শ্রদ্ধেয় আব্দুল কাইয়্যুম নিজামী স্যার

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এই কথাটার মর্মার্থ কেনা বোঝে? আর এ শিক্ষা যাদের হাত ধরে চলে তাদের জন্য আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। ভার্সিটি লাইফে শিক্ষক শিক্ষিকা আমাদের অনেকটাই নিজের সন্তানের মতই আগলে রেখেছেন। হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে  যেসব শিক্ষক শিক্ষিকাকে আপন করে পেয়েছি  তাঁরা হলেনঃ কাইয়্যুম নিজামী স্যার,হাসিনা মমতাজ ম্যাম,মুনতাসির মোরশে্‌দ স্যার,    হেলাল উদ্দিন স্যার   আয়েশা তাবাস্সুম  মেডাম। পরবর্তিতে আমাদের ডিপার্ট্মেন্টের হেড হয়ে আসা  ফাতেমা সিদ্দিকা মেডামের কথাও মনে আছে বেশ। সবাইকে নিয়ে আমার নিজের মনের কথাগুলো সকলের সাথে ভাগ করে নিতে চাইছি । আজকের লেখাটা শুরু করছি কাইয়্যুম নিজামী স্যার কে নিয়ে। 

 

একজন আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বোঝায় তিনি আমার কাছে তাই। একজন শিক্ষককে ছাত্র-ছাত্রীরা কতটা আপন করে নিতে পারে আর তিনি তাঁর পিতৃছায়ায় সকল ছাত্র-ছাত্রিকে কতটা আপন করে নিতে পারেন তা বুঝতে হলে আসলে আপনাকে তা মন থেকে অনূভব করতে হবে। 

 

যেদিন স্যারের প্রথম ক্লাস করছিলাম সেদিনের কথা বলি। তিনি আসতেই সবাই উঠে দড়ালাম। কেন জানি ভয় লাগছিলো খুব। ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের মাথা তিনি । ভাবছি মাথা কতটাই না গরম হতে পারে তাঁর! তিনি তিনি যখন কথা বলতে লাগলেন এবং কথার তালে তালে হাত দুলতে লাগলো  তখন এক চমৎকার হলো। সব ভয় পাহাড়ের গায়ে যেন আছড়ে পড়ে দুমড়ে মুচরে  গেলো! তাঁর কথায় জাদু ছিলো , মোহ ছিলো। তাঁর কথার মায়ায় পড়ে মনে হত আজকে থেকে আমি বদলে যাবো! 

 

শ্রদ্ধেয় কাইয়্যুম নিজামী স্যারের কথা বলতে গেলেই দুটো কথা আগে মনে আসে। এক স্যারের সদা হাস্যরত মুখের সাথে সহজাত অংভঙ্গিতে ক্লাস নেওয়া , দুই! স্যারের অক্সফোর্ড ডিকশনারী। 

 

স্যার ছিলেন চলমান ,ভ্রতাম্যমান ডিকশনারী। একটা  শব্দের অর্থ বের করতে বললে আমরা যখন পারতাম না, স্যার যেন সহজাত প্রবৃত্তিতে শব্দটার সিনোনিম,এন্টোনিম এর সারি  ধরে বলে বলে একেবারে অঙ্গবিচ্ছেদ করে ছাড়তেন।  আমরা ভাবতাম এও কি সম্ভব! 

স্যারের বাসা ছিলো কলেজের কাছেই। কলেজের গেটে ।স্যার প্রায়সময় আসার সময় সাথে করে একগাদা বই নিয়ে আসতেন।  সকল তরকারির কমন ইনগ্রিডিয়েন্টস  এর মত তাতে  অক্সফোর্ড ডিকশনারী থাকতোই।যদিওবা কখনো সেটা ভুলে ফেলে আসতেন ছাত্রদের মধ্য থেকে আমাদের কারো দায়িত্ব পড়ত সেটা নিয়ে আসার। আসলে, স্যারের আশাপাশে থাকতে থাকতে আমার নিজেরি অক্সফোর্ড ডিকশনারীর প্রতি একটা মায়া জন্মে যাচ্ছিলো! 

