বিলাতে কয়েকদিন

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

আমাদের আবাস ছিল রয়েল হলওয়ে ইউনিভার্সিটিতে। লন্ডনের শহরতলিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে অনেকেই লন্ডনের সবচেয়ে সুন্দর ক্যাম্পাস মনে করেন। সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে উনিশ কিলোমিটার দূরের এই বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করেন রাণী ভিক্টোরিয়া ১৮৩৬ সালে তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তির পঞ্চাশতম বার্ষিকিতে। সে সময় যে ভবনটি তৈরি করা হয় তাকে ঘিরেই পরবর্তিতে বেড়ে উঠে ১৪০ একর জায়গার উপর বিশাল ক্যাম্পাস। ফ্র্যাঞ্চ স্যাঁতোর আদলে তৈরি লাল ইটের বিশাল ভবনটিকে এখন বলা হয় “ফাউন্ডার্স বিল্ডিং” সম্ভবত প্রতিষ্ঠাতাদের তৈরি বলেই এ ধরণের নামকরণ। উত্তর দক্ষিণে দুটি টাওয়ার সহ এই বিশাল স্থাপনার মধ্যে রয়েছে অফিসরুম, লেকচার হল, ডাইনিং হল, ছাত্র – ছাত্রীদের থাকার জায়গা এমনকি ভিক্টোরিয়ান আর্কিটেকচারে গড়া বড়সড় চ্যাপেল। আমাদের সৌভাগ্য আয়োজকরা আমাদের থাকার ব্যাবস্থা এই ভবনেই করেছেন। আমাদের শতবর্ষের ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত করেছেন।

আয়তকার ভবনের মাঝখানে খোলা ঘাসের লন তাতে রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি। তার নিচে লেখা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কিছু তথ্য। ভবনটি এতই বড় যে এর যে কোন প্রান্ত থেকে হাঁটা শুরু করে আবার সে জায়গায় ফিরে আসতে মিনিট পনের সময় লেগে যায়। আমাদের রুম বরাদ্দ ছিল তৃতীয় তলার পশ্চিম অংশে। হিথরো থেকে আশার পথে বাসেই আমাদের রুমের ডিজিটাল চাবি হাতে তুলে দিয়ে নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দিয়েছিল গাইড, সারা। এই ডিজিটালি কোডেড কার্ডখানা আমাদের গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে সারাক্ষণ। এটি গলায় থাকলে নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের কোন প্রশ্ন করবে না। ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে পারব ক্যাম্পাসের সর্বত্র, এমনকি ডাইনিং হলে খেতে গেলেও গলায় ঝুলানো থাকতে হবে কার্ডখানা। তাছাড়া লন্ডনের গলি ঘুপছিতে যদি আপনি কখনো হারিয়েও যান, পুলিশকে কার্ডখানা দেখালে ফিরে আসতে পারবেন ক্যাম্পাসে। তবে সবচেয়ে ঝক্কির ব্যাপার ছিল আপনি যদি রুমের ভেতর কার্ডখানা রেখে ওয়াশরুমেও যান তবে আপনি আর রুমেই ঢুকতে পারবেন না। বিকল্প কার্ড পাওয়া বেশ জটিল।

রুমে ঢোকার কিছু পরেই ডিনারের ডাক পরল। এখানে এখন সময় সন্ধা ছয়টা। আকাশে এখনো গনগনে রোদ। রাত নামতে দশটা বেজে যাবে। যা হোক ডিনারের জন্য যাত্রা করলাম। আমাদের খাওয়া দাওয়া যে বিল্ডিংয়ে হবে তার নাম “দি হাব” । ফাউন্ডার্স বিল্ডিং থেকে সেখানে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে মিনিট দশেক লেগে যায়। খেয়ে ফেরার পথে উঠতে হয় পাহাড়ের গা বেয়ে। ব্যাপারটা এমন যে খেয়ে ফিরে আসতে আসতে আবার ক্ষিদা লেগে যায়। তাছাড়া ইংলিশ ডিনারের বিস্বাদ খাওয়া আমাদের রোচে না। তাই সন্ধার এই ইংলিশ ডিনারকে আমরা বিকালের নাস্তা হিসেবে ধরে নিলাম। কিছু ফল, কেক আর চা’তো খাওয়া যায়। রাত দশটার দিকে আসত আমাদের জিভে জল আনা বাঙালী ডিনার। সিলেটের লোক বশির ভাই তার গাড়ীতে করে নিয়ে আসতেন কখনো চিকেন বিরিয়ানী, কখনো মাটন, কখনো বা কাবাব আর নান।

ডিনারের পর ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসলে এর আকার এত বড় যে এক সন্ধায় এর কিয়দংশই দেখা সম্ভব। উঁচু নিচু টিলার গায়ে, নিপুণ দক্ষতায় ভবনগুলো ডিজাইন করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইশটি ডিপার্টমেন্টের প্রতিটিই আলাদা আলাদা ভবনে। তাছাড়া আছে বেশকিছু আবাসিক ভবন, স্পের্টস সেন্টার, লাইব্রেরি, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, ব্যান্ক, বেশ কয়েকটি ক্যাফে, নাটকের জন্য থিয়েটার হল, অডিটোরিয়াম প্রভৃতি। প্রতিটি ভবনের নামকরণ করা হয়েছে কলেজের সাবেক অধ্যক্ষদের নামে। আমাদের দেশে হলে নেতা নেত্রীদের নামেই করতে হত। ভবনগুলির অবস্থান বেশ দুরে দূরে এবং মাঝখানে গাছপালায় ঘেরা হাঁটা পথ। অবশ্য ঘুর পথে প্রতিটি ভবনেই গাড়ী নিয়ে যাওয়া যায়। ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে মনে হয় কোন জঙ্গলে না এসে পড়লাম। রয়েল হলওয়ের ক্যাম্পাসে রয়েছে দূ’শোরও বেশী প্রজাতির গাছ। পরিবেশ যত্নে পুরস্কৃতও হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

