উদ্দেশ্যহীন মেঘের জীবন

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

ছেলেটা অদ্ভুত। স্কুলে চাকরী নেয়ারপর প্রথম যেদিন ৫ম শ্রেনীর ক্লাসনিতে গেলাম, সেদিন থেকেই লক্ষ করছি ছেলেটাকে বয়স হবে ১০, কিন্তু দেখে আরো ২ বছর কম মনে হয়। চেহারা টা বেশ মায়াবী।ফর্সা মুখ। লালচে ঠোট। চোখ দুটো গভীর নীল। সমুদ্রের মতো স্বচ্ছ। কপালে ছোট্ট একটা কাটা দাগ।এলোমেলো রুক্ষ চুল। ময়লা ইউনিফর্ম। প্রতিটা দিনই ক্লাসের শেষ বেঞ্চটায় একা একা চুপচাপ বসে থাকে। কারো সাথে খুব একটা কথা বলে না।মাঝে মাঝে তার চোখের  উপর এসে পরা বড় বড় চুল গুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সরিয়ে নেয়।চুল সরানোর এই অভ্যাসটা আমার খুব পরিচিত। প্রথম দিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেইনি ওকে, কিন্তু কিছুদিন পর খেয়াল করলাম, আমি যখনি ক্লাসে আসি, তখনি ও ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একদিন ক্লাসে শুধু মাত্র বাচ্চাদের আনন্দ দেয়ার জন্য তাদেরকে তাদের প্রিয় জিনিস গুলোর নাম লিখতে বললাম, যেমন প্রিয় ফুল, ফল,পাখি, প্রানী, কাজ, খাবার ইত্যাদি। সবাই খাতা জমা দিলো। সবার খাতায়ই যেমনটা আশা করেছিলাম ঠিক তেমন উত্তর পেয়েছি কিন্তু একটা খাতার উত্তর ছিলো ব্যাতিক্রম।

উত্তর
গুলো ছিলো…….
প্রিয় ফল: কমলা
প্রিয় ফুল: কদম
প্রিয় পাখি: কোকিল
প্রিয় খাবার: কাচ্চি বিরিয়ানি
প্রিয় মাছ: কৈ
প্রিয় খেলা: কানামাছি

আমি অবাক হলাম ওর অদ্ভুত পছন্দ দেখে।এসব কিছু একসময় অন্যকেও বলেছিলোআমাকে। খাতাটা কার সেটা দেখার
জন্য প্রথম পৃষ্ঠায় গেলাম। নাহ কিচ্ছু লেখা নেই। আমি খাতা উচু করে ক্লাসের সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম। এটা কার খাতা। পেছনের বেঞ্চ থেকে সেই ছেলেটা উঠে দারালো। আমি ওকে কাছে ডাকলাম।

আমিঃ তোমার নাম কি?
সেঃ মেঘ।
আমিঃ ক তোমার প্রিয় অক্ষর?
মেঘঃ হুম।
আমিঃ কেনো?
মেঘঃ কারন……
হঠাৎ ছুটির ঘন্টা পরল। মেঘের সাথে
আর কথা হল না আমার।

সারারাত শুধু কেনো জানি মেঘের কথাই ভাবলাম। ওর সাথে কোনো একজনের বড্ড মিল পাই আমি। পরেরদিন আবারো দেখলাম মেঘকে, মাঠের এক কোনায় বসে কি যেনো করছে। আমি ওর কাছে গেলাম। দেখি ও ছোট ছোট অনেক গুলো পাথর নিয়ে সেগুলো তুলির রং দিয়ে বিভিন্ন রং করছে। ছোট বেলায় আমারো এই অদ্ভুত অভ্যাসটা ছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে
সাথে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় পছন্দ অপছন্দের। আমারো পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। আমি ওর
পাশে গিয়ে বসলাম।