পড়া না বুঝলে বা কিছু বুঝিয়ে নিতে হলে আমরা নিশ্চিন্তে স্যারের কাছে চলে যেতাম সে অফিস হোক বা বাসায়। স্যার ও W.B Yeats, Homer, যাবতিয় সাহিত্য থেকে একের পর এক লাইন বলে যেতেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের  মতই শুনতাম। 

 

 

স্যার যখন“I want to drink life to the lees” এর ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন তখন মনে হচ্ছিলো জীবনের শেষ আনন্দের বিন্দুটুকু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। এটা বোঝাতে গিয়ে স্যার যখন চা বা পানির কাপের লাস্ট ড্রপের কথা বলতেন হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তখন মনে হত শূন্যে কাপটা উপস্থিত। স্যারের সন্তানদের সাথেও পরিচয় ছিলো আমারদের অনেকেরি। যে এ এক-পরিবার!হঠাৎ একদিন কলেজের অনুষ্ঠানে বুঝলাম স্যার গাইতেও পারেন বেশ! 

 

 

আর স্যার ক্লাসে আসলেই একটা  জিনিস নিয়ে আতঙ্ক কাজ করত। ধুম করে একটা শব্দার্থ বা একটা লিটারেরি লাইনের অর্থ জিজ্ঞেস করে বসতেন । কেউ পারলে ভালো, না পারলে তিনি কিছুক্ষন হতাশা ব্যাক্ত করে সাহিত্য জগতে বিচরন শুরু করে দিতেন আমাদের সাথে নিয়ে। 

আমার নিজের কাছে যেটা সবচেয়ে মজার লাগতোঃ স্যার বোঝানো শুরু করতেন হয়তবা ইলিয়াডস থেকে ,সেখান থেকে চলে যেতেন  কোন লিটারেরি টার্মে   সেখান থেকে হুট করে  শেলী বা ইয়েটস  এ চলে যেতেন, আবার হাজার পথ ঘুরিয়ে এনে সেই ইলিয়াডস এই নিয়ে আসতেন আমাদের।  মাঝে মাঝে বুঝতেই পারতাম না বিষয় পরিবর্তন হচ্ছে। পুরোটা একপাক ঘুরে আসার পর বুঝতাম আজ ইলিয়াডস এর পাশাপাশি শেলী, ইয়েটস বা ব্লেক ও বাদ যায়নি। স্যারের বোঝানোর মধ্যে এমন কিছু ছিলো যা সচরাচর দেখা যায়না। 

একটা বিষয় বোঝাতে গিয়ে অনেক কিছুই বোঝাতেন  । তাঁর ক্লাস শুধু মাত্র কিছু নয় অনেক কিছুর জন্য ছিলো। আর যেটা তিনি বোঝাতেন সেটা ডালপালা সহকারেই বোঝাতেন।  প্রায় সময় তিনি ক্লাসে আসলে ৪৫ মিনিটের ক্লাস ঘন্টা দুয়েক নিশ্চিন্তে চলত। স্যার ক্লাসে ঢুকলে আমরা নড়ে চড়ে বসতাম, কেননা আজ ঘন্টা যদিও বা পরে স্যার নড়বেন না। আর স্যার যতক্ষন পড়াবেন  ততক্ষন ক্লাস চলবে। এ এক অন্যধরনের ক্লাসের সংজ্ঞা ,যার কোন শিডিউল নেই, যেখানে নিদ্দৃষ্ট সাব্জেক্ট নিয়েই পড়ে  থাকা হয়না, যে ক্লাসের শুরু থাকে শেষ থাকেনা…

 

স্যার কে ভালোবাসতাম ,ভয় পেতাম তাঁর চেয়ে বেশি করতাম সম্মান। একবার ক্লাস ফাকি দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম সবাই,,  ধরা খেয়ে গেলাম স্যারের কাছে।  সিড়ির কাছেই! স্যার ডাক দিলেন, এবং যারা উপরে ছিলাম এবং যারা কিছুটা পলায়নে সক্ষম হয়েছিলো সবাই সুর সুরিয়ে ক্লাসে ঢুকলাম। আবার ধরুন সবাই কলেজের বারান্দায় হেলেদুলে হাটছি, কেউ একজন বলল “কাইয়্যুম স্যার আসছেন” অমনি কেউ বাতাসে মিলিয়ে যায় আর কেউ জায়গায় সটান দাঁড়িয়ে নিজের কলার, চুল,দাড়ি ঠিক করতে লেগে যায়!

