জিহাদ বসে আছে। অনেক খুশি খুশি ভাব তাঁর মধ্যে। গত কয়েক মাসে এক লাফে তাঁর ব্যবসা ফুলে-ফেপে উঠেছে। যেদিকেই তাকায় সাফল্য, আর কি লাগে জীবনে। টাকার যে টানা-টানি ছিলো তাও ইতিমধ্যে মিটে গেছে। এখন সে যেনো হাত ঝারলেই টাকা! জিহাদের নতুন বন্ধু হয়েছে, ব্যবসায়ীক বন্ধু। পুরাতনেরা সেখানে আর জায়গা পায়না। কিভাবে পাবে! জিহাদের স্কুল লাইফের বন্ধু রিফাত এখনো টীউশনি করে বেড়ায়, আর সোহেল এখনো ঠিকমতো অনার্স টাও শেষ করতে পারলোনা। তাঁদের সাথে চলতে এখন জিহাদের গায়ে লাগে!, অথচ এতদিন তাঁদের সাথেই কেটেছে জীবনের একটা বড় অংশ।
কিন্তু সে ক্ষন আর নেই এটা জিহাদ বুঝেছে গতকাল। সে তাঁর বন্ধুদের সাথে টঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো, এমন সময় একটা গাড়ি এসে পাশে দাঁড়িয়ে পরে, ঝা-চকচকে গাড়ী থেকে, পোলিশ করা বুট পরে নেমে আসে অভিজাত এলাকার নিলয় চৌধুরি। জিহাদ উঠে দাঁড়ায়, এবং সেই মুহূর্তে তাঁর কেন জানি মনে হয় রিহাত আর সোহেল কে নিলয় এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তাঁর কোথায় যেন বাঁধে। নিলয় ও জিহাদের দুই বন্ধুর দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছেনা, আসলেই হয়ত রোদ-চশমার কারনে কিছু দেখছেনা!
সেদিন জিহাদ রিফাত আর সোহেল এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলয় গাড়ীতে উঠে হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন! আর মনে মনে বুঝতে পারলো, সে অনেক উপরের লেভেলে এখন, নতুন ব্যবসায়ীক বন্ধুদের সাথে তাল মেলাতে গেলে,এখনি সময় পুরাতন কে ছেড়ে দেওয়ার। নিলয় যেমন বলে,” এসব লোয়ার ক্লাস ,মিডল ক্লাসের ছেলেদের সাথে ঘুরে ক্যারিয়ার নষ্ট করোনা” । জিহাদ সত্যিকার অর্থে সেদিন থেকে রিফাত আর সোহেলের সঙ এড়িয়ে চলে।
**********
সোহেল আর রিফাত যে বুঝেনা তেমন টা নয়। তাঁরা বেশ ভালোই বুঝতে পারে। বন্ধু জিহাদ বদলে গেছে। এখন তাঁর মেলামেশা উপরের লোকেদের সাথে। বুকে চাপা কষ্ট, আর অভিমান চেপে রেখে তাঁরা বিশ্বাস রাখে একদিন তাঁরা আগের বন্ধু কে ফিরে পাবে। সোহেল রিফাত কে বলে, ” একদিন ও ঠিকি বুঝবে আসল বন্ধু কারা”। রিফাত সাত বছরের বন্ধুত্বের কষ্ট বুকে চেপে বলে, ” হয়তবা! আমরা হয়ত জিহাদের যোগ্য ছিলামনা”। এর পরি তিন বন্ধুর কাটানো মধুর সময় গুলো তাঁর চোখে ভেসে বেড়ায়, চোখ নিজের অজান্তেই যেন হঠাৎ কেঁদে ফেলে।
*************
আজ জিহাদের কাছে অতিতের দিন গুলো বারবার ফিরে ফিরে আসছে। সে পাশ ফিরে শুয়ে আছে,মাথাটা যন্ত্রনা করছে। পরিস্কার চাদর আর মেঝের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরে একটা চাপা ক্ষোভ সে বেশ বুঝতে পারছে। আজ তিন দিন হলো, সে হাসপাতালে , মরন-ব্যাধির সাথে যুদ্ধ করছে। কৈ কেউ আসেনা তো! নিলয় তার কলটা পর্যন্ত রিসিভ করছেনা! বোধকরি জিহাদের অর্থশাস্ত্রের নীতি অনুযায়ি চাহিদা কমেছে, অর্থের বাজারে সে এখন একটা ডিফেক্টিভ প্রোডাক্ট মাত্র।
জিহাদের কাউকে জানাতে ইচ্ছে করেনা। একাউন্টে টাকা আছে, হাসপাতালে টাকা দেওয়া আছে ঢের, তাঁর চিকিৎসা চলবে, যদিও তাঁর ভেতর থেকে কেউ বলছে তাঁর আর এই পৃথিবীতে বেঁচে থেকে লাভ নেই। সে একবার ভাবে সোহেল আর রিফাত কে বলবে। কিন্তু ভেতর থেকে সংকোচে সে কুকড়ে যায়! এভাবেই জিহাদের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পরিবারের লোকজন খবর পেয়েছে আগেই, তাঁরা ভিড় জমাচ্ছে একজন মৃত্যু পথযাত্রি মানুষকে শেষ বিদায় জানাতে! বাবা নেই, মার চোখের জলে জিহাদের কপালে হালকা একটা ঠান্ডা অনুভূতি হয়। জিহাদের ভাই রা এসেছে , তাঁরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিহাদের একাউন্টের টাকার পরিমান আর কোথায় কত আছে বের করতে চাইছে। সে যদিও মরেও বা যায় হয়ত তাঁর দাম ফুরালেও টাকার দাম ফুরাবেনা। জিহাদ কিছু বলেনা, সে হাসপাতালের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। সে এখন আর প্রোডাক্টিভ নয়!