আমিঃ কি করছো?
মেঘ আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর
দিল….
মেঘঃ কিছুনা।
আমিঃ কিছুনা বললেই হলো! এইযে
পাথরে রং করছ।
মেঘঃ দেখতেই যখন পাচ্ছ, তাহলে
জিজ্ঞেস করছ কেনো?
আমিঃ হুম, but..can I help u?
মেঘঃ no need!
আমিঃ okay!
এতোটুকু বাচ্চা, অথচ ওর attitude দেখে
অবাক না হয়ে পারলাম না।

 

উঠে আসতে যাবো, ঠিক এমন সময় ও আমার আংুল চেপে ধরলো। এর পর আমার হাতে কিছু একটা গুজে দিলো।
মেঘঃ এটা তোমার জন্য।
আমি দেখলাম একটা ক্যাটবেরী
চকোলেট। আমার খুবই প্রিয় এটা। কিন্তু
ও কি করে জানলো?
আমিঃ এটা……..
মেঘঃ তুমি এখন যেতে পারো।

 

আমি মুচকি একটু হাসলাম। আজ রাতেও ঘুমুতে পারলাম না। জানি না কেনো কিন্তু মেঘ ক্রমাগত আমাকে আকর্ষন করছিল।কিছু তো আছে ওর মধ্যে। মনে পরে যায় পুরোনো কিছু কথা। ১০ বছর আগে একটা এক্সিডেন্ট আমার পুরো জীবনটা এলোমেলো করে দেয়। আমার একমাত্র সন্তানকে হাড়িয়েছি আমি। ওরও ঠিক একই রকম নীল চোখ ছিল। বেচে থাকলে হহয়তো মেঘের মতোই হতো। ওর জন্মের পর মাত্র ১৮ দিন ওকে কাছে পেয়েছিলাম আমি। তারপর সব শেষ। বুকের ভেতর হঠাৎ খালি খালি লাগে আমার। বুকের চিনচিনে ব্যাথাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মেঘকে একটি বার দেখার জন্য আমার মন উতলা হয়ে যাচ্ছে। পরের দিন ওকে দেখলাম স্কুল ছুটির পর একা একা বসে আছে।

আমিঃ মেঘ। তুমি এখানে একা একা বসে আছো কেনো?তোমাকে কেউ নিতে আসেনি?
মেঘঃ না।
আমিঃ কেনো?
মেঘঃ আমার বাবা তো ডাক্তার।
তাই সে অনেক ব্যাস্ত থাকে। এজন্য
মাঝে মাঝে আসতে দেরি হয়!
আমিঃ ওহও। আর তোমার মা?
মেঘঃ আমার মা….

 

হঠাৎ গারির হর্ন বাজলো।
মেঘঃ আমার বাবা এসেছে। আমি
যাই।
মেঘ এক দৌড়ে গাড়িতে উঠে গেলো।

পরের দিন আমি ছুটির আগেই মেঘের ক্লাসের বাহিরে দারিয়ে রইলাম। ক্লাস শেষ হতেই মেঘ বেরিয়ে এলো। আমি ওকে ডাক দিলাম।

