আমার জন্ম তারিখ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। আমার জন্ম পরিচয় সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। আমার জন্মস্থান কোথায় আমি জানিনা। শুধু জানি এই বিশাল পৃথিবীতে আমি একজন আটকে পরা মানুষ। আমি পৃথিবীর কাছে ঋণী নই, পৃথিবী আমার কাছে নয়।
আমি খেটে খাওয়া মানুষের দলে। সর্বশেষ কোন স্মৃতি যদি আমার মনে থেকে থাকে সেটা ক্ষুদার জ্বালায় চুরি করে খাবার খেতে গিয়ে গনপিটুনির । তখন বয়স হয়ত আট, আরো কম বা বেশি। সেই ছোট বেলা থেকে বাস্তব পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে করতে এতটুক আসা।
কেউ যখন নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করে আমি বলতে পারিনা। নিজের নাম নিজে রেখেছি ,সে নামের আমার কাছে কোন মূল্যই নেই। ক্ষুদা জ্বালা নিবারনে একটা চা এর দোকানে চাকরি করতাম । সারা দিন্-রাত খেটে পাওনা ছিলো দুপুর আর রাতের খাবার। সেটাই আমার জন্য পরম পাওনা ছিলো। যে জীবনে পরিজন নেই, পরিচয় নেই সে জীবনে এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে। তাও কপাল পুড়লো এক বিকেলে।
সবে দুপুরের কাজ সেরে গোসল করে শুয়েছিলাম। চোখে স্বপ্ন ছিলোনা, একরাশ ঘুম ছিলো শুধু। কিন্তু ঘুমানোর সময় ছিলোনা। শুয়েই উঠে পড়ার চিন্তা করছিলাম। তখন দোকানের মেনাজের আমায় ডাকলো। আমি গেলাম। মেনেজার আমার দিকে কুতকুতে চোখে তাকিয়ে ছিলো। সে চোখে সন্দেহ আর আগুন ছিলো। ক্যাশে ২০০০ টাকা কম ছিলো আমাকে মেনেজার জানালো। আমি শুনলাম, আমাকে জিজ্ঞেস করলো, গতকাল সে যখন বেড়িয়েছিলো, আমি একা ছিলাম, তখন কেউ এসেছিলো কিনা। আমি বললাম ,” না ,কেউ আসেনি”। হায়, ধড়িবাজ মানুষের চাল তখনো আমার শেখার অনেক বাকি।
আমি একা ছিলাম, সুতরাং টাকা আমি সরিয়েছি, এই যুক্তি মেনেজার মালিককে বলল। আমার পেটের ভাত যোগানোর আশা কেড়ে নিলো, মেনেজারের ক্ষনিকের লোভ!
টানা এক সপ্তাহ আধবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছিলাম। এর পর একটা রিকশার গ্যারেজের লোকের সাথে পরিচয় হলো। লোকটা আমার দুরবস্থা দেখতে পেয়ে আমাকে রিকশা চালাবার ব্যবস্থা করে দিলো। একবেলা রিকশা চালিয়ে যা আয় হবে তাঁর থেকে ৫০ টাকা গ্যারেজে দিতে হবে । পেটেরর দায়ে তখন যে কোন কাজ করতে রাজি ছিলাম।
প্রতিদিন রিকশা চালাতে বের হতাম, ২০০/৩০০ টাকা আয় হত, ৫০ টাকা গ্যারেজে দিতাম। এভাবেই বেশ চলছিলো। একদিন প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে রিকশা চালাতে গিয়ে বিফল হলাম। ফলাফল শূন্য। মালিক পক্ষ এসব শুনতে রাজি ছিলোনা, বের যখন হয়েছি তখন টাকা দিতেই হবে। জ্বরের ঘোরে তখন বাস্তবতার নির্মমতা বোঝার সময় ছিলোনা! পরিচিত লোকটা আমার জমানো ৩৫০ টাকা থেকে ৫০ টাকা নিয়ে গেলো।
জ্বরের ঘোরে তিনদিন রিকশা চালাতে পারিনাই। জ্বর সারার পর জানতে পারলাম রিকশার দায়িত্ব টাও হারিয়েছি।
খরচের পর থাকা বাকি ১০০ টাকা নিয়ে পথে নামলাম । সেই টাকায় বাজার থেকে কমদামি চকলেট আর আচার কিনে পথে পথে বিক্রি শুরু করি। দশ বছর পর ১০০ টাকার যাত্রা এখন ২০/৩০ হাজারে ঠেকেছে। বাস স্ট্যান্ড এর এক সাইডে একটা জায়গা ভাড়া নিয়ে খাবারের জিনিশ আর বাচ্চাদের বই বিক্রি করি। আল্লায় চালিয়ে নিচ্ছে ভালোই। এক জায়গা থেকে উঠাই দিলে আরেক জায়গায় গিয়ে বসি, সে বসার জন্যেও আবার দৈনিক বা মাসিক ভাড়া দেওয়া লাগে।
নিজের নাম এর ঠিক নাই। যে কোন নামেই ডাকতে পারেন , পরিচয় জানিনা। মা-বাবার নাম জানিনা। হয়ত এভাবে বড় না হলে, নিজের পরিচয় নিয়ে বেড়ে উঠতে পারলে, মা-বাবার সাথে থাকলে জীবনের গল্পটা অন্যরকম হতেও পারতো
——————————– করিম ( নিজের দেওয়া নাম)
*******************
চট্টগ্রাম বাস স্টেশনে তাঁর গল্পটা শুনে মনে মনে ভাবলাম আসলেই মা-বাবার সাথে আছি, একটা পরিচয় আছে ,মা-বাবার ছায়ায় আছি, এটা অনেক বড় পাওয়া। ভাবতে ভাবতে আমি আমার বাসার পথ ধরলাম।
 
							
