বাড়ি থেকে স্কুল ছিলো মাত্র ৫ মিনিটের হাটা পথ। সেটা আমার জন্য। যারা জোরে হাটেন তাদের বড়জোর দু মিনিট লাগবে। ব্যাগ নিয়ে,জুতো মোজা পড়ে স্কুলে যাওয়ার পথে সবাই হাসা-হাসি করত। আমি কখনো কাউকে জিজ্ঞেস করিনি কেনো। একদা একদিন বুঝিতে পারিলাম!
সবাই খোলা পায়ে বা স্যান্ডেল পায়ে হাটে আর সবাই হাতের ভাজে অথবা মাথার উপর বই এর বোঝা বহন করে আর আমি একমাত্র জীব যে কিনা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে গমন করি। আমি ব্যাপারটা বুঝেই লজ্জায় পরে গেলাম। আস্তে আস্তে আমার রুপান্তর ঘটতে লাগলো ।
কিছু বন্ধুও জুটে গেলো। আমিও ধীরে ধীরে পদ-যুগল স্যান্ডেলের সহিত অভ্যাস্ত করে ফেললাম। আরো দু বছর যেতে না যেতেই আমি হাতের চাপে বই আর স্যান্ডেল পায়ে পাহাড়ি আর গ্রামের তাবদ ছাত্র-ছাত্রীর মত স্কুলে যেতে লাগলাম। বেশ ভালই লাগছিলো। তখনো স্কুলের বানান আমরা মাঝে মাঝেই ইশকুল লিখতাম বা ইশকুল বলতাম, আমি ভাবতাম ইশকুল বা স্কুল দুটোই লিখা যায় ।
একদিন শুনলাম ইশকুল এখন থেকে স্কুল রুপে লিখা হবে।
(স্কুল ইশকুল হবে নাকি ইশকুল -স্কুল হয়ে যাবে এটা নিয়ে আমি এই লেখা শুরুর আগেই দোটানায় ছিলাম। আরমান ভাইকে জিজ্ঞেস করইতে গেলাম-
“ভাই ,একটা কথা”
“বলে ফেলেন”
“আমাদের সময় ইশকুল বানান স্কুল হইসিলো , নাকি স্কুল বানান ইশকুল হইসিলো?”
“আরে শুনেন,ইশকুল তো লিখিত রুপ না…”
আমি পুরো না শুনে বল্লাম”ও, মানে আগে ইশকুল ছিলো পরে…”
“আরে না ,আগে ইশকুল ছিলোনা…”
“ও আমরা ভুলে…”
“আরে ধূর…” আরমান ভাই আমাকে আর বুঝাতে চাইলেন না। হতাশ হয়ে না বুঝানোর সীদ্ধান্ত নিলেন। আমি চাউনিতে বুঝিয়ে দিলাম এবার আর মাঝ পথে বাগড়া দিবোনা।
আরমান ভাই বলতে লাগলেন”আগে ইশকুল,ইশটিশন এসব বলত, সেটা লিখিত ছিলোনা, লিখিত হচ্ছে স্কুল”
“ও আচ্ছা” আমি বুঝে নিয়ে মানে মানে কেটে পড়লাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দুমিনিটের মাথায় লিখতে বভস্তে গিয়েই আবার মাথায় ঘুরছে “ইশকুল আগে না স্কুল আগে!”
যাক! এখন লিখে ফেলেছি,আর ভয় নেই। ইশকুল থেকে স্কুল ই সই। )
সেদিনি স্কুলে গিয়ে একটা মারামারি বাধিয়ে দিলাম। দিব্বি গ্রামের স্কুলে মিশে আছি, এমন সময় সেখানেও আমার পাঠ চুকলো। পঞ্চম শ্রেনীর বৃত্তি পরীক্ষা তখন সামনে। এমন সময় আপু ইস্পাহানীতে টিকায় আমরাও আবার চট্টগ্রাম শহরে স্থান্তরিত হলাম। আমি শহর থেকে এসে ফাইভের পরীক্ষা আর বৃত্তি দিয়ে যাবো ঠিক হলো।
শহরে এসে আবার শহরের হাওয়া গায়ে লাগলো! মাঝ-খান থেকে আমি না শহরকে আপন করে নিলাম না গ্রাম কে। বা উভয়কে!
সবাই বৃত্তি নিয়ে মহা-ভয়ঙ্কর ভাবে উঠে পড়ে লেগেছে। আর আমি তখন তিগোর নেশায় মজেছি। বৃত্তি আমার কাছে তেমন মূল্যবান ছিলোনা। শহর থেকে গিয়ে গ্রামের সেন্টারে বৃত্তিও দেওয়া হলো, সে বৃত্তির ডগার দেখাও আমি পাইনি। আমি তাকে মূল্য দিনি সে আমায় দিবে কেনো!
এরপর চলে এলাম শহরের প্রান্তরে। আবার যুদ্ধ। ভর্তী যুদ্ধ। আমার উপর মোটামুটি ১৪৪ ধারা জারি হলো, কোথাও না টিকলে টিনের স্কুলে পড়াবে। সেটাতেও আমার তেমন সমস্যা ছিলোনা। সমস্যা হলো যখন আম্মু হুমকি দিলো”নাসিরাবাদে না টিকলে ,মেরে ফেলবে”। আগে যদি বুঝতাম সেটা নেহায়েত হুমকি ছিলো তবে ভর্তীর জন্য এত পড়তাম না। উঠেপরে পড়তে লাগলাম। আমার চেয়ে বেশি জোর দিলো আমার আপু। পরীক্ষা দিয়ে এলাম এক সন্ধিক্ষণে !
এর মধ্যেই শহরের বাসার সামনে বন্ধু জুটিয়েছি বেশ। চলছে খেলা। ভদ্র ছেলেদের কম্পিউটার আর ঘুরাঘুরি বাদ দিয়ে আমার সাথে ক্রিকেটের নেশায় মজালাম, আর আমি আরো বেশি মজে গেলাম। এখনো সেই ফখরুলের কথা আমার মনে আছে।
ভর্তীর ঘোষনার দিন চলে এলো। ফল-আনতে ঝুড়ি ছাড়াই গেলাম। সামনে আব্বু পেছনে আমি ,সাথে আপু। কোন-মতে আল্লাহ আল্লাহ করে যাচ্ছিলাম। মাঝে আব্বু বলে উঠলো” টিকলে এই পথে নাহলে…।” নাহলের পর তিনি আর কিছু না বল্লেও খারাপ ইঙ্গিত টা আমি ঠিকি ধরতে পারি, আর আমার পেটের ভেতরটা অজানা আতংকে কেমন যেন করে উঠে। বুক খালি খালি লাগে। …..(চলবে)
———–জুনাইদ বিন কায়েস