আমিঃ মেঘ।
মেঘঃ জ্বি?
আমিঃ আমার সাথে আজকে এক
যায়গায় যাবে?
মেঘঃ না।
আমিঃ কেনো?
মেঘঃ ছুটির পর বাবা আসবে। আর
আমাকে দেখতে না পেলে চিন্তা
করবে।
আমিঃ আচ্ছা ঠিক আছে।তাহলে
আমার সাথে কিছুক্ষন ওখানে বসবে?
যতক্ষণ তোমার বাবা না আসে?
মেঘ এক মুহুর্ত কি যেনো ভাবলো। তার
পর….
মেঘঃ ঠিক আছে। চলো।
মেঘ আমার পাশে চুপচাপ বসে আছে।
আমি ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে
মেঘের হাতে দিলাম।
আমিঃ এটা তোমার জন্য।
মেঘঃ কি আছে এতে?
আমিঃ খুলে দেখো।
মেঘ বক্সটা খুলল।
মেঘঃ কাচ্চি বিরিয়ানি!
প্রথম বার মেঘকে এতোটা উৎফুল্ল
দেখলাম। হাস্যজ্জ্বল মুখ। অপূর্ব।
মেঘঃ সব আমার?
আমিঃ হুম। সব তোমার।
মেঘঃ আমাকে খাইয়ে দেবে?
আমি মুচকি হেসে চামচটা তুলে
নিলাম।
আমিঃ আচ্ছা মেঘ। তোমার বাসায়
কে কে আছে?
মেঘঃ আমি আর আমার বাবা। আর
নরেন দাদু। বাবা তো সারাদিন
হাসপাতালেই থাকে। তাই নরেন দাদুই
আমার দেখা শোনা করে।
আমিঃ আর তোমার মা?
মেঘঃ আমার মা নেই। আমি কখনো
দেখিনি মাকে। কিন্তু বাবা বলে মা
নাকি খুব সুন্দর
আমার মনটা কষ্টে ভরে উঠলো। অদ্ভুত মায়া হচ্ছিল মেঘের জন্য। হঠাৎ বৃদ্ধ এক লোক এলো।

বৃদ্ধঃ ছোটবাবু।
মেঘঃ নরেন দাদু তুমি? আজ বাবা
আসেনি?
বৃদ্ধঃ না, বড়বাবুর আজ অনেক কাজ
আছে। আসতে দেরি হবে। তাই আমিই
এলাম।
মেঘঃ তুমি একটু দারাও। আমি আসছি।
বৃদ্ধ গিয়ে গাড়ির কাছে দারালো।
মেঘঃ ম্যাম আমি যাচ্ছি। তোমার
রান্না খুব ভালো। thank you…bye.

 

মেঘ চলে গেলো। আজ আকাশটা খুব মেঘলা। কালো হয়ে আছে খুব। সূর্যটাকে ঢেকে দিয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি ঢাকতে পারেনি। মেঘের চারপাশে সূর্যের উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ঠিক যেভাবে ঘোর অন্ধকারে একটুকরো আশার আলো বিচ্ছুরিত হয়।
হঠাৎ দমকা হাওয়া বইতে শুরু করলো। সূর্যটাকে আর দেখা যাচ্ছে এখন। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হল। রাস্তাটা পুরো ফাকা এখন, একটা কুকুরও দেখা যাচ্ছে না।স্কুলের বাহিরে পুরোনো ব্যাঞ্চটায় বসে ভিজছি আমি। বুকের ব্যাথাটা আজ বড্ড তীব্র হয়ে উঠছে! কষ্ট গুলো চোখ ফেটে বেরিয়ে বৃষ্টির জলে একাকার হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতির ঘোলাটে পাতাগুলো স্পষ্ট হয়ে আজ আবারো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। ১২ বছর আগে ঠিক এমনি একটা বৃষ্টির দিনে প্রথম বার আদির সাথে পরিচয় হয় আমার। কলেজ শেষে সাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। রাস্তাঘাট ফাকা। বাসায় যাওয়ার তারা ছিলো, আর রাস্তাও ফাকা হওয়ায় আমি wrong side এ চলে গেলাম। কিন্তু হঠাৎই সামনে একটি প্রাইভেট কার চলে এলো। তার পর আর কিছু মনে নেই।যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি হাসপাতালে। চোখ খুলে সর্বপ্রথম যাকে দেখলাম, সে ছিল এক সুদর্শন যুবক। ইঞ্জেকশন হাতে কি যেনো করছে। আবছা আবছা মনে পরলো। এক্সিডেন্ট এর সময় গাড়ির চালকের আসনে ওকেই দেখেছিলাম। আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে সে আমার কাছে এলো…

সেঃ রাস্তা দিয়ে চলার সময় নিজেকে কি ভাবো? রাস্তাটা কি তোমার বাবার সম্পত্তি? জীবনের থেকে সময়ের মূল্য বেশী নাকি? কে
বলেছিলো wrong side এ যেতে? আজ যদি তোমার কিছু হতো, দোষ তো হতো আমার আর আমার গাড়ির। nonsense girl.