এতদিন ধরে সবাই তাঁকে দাম দেয় নি, দিয়েছে তাঁর প্রোডাক্টিভিটি কে। হয়ত রিফাত আর সোহেল নিষ্কর্মা একজন জিহাদ কে মেনে নিবে, কিন্তু সমাজ নয়। জিহাদের বড় দেখতে ইচ্ছে হয়, রিফাত আর সোহেলকে, লজ্জায় তাঁদের ডাকতে পারেনা।
*************************
জিহাদের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে, পৃথিবীটা চোখের সামনে দুলছে। অনেকদিন হয়ে এলো, প্রায় মাস-খানেক। পরিজনেরা আর আসেনা,তারা আশা ছেড়ে দিয়েছে, আর যেদিন শুনেছে জিহাদ তাঁর টাকার একটা অংশ মাকে দিয়ে বাকিটা এতিম খানায় দিয়ে দিয়েছে,সেদিন থেকে মা আর এক দূর-সম্পর্কের চাচাত ভাই ছাড়া আর কেউ আসেনা। নিজের ভাইরাও না, তাঁরা শহরের বাইরে থাকে, তাঁদের কাজ আছে, তাঁরা এখনো প্রোডাক্টিভ! জিহাদের কষ্টের ভেতরেও একচোট হাসি পায়। জিহাদের চোখ ঝাপাসা হয়ে আসে, আর বুঝি দেরি নেই মৃত্যুর। ঝাপসা চোখেই সে দেখতে পায় রিফাত আর সোহেল হুমড়ি খেয়ে আসছে, তাঁদের চোখে বিস্ময়-কষ্টের মিশ্র আবেগ। সেটাই জিহাদের শেষ , বাকি দৃশ্য সে দেখতে পায়না, সামনের সবকিছু দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেলো।
***************
পাঁচ বছর পরে…
রিফাত আর সোহেল বসে আছে নদীর পাড়ে। জিহাদ যে জায়গা টায় বসত , জায়গাটা খালি পড়ে আছে । টুং টুং আওয়াজে বেল বাজিয়ে একটা রিক্সা এগিয়ে আসছে, আসনে আসীন জিহাদ! না, সেদিন মৃত্যু তাঁকে কাছে ডেকে নেয়নি, বন্ধুদের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছে। জিহাদ আর এখন টাকার পেছনে ছুটেনা! সে বেঁচে থাকতে চায় মানুষ হিসেবে, প্রোডাক্ট হিসেবে নয়। দুই বন্ধু কে নিয়ে একটা কোচিং সেন্টার দাড় করিয়েছে, কিছুটা আয় হয় তাই দিয়ে চলে । জিহাদরা শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ গড়তে চায়, তাদেরকে প্রোডাক্ট হিসেবে গড়তে চায় না! জিহাদ বদলে গেছে, এখন চারপাশের জীবনটা তাঁর কাছে ভিন্ন, জীবন সম্পর্কে তাঁর চিন্তাটা ভিন্ন। আল্লাহর কাছে তাঁর হাজার শোকর , সে এখন আল্লাহর একজন সাধারন বান্দা হিসেবে, সাধারন মানুষ হিসেবে শান্তিতে বেঁচে আছে, সে এখন আর প্রোডাক্ট নয়।