মোতালেব ভাই

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

আমি তখন অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র।  অনার্স পড়ুয়া বাকি সব ছাত্রদের মতই উন্মুক্ত বক্ষে আমার বিশাল বিশাল সব আশা। দিন যায়, বেলা গড়ায় হাজি মোহয়াম্মদ মহসীন কলেজে আমার এবং বন্ধুদের পদচারনা চলতে থাকে।

 

বাকি সব দিনের মতই সেদিন বাসা থেকে তড়িঘড়ি করে বের হয়েছিলাম। আমার সবকিছুতেই একটা তড়িঘড়ি স্বভাব । কথায় আছে কয়লা ধুইলে ময়লা যায়না। ঠিক তেমনি যতই বুঝাবেন না কেনো আমি অস্থিরতার চূড়ান্ত আপনাকে দেখিয়েই ছাড়বো। মাঝ পথে এসে খেয়াল হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র অবলম্বন্টাই ফেলে এসেছি। একটা খাতা , মাঝখানে গুজে রাখা একটা কলম। সে খাতায় পড়ার বিষয়বস্তু কম কবিতা ছিলো বেশি।

 

এক দৌড়ে ঘরে গেলাম খাতা আনতে। ওদিকে সাইমুনের কলের পরে কল আসছে,  “কিরে বেটা এত্ত দেরি, তোরারে লই ফাইত্তাম নয়” । আমি এক্ষুনি আসছি বলে প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় পুলিশ বক্স পৌঁছলাম । গিয়ে দেখি সাইমুন ভাই পগার পার ,দেরি দেখে মিজবাহ কে নিয়ে সাইমুন কেটে পড়েছে।

 

যাই হোক একটি রিকশার খোজে তৃষিত নয়নে আমি চারদিক দেখছিলাম। টুং টুং মিষ্টি আওয়াজে একটা রিকশাকে এগিয়ে আসতে দেখলাম।  রিকশাচালক এর বয়স বেশি হবেনা,এই ধরুন ২০ থেকে ২৫ এর ঘরে।

 

“এই মামা,মোহসিন কলেজ যাবা?”

“যাবো, উঠেন”

“কত?”

“রেট ভাড়া দিবেন””

“আহ রেট ভাড়া বলে বলে উঠাবা,তারপর তিন গুনা  ভাড়া নিয়ে কেটে পরবা তা হবেনা,”

“না ভাই, রেট ভাড়াই দিয়েন,আমি নতুন চালক”

 

রিকশাচালকের কথার সুরে বুঝলাম,এই ছেলে শিক্ষিত, কোথায় যেন ঘ্যাপলা আছে, ঘ্যাপলা বের করতে ভাড়া ঠিক না করেই উঠে পড়লাম” এটা পুরান কায়দা , কারো পেটের কথা বের করতে গেলে আগে তাঁর ভেতরে বিশ্বাস এর জন্ম দিতে হয়!

 

মাঝে মাঝে টুং টুং আওয়াজে রিক্সা এগিয়ে চলছে। কথার ছলে জিজ্ঞেস করা এমন ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম,

 

“কি নাম তোমার? বাড়ি কই?” ( একটা জিনিশ প্রায় লক্ষ্য করি, সিরিয়াস্লি জিজ্ঞেস না করে,গল্পের ছলে কথা বললে, বা নিতান্ত দায়সারা ভাবে কথা বললে, মানুষ কথা বলে মজা পায়)

 

“ মোতালেব ,    বাড়ি সিলেট”

 

“ওহ” আমি নিতান্ত দায়সারা ভাবে বলার চেষ্টা করে কিছুক্ষন চুপ থাকলাম। আমি জানতে আগ্রহী এটা মোটেই বুঝতে দেওয়া যাবেনা।  মাপা ৩০ সেকেন্ড এর বিরতি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ”তা এখানে কখন থেকে?”

 

 “এখানে আসছি এক বছর”

 

“অন্য চাকরী দেখনাই কেনো?”

“অন্য চাকরীতে ধরা নিয়ম, রিকশা চালায়ে নিজের সুবিধা মত টাইম বের করা যায় পড়ালেখার জন্য”

 

এই পর্যায়ে একটু হকচকিয়ে গেলাম, তাই তো বলি রিকশার সিটে বসা শিক্কিতের আচরনেই তাহলে ঘ্যাপলা! একটু ভালো করে মানুষটাকে দেখলাম। বয়স হয়ত আমার মতই বা একটু বেশি হবে। প্রতিবার প্যাডেলে চাপ দেওয়ার সময় সে হাপাচ্ছে। নতুন যোদ্ধা কিনা!

 

“অহ, ভালো তো, কোথায় পড়?”

“এই বার ডিগ্রীতে ভর্তি হলাম, মোহসিন কলেজে”

 

“বাহ” , সিলেট ছেড়ে এখানে কেনো?”

 

“বাবার অমতে বিয়ে করেছিলাম, আমাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলসে, বউ নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসলাম তাই”

 

“বাবার কাছে ক্ষমা চাইতে পারতেন”

 

“ক্ষমা আমি চেয়েছসিলাম। বাবা যখন বলল গরীবের মেয়ে না হয়ে ধনীর মেয়ে হলে তিনি মেনে নিতেন, এর পর আমার ওই ঘরে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে”  ।

 

“হুম, তো এভাবে কিভাবে চলবেন?”

 

“চলছে তো ভাই, একবেলা খেয়ে না খেয়ে চলছে, শুধু দোয়া করবেন পড়ালেখাটা যাতে চালিয়ে নিয়ে পারি” ।

 

“একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন, সিলেটে ডিগ্রী ও ছিলো, রিকশা ও ছিলো, আপনি চট্টগ্রামকে কেনো বেছে নিলেন?”

 

“ওখানে অনেক পরিচিত, আমার জন্যে তারা ছোট হোক চাইনি আমি, পড়ালেখা করে বড় হয়ে একদিন ফিরে যাবো ইনশাল্লাহ”

 

“ইনশাল্লাহ পারবেন আপনি”

 

এর পর আর বেশি কথা হয়নি, কেনো জানি এর বেশি কিছু জানতে ইচ্ছে হলোনা। এক কলেজের দুই শিক্ষার্থী কলেজ গেটে পৌছুলাম। এক জন চালকের আসনে ,একজন সীট এ বসে।  কি বিচিত্র এ পৃথিবীর নিয়ম!

 

আমি যত তাড়াতাড়ি পারি রিকশা থেকে নেমে যেতে চাইছিলাম। মোতালেবকে দেখে বুঝলাম ভালো কাজের পথটা কঠিন ই হয়। সে অনেক ভাবেই রোজগারের পথ বেঁছে নিতে পারতো, সে বেঁছে নিয়েছে সত্যের কঠিন পথকে। তাকে স্যালুট জানাই আমি অন্তর থেকে ।  একজন মোতালেব কে একি কলেজে পেয়ে আমি গর্বিত। বিদায় বেলায় তাকে আর মামা ডাকতে পারলাম না।। অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এলো কথাটা্‌,

 

“ আসি ,ভাই, ইনশাল্লাহ আবার দেখা হবে”

 

খুব করে চাইলেও মোতালেবের সাথে আর দেখা হয়নি আমার। আজ এতো বছর পর তাঁর কথা খুব করে মনে পড়লো। কেমন আছেন মোতালেব ভাই? 

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া