ছেলেটা ইচ্ছে মতো আমাকে কথা শুনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। জীবনে প্রথমবার কেও আমাকে এভাবে কথা শোনালো। ওর যায়গায় অন্য কেও হলে এতক্ষণে…..কিন্তু ওর কথায় আমার একবিন্দুও রাগ হলো না। বাবা মা, দাদা দাদু সহ সবাই এসেছে আমাকে দেখতে। বেশী কিছু হয় নি আমার। শুধু হাতে একটু কেটে গেছে। ভয়েই জ্ঞান হাড়িয়েছিলাম। আজকে বিকেলেই হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিবে আমাকে। সেই যুবককে আরেকবার দেখার জন্য আমার চোখ এদিক ওদিক খুজছিলো। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না কেনো তাকে খুজছি। হঠাৎ নার্স এসে সবাইকে রুম থেকে বের করে দিলো। এরকম একটা শুযোগই
আমি খুজছিলাম।

আমিঃ এক্সকিউজমি সিস্টার।
নার্সঃজ্বি?
আমিঃ আ-যার সাথে আমার… মানে যার গাড়ির সাথে আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে, সে কি চলে গেছে?
নার্সঃআপনি কি ডক্টর আদনান অনিন্দ স্যার এর কথা বলছেন?

ওহ। আদনান অনিন্দ। শর্ট কাট আদি!বেশ নাম তো। মনে মনে ভাবলাম একবার।

আমিঃ হ্যা হ্যা। তার কথাই বলছি।
নার্সঃ না, সে এখন এখানে নেই। আজ
আগেই চলে গেছেন।
আমিঃ ওহ, আচ্ছা, আপনার কাছে কি
তার ফোন নাম্বার আছে? না-মানে
যদি হাতে ব্যাথাটা বারে, তার
সাথে যোগাযোগ করার প্রয়োজন হতে
পারে। তাই বলছিলাম!
নার্সঃ ওহ নিশ্চই। লিখুন…01725864★★★

বাড়িতে এসে পুরো এক সপ্তাহ আমি শুধু ভাবছি, আদিকে ফোন দিবো কি না। দিতে চেয়েও দিতে পারিনি। মনের মধ্যে অদ্ভুত কিছু হচ্ছিল। অতঃপর আমি ফোন দিলাম।ওপাশ থেকে সেই কঠিন কন্ঠটা আবার শুনতে পেলাম।

আদনানঃ হ্যালো।
আমার বুকের ধুকধুকানি টা হঠাৎ বেড়ে
গেল। কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম
না।
আদনানঃ হ্যালো। কে বলছেন?
আমিঃ আ-আমি কিরণ।
আদনানঃ কোন কিরণ?
আমিঃ কিরণ চৌধুরী
আদনানঃ ওহ আচ্ছা। সেই nonsense মেয়েটা?যে কিনা রাস্তাঘাটে ঠিক করে চলতে পারে না?

হঠাৎ করেই ওর কটাক্ষ গুলো আমার আত্মসম্মানে খুব লাগলো। এমন একটা লোক যার মধ্যে কথা বলার সামান্য ভদ্রতা নেই তাকে কিনা আমার ভালো লেগেছে। যেখানে আমার সাথে ২ মিনিট কথা বলতে পারলে ছেলেরা নিজেকে ধন্য মনে করে, সেখানে এই ছেলে আমাকে কটাক্ষ করে কথা বলছে! রাগে আমার চোখ লাল হয়ে উঠলো।

আমিঃ excuse me… What are you saying damn it?… Do you know who i am? Kiran chowdhury! understand? So mind your language…. and tell me..what’s wrong with u? problem কি আপনার? কালকেও এভাবে কথা বলেছেন। ছোট একটা ভুলই তো হয়েছে। এতে এতো কথা শোনানোর কি আছে? আমি কি জানতাম যে হুট করে আপনার গাড়ি আমার সামনে এসে
পরবে? আর তার পরেও আমি তো আমার ভুল স্বীকার করেছি। তাহলে আপনি এতো attitude কেনো দেখাচ্ছেন? by the
way…. i am sorry….wrong side এ যাওয়ার জন্য। and thanks … আমাকে বাঁচানোর জন্য। এতোটুকুই বলার ছিল। bye.