হাঁটতে হাঁটতে কাঁচঘেরা আধুনিক একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে পৌছুলাম। জানতে পারলাম এটা লাইব্রেরী ভবন। চারতলা এই লাইব্রেরী ভবন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও বড়। পাঁচ লক্ষেরও বেশি বইয়ে ঠাশা এই বিশাল লাইব্রেরী ভবেনের পড়ার জায়গা গুলো ভিন্ন ভিন্ন দিকে ছড়ানো। আপনি যদি একা একা পড়তে চান আপনি যাবেন এক দিকে। গ্রুপ স্টাডির জন্য অন্যদিকে। আরেকপাশে একখানা বই হাতে নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে খোলা প্রান্তরের দিকে মূখ করে বসতে পারেন। পড়তে পড়তে টায়ার্ড লাগলে, সবুজের দিকে তাকিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলেন না হয়।

লাইব্রেরীর সামনে খোলা চত্বরে বসে পরলাম। চত্তরটি পাকা আর চারধারে কংক্রিটের ব্যাঞ্চ। একপাশ গ্যালারীর মত। বোঝাই যায় ওপেন এয়ার প্রোগ্রামের জন্য ডিজাইন করা। চত্বরে বসে আকাশের দিকে তাকাতেই ভিন্ন এক দৃশ্য। আকাশ ভর্তি প্লেন। যেন অস্ংখ্য ঘুড়ি উড়ছে। আসলে রয়েল হলওয়ে ক্যাম্পাস হিথরো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আর হিথরো পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর। এখানে প্রতি দেড় মিনিটে একটি বিমান ওঠে বা নামে। এগুলোর ছোটাছোটি দেখে রীতিমত ভয় লেগে উঠল। কখননা একটা আরেকটাকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু না, অসাধারণ দক্ষতায় উড়ছে নানা দেশের নানা সংস্থার বিমানগুলো। ওরাতো আর আমাদের দেশের বাস ট্রাকের ড্রাইভার না যে ধাক্কা লাগিয়ে, মানুষ মেরে বাহবা পাবে।

অন্ধকার নামতে ফিরে এলাম ফাউন্ডার্স বিল্ডিঙে নিজের রুমে। হাতমুখ ধুয়ে শুতে যাব। এ ফ্লোরে আটচল্লিশটি রুমে আটচল্লিশজনের থাকার ব্যাবস্থা কিন্তু প্রক্ষালন কক্ষ মাত্র ছয়টি। দেড়শ বছরের পুরোন ভবনের অভ্যন্তরটা আধুনিকায়ন হয়েছে। রুমের দরজায় লেগেছে ডিজিটাল তালাচাবি, করিডোরে প্রবেশ পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড। ক্যামেরা থেকে, ফায়ার এলার্ম সবই আধুনিক, শুধু পবিত্র হওয়ার জায়গাটুকু সেকেলে। ইংরেজ জাতীর সভ্যতার সঙ্কট বুঝতে তাদের হেঁসেল আর প্রক্ষালন কক্ষ যথেষ্ঠ। এ দূঃখেই হয়ত রেগে চিতকার করেছিলেন বার্নার্ড শ, বিটলস গান গেয়ে ভেঙে দিতে চেয়েছে অর্থহীন আভিজাত্যকে।

ঐতিহাসিক ভবনের ঐতিহাসিক কক্ষে রাতে ঘুম আসছিল না। প্রচন্ড গরম। ভাগ্য ভাল বিপরীত দিকের রুমগুলোও আমাদের দলের। মুখোমুখি রুমগুলোর দরজা খোলা রেখে, অপর পাশের জানালাগুলো থুলে এয়ার সার্কুলেশনের পথ করে কোনভাবে রুমগুলোকে বাসযোগ্য করে তুলি। আসলে কয়েকবছর আগেও বৃটিশ সামার ছিল আমাদের শীতকালের মত। তাই এখানকার বাড়ীগুলোকে গরম আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত করে তৈরি করা হয় নি। কিন্তু গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর চাপে ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এই দেশ।

কথন ঘুমিয়ে পরি খেয়াল করিনি। হঠাত প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাঙে। করিডোরে বেরিয়ে আসতে দেখি এক ইংরেজ তরুনী চিতকার করে বলছে বেরিয়ে যেতে, ফায়ার এলার্ম বাজছে। অবশ্য অল্প কিছু্ক্ষণের মধ্যেই সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়। আসলে ওয়েল্ডিং মেশিনের স্পার্ক এর কারণে বেজে ওঠে এলার্ম। রুমে ফিরে আসতে অনুভব করলাম প্রকৃতি কিছুটা ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। বিছানায় পরতেই ঘুম।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া