 

স্যার প্রায় বলতেন” কলেজটা আমাদের না(শিক্ষকদের)  তোমাদের, আমরা আসব যাবো, তোমরা সারাজীবন বলবে এটা আমদের কলেজ। আর আমরা যে কলেজে যাবো সে কলেজের”।  

 কলেজের বড়  ভাইদের কাছ থেকে স্যারদের সম্পর্কে অনেক কথাই জেনেছি। স্যার ছিলেন বই পোকা। বই এর মাঝে এমন ভাবে ডুবে থাকতে খুব কম মানুষকেই দেখা যায়। আর স্যার কে দেখলে বোঝা যায়  শিক্ষার কোন বয়স নাই। স্যারকে যখনি দেখতাম তিনি আমাদেরি পাঠ্য বই পড়ে যাচ্ছেন, নিজেরো বই আছে সেগুলো ও পড়ে যাচ্ছেন। তাঁর অধ্যয়নেরর কমতি নেই কখনই! এমনকি বড়ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম কলেজের ডিপার্ট্মেন্টের প্রধানের রুমটা যে আলাদা সেখানে স্যারের অবদান কম নয়। আর সেখানে তিনি একাগ্র চিত্তে অধ্যয়নের কাজ করে যেতেন! এমনকি অনেক সময় দেখা গিয়েছিলো স্যার রাত অবধি রুমে বসে অধ্যন করছেন! আসলেই তাঁর জন্য শিডিউলের কি দরকার! একটা জিনিস সব কিছুর মধ্যেই দেখতাম তাকে টাইম ধরে করতে, সেটা হচ্ছে নামাজ, সেটায় ছাড় দিতেন না তিনি। কলেজের পোগ্রামে ছেলেমেয়েরা কাজের শেষে কিছু খাচ্ছে কিনা সেদিকটাও নীরবে নজর রাখতেন এবং অবদানও ।

 

একদিন স্যার চলে গেলেন সিলেটের বৃন্দাবন কলেজে। বিদায় অনুষ্ঠান হলো। কিন্তু আসলে এমন একজন স্যারকে বিদায় দেওয়া যায়না। স্যারের বর্তমান ঠিকানা আমাদের মহসিনে  না হলেও আমাদের মনে তাঁর ঠিকানা চির-বর্তমান। তাকে বিদায় বলার সময় মনে হচ্ছিলো এটা ঠিক বিদায়ের মত লাগছেনা।স্যারের কথায় ভরসা পেলাম তিনি আমাদের সাথেই আছেন, দেখা হবে মাঝে মাঝে। 

 

তাঁর জন্য আমাদের শুভকামনার মধ্যে এই কামনাও অবশ্যই থাকবে যেন বৃন্দাবন কলেজ, কুমিল্লা কলেজ শেষে আবার যেন  মোহসিন কলেজের ইংরেজি বিভাগ তাকে  পায় আবার নিজের করে।  স্যারের সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়নি বরং আরো বেড়েছে।  অনেকেই এখনো স্যারকে মেসেজ বা কল করে নিত্য কথা বলি। স্যার দূরে আছেন তবে তাঁর শিক্ষার আদর্শ এখনো আমরা বুকে লালন করি । 

চিন্তা করছি একবার হঠাৎ স্যারের সাথে দেখা করবো। অনেকদিন হাসিখুশি মানুষটার সাথে দেখা হয়না। হয়ত দেখা হলেই তিনি ইয়েটস থেকেই শুরু করবেন………

আর চলে আসার সময় স্যারকে বলবো, স্যার জানেন? আমি যেখানেই যাই সাথে অক্সফোর্ড ডিকশনারী সাথে নিয়ে যাই, সাথে থাকলে মনে হয় আপনি আশেপাশেই আছেন……আর কেউ   শিক্ষকদের কথা বা  অক্সফোর্ড ডিকশনারীর কথা বলতেই তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গর্বভরে বলি, আমার একজন স্যার আছেন্‌, তাঁর সাথে সবসময় অক্সফোর্ড থাকতোই ক্লাসে……তার পর তাকে পুরো গল্পটা বলে ফেলি”

স্যার সালাম জানবেন।  শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা নিবেন। আপনাকে অনেক মিস করি। 

—জুনাইদ বিন কায়েস

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া