এর পর আদনানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি ফোন কেটে দিলাম। শুধু কাটলামই না। ফোনটাও বন্ধ করে রাখলাম। ego hart হলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। রাগে হাতের ব্যান্ডেজটাও টেনে হিচরে খুলে ফেললাম। সেলাইয়ের যায়গা থেকে টপটপ করে রক্ত পরছে। পরের দিন কলেজে গেলাম। ছুটির পর বের হতেই হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাকলো। পিছে ফিরে দেখলাম আদনানকে। ignore করে চলে যাচ্ছিলাম এমন সময়

 

আদনানঃ কিরন, এইযে ম্যাডাম। একটু দারান। আমি না দারিয়ে পারলাম না।

আমিঃ বলুন।
আদনানঃ উফ। কতক্ষণ ধরে ডাকছি বল তো?
আমিঃকেনো? সেদিন অপমান করে মন ভরে নি আপনার? নাকি সেদিন যতোটুকু অপমান করা বাকি ছিলো সেটা পুরো করতে আজ এসেছেন।

আদনানঃ বাব্বাহ! এখনও রেগে আছো  দেখছি!
আমিঃ কেনো? রাগ কি আপনার বাবার কেনা সম্পত্তি নাকি, যে অন্য কেও করতে পারবে না!
আদনানঃ তুমি তো দেখছি ভীষণ প্রতিশোধপ্রবন মেয়ে। আমার কথা আমাকেই শোনানো হচ্ছে!
আমিঃ আপনি কি এসব বলতে এখানে এসেছেন?
আদনানঃ এসেছিতো sorry বলতে….,আসল সেদিন একটু বেশীই বলেফেলেছিলাম। আসলে হয়েছে কি….
আমিঃ কি?
আদনানঃ actually.. তুমি এতোটাবেখেয়ালি কিভাবে হতে পারো?ঐদিন তোমার যদি কিছু হয়ে যেতো। তুমি কি করে বুঝবে আমি কতোটা ঘাবরে গিয়েছিলাম। তোমার প্রিয়জনের এমন কিছু হলে.. তখন বুঝতে!এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে ফেললো আদনান।

আমিঃ প্রিয়জন মানে!
আদনানঃ আ-প্রিয়জন মা-মানে…
আমিঃ হুম বলুন..
আদনানঃ প্রিয়জন মানে প্রিয়জন!
আমিঃ আমি আপনার প্রিয়জন হলাম কবে?
আদনানঃ ও-আসলে.. অনেক আগে থেকে!
আমিঃ কবে থেকে?
আদনানঃ আরে যেদিন প্রথমবার তোমাকে তোমার বান্ধবী নিধির গায়ে হলুদে দেখেছিলাম, সেদিন থেকে! কথাটা বলেই আদনান নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরলো।

আমিঃ কিহ!..আচ্ছা! তাহলে পেটে পেটে এতো! আর সেদিন ভাব দেখানো হচ্ছিলো!
আদনানঃ(মাথা চুলকে) এটা তো কিছুই না! আরো আছে।
আমিঃ আরো আছে মানে!
আমি চোখ বড় বড় করে আদনানের দিকে তাকিয়ে আছি।
আদনানঃ ও- আসলে, যেদিন তোমার এক্সিডেন্ট হলো, সেদিন তুমি wrong side এ কেনো গিয়েছিলে?
আমিঃ আমার একটু তারা ছিলো। মা ফোন করে তারাতারি যেতে বলেছিলো। রাস্তাটাও ফাকা ছিলো তাই…
আদনানঃ তুমি জানো তোমার মা কেনো তোমাকে তারাতারি বাড়ি ফিরতে বলেছিলো?
আমিঃ না। কেনো বলুন তো?
আদনানঃ কারন ওইদিন আমি বাবা মাকে নিয়ে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছিলাম। আর প্রস্তাব দিতে এসেই দেখি তোমার
আর আমার বাবা একে অপরের স্কুল ফ্রেন্ড।
আমিঃ কিহ! তাহলে আপনার গাড়ির সাথে আমার এক্সিডেন্ট হলো কি করে?

