে বলো,মাম্মী শুনতে পাবে।
মাকে সে ভীষন ভয় পায়।
ছেলের ভয়মিশ্রিত মুখখানা দেখে লুমেনের খুব মায়া হয়। সে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নীচু স্বরে বলে- ওকে,আই উইল সল্ভ ইউর প্রবলেম।
নাবহান খুব খুশি হয়ে যায়।
লুমেন তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়।
এক সাগর সম স্বর্গীয় সুখে তার মন ভরে যায়।
আহা!পৃথিবী অনেক সুন্দর। এখানে বেঁচে থাকা বড় আনন্দের।

স্মৃতির পাখিরা আবারও ডানা ঝাপটাতে শুরু করে।
ছোট্ট একটা লিকলিকে হাল্কা পাতলা কিশোর বালকের দেখা মিলে সেখানে। সমুদ্রের বালিয়াড়িতে লাল কাঁকড়ার দলের পিছু পিছু ছুটতে থাকে সে। মাথার উপরে বিশাল আকাশ আর সমুদ্রের নীল জলরাশি। বালিয়াড়িতে আছড়ে পড়া উচুঁ-উঁচু ঢেউ।জীবনের প্রথম সমুদ্র দেখা। বালকের মনটাকে করেছে মোহাবিষ্ট।আবেগের আতিশয্যে ভুলে গেছে সে কে?
সে যেন তার চেনা জগত থেকে বহু দূরে চলে এসেছে। হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে। তার চেনা জগতের বাইরের পৃথিবী এতো সুন্দর।
হঠাৎ একটা বলিষ্ঠ হাত তাকে আঁকরে ধরে।
খোকা সাবধান! ওখানে চোরাবালি আছে।
বালকের চোখেমুখে তখন রাজ্যের বিস্ময় খেলা করে।
সেকি! বাবা!
তুমি এখানে?
তোমার বিপদে আমি দূরে থাকি কি করে খোকা।
বাবা””’বাবা””’
ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসে লুমেন। ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে গেছে তার শরীর। চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে। হয়তো তা অশ্রু হয়ে ঝরবে যে কোন সময়।
গোঙ্গানি র শব্দ শুনে লুবনা ও উঠে বসে। কি হয়েছে?
লুমেন অস্ফূট শব্দে বলে “বাবা”!
স্বপ্ন দেখছিলে। তুমি ঘুমাও আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দেই।
লুমেন জানে তার আর ঘুম আসবে না। বাবার জন্য তার বুকটা হাহাকার করতে থাকে।
বিছানায় তাকিয়ে দেখে নাবহান তার বালিশ থেকে অনেক নীচে নেমে গেছে।ছেলেটা ঘুমের মধ্যে অনেক গরাগরি যায়।সে নাবহান কে ঠিক করে শুইয়ে দেয়।তার নরম,কোমল চুলের মাঝে নাক ডুবিয়ে দেয়। আহ! কি মিষ্টি গন্ধ! তার গালের সাথে গাল লাগিয়ে রাখে। মনে মনে বলতে থাকে, আমার বাবা,,,,,,

স্মৃতির পাখিরা আবারও ডানা ঝাপটাতে থাকে। কতদূর থেকে দূরের, ফেলে আসা সেই হারানো দিন খুঁজে নিয়ে আসে।
লুমেন তখন আট বছর বয়সের হবে। দুস্টুমি করতে যেয়ে কিছু একটা ভেঙে ফেলেছিলো।
মায়ে র বকুনি খেয়ে রাগ করে কলোনির মাঠে চলে গিয়েছিলো।সারাদিন পার করে দিয়েছিলো। এদিকে বিকেল গরিয়ে সন্ধা নামে নামে প্রায়। তার একটু ভয় ভয়ও লাগছিলো।
হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন তাকে জাপটে ধরে। সে ভয় পেয়ে তাকাতেই দেখতে পায় বাবা।
বাবাকে জড়িয়ে ধরেই সে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
বাবা তাকে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে নেয়। তারপর কোলে নিয়ে বাড়ির পথে হাটতে থাকে। তাকে বুঝাতে থাকে ছেলেদের কাঁদতে হয় না। তুমি আমার একটা বোকা ছেলে।
আহা! আমার সেই শক্ত সমর্থ বাবা আজ কোথায় চলে গেছে।কেমন আছে মাটির নীচে সেই অন্ধকার ঘরে?

পিতৃত্ত। আসলে পুরো ব্যাপারটাই একটা চক্র। পুরোটাই হচ্ছে আমি,তুমি আর সে র খেলা।এইযে আমার বাবা পৃথিবীতে এসেছিলো, আমার দাদা র ঔরসজাত হয়ে।
তারপর আমার বাবার ঔরসে আমি, এরপর আমার ঔরসে নাবহান, তারপর নাবহান থেকে অন্য কেউ,তারপর অন্য কারো থেকে অন্য কেউ ,,,,,,এভাবেই প্রকৃতি তার চক্রাকার কার্যক্রম চালাতে থাকবে, যতদিন সৃষ্টিকর্তা চাইবে।
আমার মনে হয় পিতৃত্বের কখনও মরন হয়না। পিতৃত্ব অমর। ছোটবেলায় পড়েছিলাম-
“ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা,
সব শিশুরই অন্তরে”।
পিতৃত্বের ধারা কে অব্যাহত রাখার জন্য আমরাই তার নাম দেই বংশধর।
জানালার শিক গলে সকালের সোনালী রোদ লুটিয়ে পড়ে লুমেনদের বিছানা জুড়ে।
রৌদ্রের উষ্ণ স্পর্শে নাবহান এর ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে পরে।সে বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শোয়।
তা দেখে লুমেন মুচকি মুচকি হাসে। আজ ছুটির দিন। আজ তাদের কারো কোন তাড়া নেই।
অমি রেজা।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া