একটি বর্ষণ-মুখর সন্ধ্যা

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

 

দারিদ্র্যতার বর্ষণে জীবনের রং বদলাতে বদলাতে একেবারেই ফ্যাকাসে।বিবর্ণ সময়ে যখন এক একটি নিকোটিন শলাকা বিলাসিতা ঠেকছে ঠিক সেই সময় মুনার ফোন “ঢাকায় আসতে পারবে”?
-তোমার “পারবে” অনুমান শতভাগ সত্যি। 
-মন ভালো নেই;ভাবছি আড্ডা দেবো। 
-গাড়ির ভাড়াটা এখন আমার কাছে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
-হাজারখানেক; চলবে?
-চলবে মানে… দৌড়াবে। 
কিছু বলতে গিয়ে দেখি লাইনটা কেটে গেছে।প্রায় ঘন্টাখানেক পর বিয়ে বাড়ির মরিচা বাতির মতো মোবাইলে তুমুল আলোড়ন; বিকাশ ম্যাসেজ। দুই হাজার টাকা!! যাক বাবা,পুরো মাসের নিকোটিন আঞ্জাম দেওয়া যাবে। আচ্ছা, ওকে ধোঁকা দেওয়া কি ঠিক হবে? এমনিতে বান্ধব মহলে আজকাল আমার বেশ চর্চা হচ্ছে। সামনে অভিমানী রূপ দেখালেও পেছনে ধাপ্পাবাজ, বাটপার বলতেও ছাড়ে না। আরে বাবা তোদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফেরৎ দিইনি তো কী হয়েছে? আমি তো আর পালিয়ে যাইনি। 
নাহ্, মুনাকে ঠকানো ঠিক হবে না। চটজলদি জামাটা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। পেছন থেকে গিন্নি মনে হয় কিছু বলছিল, আমি ঠিক শুনতে পাইনি। কী আর বলবে? নিশ্চয় ভদ্রভাষায় কিছু গালমন্দ। ওটা ইদানীং যাপনের অংশ হয়ে পড়েছে।

ঢাকায় এসে বুঝতে পারলাম আমার সিদ্ধান্ত ভুল! সাঈদ, মিজান, নিলুফা, শীলা,এমনকি বুড়ো পাপ্পু আর নাসিম সাহেবও এসেছে।আর তাদের সাথে তারা! এই মহিলাকে আমি প্রচণ্ড ভয় পাই। পুরো নাম তারামন বিবি।প্রগতিশীল,মেধাবী আর ঠোঁটকাটা। সুশীল সমাজ থেকে সাহিত্যিক প্রায় সবাই চেনে। মাস ছয়েক আগে কুড়ি হাজার টাকা নিয়েছিলাম। আজ মনে হয় উসুল করেই ছাড়বে। জাফর ভাই থাকা সত্ত্বেও রক্ষে পাবো বলে মনে হচ্ছে না।
সোফায় বসতে না বসতেই অনুমান সত্যি করে তারার খোঁচা “সর্বভুক, কেমন যাচ্ছে”?আরও কিছু বলার আগেই মুনার থামিয়ে দিয়ে বলল”দাদা, নাস্তাটা সেরে নাও তারপর ছাদে বসে আড্ডা দেবো”।
বারী ভাই বলল “তা বেশ.. তা বেশ”। নিলুফা প্রায়শই চুপ্ থাকে। খুব ভালো শ্রোতা বাক্যটি অনায়াসে তার সাথে জুড়ে দেওয়া যায়। 
মিজান ভাই কোনকিছু বাছবিচার করে না। সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে যায়। আমি একবার টিপ্পনী কেটে বলেছিলাম “হলুদ”। গায়েই মাখেনি উল্টো একগাল হেসে আমাকে বেকায়দায় ফেলে!
পাপ্পু ভাইকে আধুনিক বইপোকা বললে অতুক্তি হবে না। না হলে আড্ডাতে কেউ একগাদা কিতাব নিয়ে আসে?
জলযোগ শেষ হওয়ার আগেই সাঈদ ব্যতিব্যস্ত “এটা কীভাবে হয়েছে আর ওটা কীভাবে হবে”! এই ব্যাটা পরিচালক না হয়ে সাহিত্যিক হলে নির্ঘাত আমাদের মতন চুনোপুঁটিদের কপালে শনি ছিল।
মুষলধারে বৃষ্টি। মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে।
“কাদের, একটা গান শোনাবে”?
কাদের কিছু বলার আগেই তারা চেঁচিয়ে উঠল। কারও কথাই শুনছে না।
“এই কালা গর্ত, তুই গানের কী বুঝিস? সৌদি গিয়ে মোল্লা হয়েছিস না। নারীর পক্ষে কথা বললে আমি নাস্তিক! সাহিত্যচর্চা হারাম! এঁ! প্রগতির কথা বললে আমি অচ্ছুৎ! এই দেশের জন্মদাতা আমি মেনেছি, মানবো; দেখি তোর মতো কাঠমোল্লারা কী করতে পারে। সারাজীবন অন্ন,বস্ত্র,শিক্ষা,চিকিৎসা, বাসস্থানের জন্য লড়বো”। 
সে ক্লান্ত,ঘর্মাক্ত, উত্তেজিত।
সবার মৌনতা এড়িয়ে জানালার গ্রিল ধরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম সদ্যস্নাত শহরের বুকে। স্কন্ধে ঠাণ্ডা, শীতল, জমে যাওয়া একটি হাত। মুখ ঘুরিয়ে দেখি মুনা!
“দাদা, আমরা সব জানি। প্লিজ, ফিরে এসো। তারা তোমাকে আবার কৃষ্ণ গহ্বরের মতন দেখতে চায়।আমরাও চাই তুমি লিখ। প্লিজ দাদা, ভুল বুঝ না”।
নিজের সমস্ত গ্লানি দুহাত দিয়ে মুছে সোজা তারার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলুম উন্মুক্ত সড়কে।
“কবিতা শুনতে চেয়েছিলে না। এই দেখ দিনের আলোতে জোছনা নেমেছে রাজপথে। হাজার হাজার কচিকাঁচা জোনাকি বুকের আলো দিয়ে বলছে “ইনসাফ চাই”। ওই যে দেখছ যুবতী মায়ের ছেঁড়া আঁচলে নবজাতকে বৃষ্টি থেকে আড়াল করার চেষ্টা; এর নাম সংগ্রাম। তোমার লড়াই বস্ত্রের জন্য নয়; তোমার লড়াই বস্ত্র ত্যাগের যারা তথাকথিত আধুনিক। সামিয়ানার বাইরে ওই যে দেখছ ভুখা নাঙা ভিখারির দল, ভাবছ ওরা কাঙালিভোজ পাবে? না তারা নাহ্। ওরা একটু পর সিনেমা দেখবে। কাঙালিভোজের জন্য পিতার সন্তানদের মারামারি দেখবে”।
আমি আর কিছু বলতে পারিনি। পাথরের সামনে নিশ্চুপ থাকতে হয়।নচেৎ পাথর চৌচির হয়ে যেতে পারে। নেমে আসতে পারে নোনতা ঝর্ণাধারা। যা ইতোমধ্যে তারার চোখে উঁকি দিচ্ছে।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া