আমার চোখগুলো আরও বড় হয়ে উঠলো।

আদনানঃ -actually তোমার আসতে  দেড়ি হচ্ছিলো তাই……
আমিঃ তাই?

আদনানঃ তাই ভাবলাম তোমাকে নিতে কলেজেই চলে আসি। কিন্তু….
আমিঃ oh my god! এত বড় ষড়যন্ত্র !
আদনানঃ ফিল্মি ডায়লগ কেনো দিচ্ছো?
আমিঃ আমার আবার ফিল্ম খুব পছন্দ কিনা!
আদনানঃ আচ্ছা, তো ফের, মুঝসে দোস্তি কারোগী।

আদনান আমার সামনে হাত বারিয়ে রেখেছে। আমি মুচকি হেসে ওর হাতে হাত রাখলাম। এরপর বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা, তারপর বিয়ে, সব কিছুই সুন্দর ভাবে চলছিল। বিয়ের ১ বছর পর আমি প্রেগন্যান্ট হলাম। অনেক প্রতীক্ষার পর আমার কোল আলো করে এলো আমার প্রথম সন্তান।ওর জন্মের ১৮ দিন পর, তখনও ওর নাম রাখিনি, বাবু বলে ডাকতাম।
সেদিন বাবুর খুব জ্বর হলো। বাসায় তখন আমি আর বাবু ছাড়া কেউ নেই। আদনান হাসপাতালে, আমি ওকে বার বার
ফোন দিচ্ছিলাম, কিন্তু ও ফোন উঠাচ্ছিল না। রাত ৮ টা, বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। নিজেই গাড়ি নিয়ে বের হলাম, বাবু হঠাৎ খুব কান্না শুরু করলো। ওকে ধরতে যাবো এমন সময় পেছন থেকে একটা ট্রাক আমাদের গাড়িটা ধাক্কা দিলো। এরপর আমি কিছু জানি না।
আমার জ্ঞান ফিরলো এক্সিডেন্ট এর ৩ বছর ৮ মাস ১৩ দিন পর। কোমায় থেকে ফেরার পর জানতে পারলাম, এক্সিডেন্ট এ বাবু মরে গেছে। আর আদনান, সে দ্বিতীয় বিয়ে করে এখন কানাডা প্রবাসী!
.
হঠাৎ কারো কথায় আমার ভাবনায় ছেদ পরলো। বৃষ্টি টা থেমে গেছে, হয়তো অনেক্ষন আগেই। তবে সূর্যটা এখনো মেঘে ঢাকা।

দারোয়ানঃ ম্যাডাম আপনি এখনও এখানে বসে আছেন। বাসায় যাবেন
না?
আমিঃ হুম।
আমি উঠে এলাম। পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখি মেঘ আসেনি। আমার কেমন একটা লাগছিলো। আমি স্কুল থেকে মেঘের এড্রেস নিলাম।
.
ড্রাইভার গাড়িটা একটা বাংলোর সামনে থামলো। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো সেই বৃদ্ধ। বৃদ্ধঃ আরে ম্যাডাম আপনি।
আমিঃ মেঘ আজ স্কুলে আসেনি? বৃদ্ধঃ আসলে ওর একটু জ্বর, আপনি আসুন, ভেতরে আসুন। আমি ভেতরে এলাম। বাসাটা বেশ গোছানো। আমি মেঘের ঘরে গেলাম, সারা ঘর খেলনায় পরিপূর্ণ। মেঘ খাটে বসে একটা কাঠের ঘোরা নিয়ে খেলছে।

আমিঃ মেঘ…
মেঘঃ তুমি।
(অবাক হয়ে।)
আমিঃ এখন তোমার শরীর কেমন আছে?
মেঘঃ ভালো।
আমি ওর কপালে হাত দিলাম। জ্বর খুব
একটা নেই।
আমিঃ কিছু খেয়েছো?
বৃদ্ধঃ অনেক জোরাজোরি করার পর একটু
পায়েস খাইয়েছিলাম।
আমিঃ ওর বাবা কোথায়?
বৃদ্ধঃ ইয়ে মানে… বড় বাবু তো
হাসপাতালে।
আমিঃ আচ্ছা আপনি যান।
বৃদ্ধ চলে গেলো।
আমিঃ মেঘ তুমি কি খাবে বল। যা
খেতে চাইবে তাই বানিয়ে এনে
দেবো।
মেঘঃ সত্যি?
আমিঃ হুম, বলে তো দেখো।
মেঘঃ আলু পরোটা আর বাঁধাকপির
সবজি।
আমিঃ আচ্ছা। তুমি বসো। আমি
বানিয়ে আনছি।
বৃদ্ধ লোকটি কে বলে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনিয়ে আনলাম।
.
আজ সারাটা দিন আমার মেঘের সাথে কাটলো। অনেকদিন পর আমার জীবনে এমন আনন্দপূর্ন্য একটা দিন আমার জীবনে এলো। রাত প্রায় সারে নয়টা। আমি মেঘ কে ঘুম পারিয়ে দিলাম। বৃদ্ধকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে চলেই আসতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার চোখ পরলো সিরির কোনার দিকের একটা ঘরে।

আমিঃ ওটা কার ঘর?
বৃদ্ধঃ বড়বাবুর।
আমি ওই ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
বৃদ্ধঃ ম্যাডাম,ও ঘরে যাবেন না।।।

বড়বাবু জানতে পারলে ভীষণ রেগে যাবেন। ও ঘরে কারো যাওয়া মানা। আমি গতো ৪ বছর ধরে এ বাড়িতে কাজ করছি, কোনোদিনই সাহস করে ও ঘরে উকি পর্যন্ত দিতে পারিনি। আমি বৃদ্ধর কথায় কর্নপাত করলাম না। রুমের দরজাটা খুলতেই বোটকা একটা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। রুম দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, সারা বাড়িটা যতোটা গোছানো, এই একটা
ঘর তার ১০ গুন বেশী এলোমেলো। হঠাৎ দেয়ালে টানানো একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে গেলো। আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেনো একটা শিতল শিহরণ বয়ে গেল। আমি কাপা কাপা কন্ঠে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম…

আমিঃ মেঘের সাথে দারানো ওই
লোকটা কে?
বৃদ্ধঃ আরে উনিই তো বড়বাবু, ডাক্তার
আদনান অনিন্দ।
আমার চোখটা ছলছল হয়ে উঠলো। মেঘ
তাহলে আদনানের সন্তান!

হঠাৎ পেছন থেকে চিরপরিচিত সেই কঠিন কন্ঠটা শুনতে পেলাম। “কাকা আমার ঘরে কি করছ?তুমি জানো না এ ঘরে ঢোকা নিষেধ। আর উনি কে?”
আমি পিছে ঘুরে তাকালাম।

আদনানের হাতে থাকা ব্যাগটা নিচে পরে গেলো। হয়তো এতোদিন পর এইভাবে ওর বাসায় আমাকে ও আশা
করেনি। তাতে কি, কতো কিছুই তো আমিও আশা করিনি। এতো আশা করে কি হবে, এই তো আমি, আশা ছাড়াই বেচে আছি এতোটা বছর।

আদনানঃ কিরণ! তুমি!আদনানের চোখে পানি।
আমিঃ কেনো? খুশি হওনি?
আদনানঃ আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না কিরণ যে আমি কতোটা….
আমিঃ থাক, নাটক করতে হবে না।আমি জানি তুমি খুশি হওনি। হবেইবা কি করে, যে কালো ছায়াটা তুমি ১০ বছর আগে পিছে ফেলে এসেছ, সেটাই হঠাৎ এই অসময়ে তোমার সামনে এসে পরেছে।

আদনানঃ কিরণ, তুমি এসব কি বলছ?
আমিঃ বুঝতে পারছো না? নাকি বুঝতে চাইছো না? তোমার একটা ভুল আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে।আমি আমার একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছি । আর তুমি, তুমি তো আবারো বিয়ে করে সন্তান নিয়ে সুখেই আছো।

আদনানঃ কিরণ, তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। মেঘ তোমারি..

আমিঃ না আদনান, তুমি কি করে ভাবলে, সতীনের ছেলেকে আমি নিজের সন্তানের যায়গা দেবো?

আদনানঃ কিরণ, মেঘ তোমার সতিনের ছেলে নয়।
আমি অবাক হয়ে আদনানের দিকে তাকালাম।
আদনানঃ মেঘ আমাদের সন্তান। মেঘই তোমার বাবু। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করিনি কিরণ।

কথাটা শুনে এক মুহুর্তের জন্য আমি থমকে গেলাম। মেঘ আমার সন্তান!

আমিঃ কিন্তু এক্সিডেন্ট….
আদনানঃ ওইদিন তুমি যখন আমাকে ফোন দিচ্ছিলে, আমি তখন অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম। ওটি থেকে বের
হওয়ার পর যখন তোমার এত্তোগুলো মিসকল দেখলাম, আমি কলব্যাক করলাম, কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ ছিলো।
বাড়ির পথে রওনা দিলাম, পথিমধ্যে তোমার ছোটভাই উজ্জ্বলের ফোন পেলাম, জানতে পারলাম তোমাদের এক্সিডেন্ট এর খবর। হাসপাতালে ছুটে গেলাম। বাবু আর তোমার, কারো অবস্থাই বেশী ভালো ছিলো না। সেই এক একটা মুহুর্ত আমার কিভাবে কেটেছে আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। ভাগ্যক্রমে বাবু সুস্থ হয়ে উঠলো, কিন্তু তুমি কোমায় চলে গেলে। তোমার বাবা তোমার এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ন ভাবে আমাকে  দায়ী করলো। আমাকে বাধ্য করলো তোমার জীবন থেকে চলে যেতে।
বাবুকে নিয়ে আমি শহর ছাড়লাম। কিন্তু সবসময়ই তোমার খোজ নিতাম, এভাবে কেটে গেলো বছরের পর বছর। এরই মধ্যে একদিন আমার বন্ধু আদিল জানালো তুমি কোমায় থেকে ফিরে এসেছো। তোমার সাথে দেখা করার জন্য মেঘ কে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে গেলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম,একদিন আগেই তোমরা শহর ছেড়ে চলে গেছো। অনেক চেষ্টা করেও তোমাদের কোনো খোজ পাইনি। আমাকে ক্ষমা করো কিরণ। আমার ব্যার্থতার জন্য আমাকে ক্ষমা
করো। আদনান মাটিতে বসে পরলো। ওর বাধ ভাংা অশ্রু দেখে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। বড্ড
ভালোবাসি ওকে। ওর নীল চোখ দুটো আমার প্রতি ওর ভালো বাসার প্রমান দিচ্ছে। আমি আদনানকে জরিয়ে ধরলাম। নিঃশব্দ কান্নায় আরেকবার ভালোবাসার প্রকাশ ঘটল। হারিয়ে  যাওয়া সব কিছু আবার নতুন করে ফিরে পেলাম। শুরু হলো নতুন জীবন, নতুন আশায় মেঘকে নিয়ে আদনান আর আমার পথচলা।
.
আর তার পর? থাক আর নাইবা বললাম,
গল্পটা এখানেই শেষ।

★লেখক সাহেব★

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া