ডাঃ জোবায়ের চিশতীঃ বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন মহানায়ক

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

এই বাংলাদেশ এমন এক দেশ যার অধিবাসীদের এক বিশাল অংশ দিনে এনে দিনে খায়। যাদের জীবন নামক অভিধানে একটু আরাম, একটু স্বস্তি, একটু উন্নত চিকিৎসা আর ‘better living’ এই শব্দগুলো অচিন শব্দ। প্রতিদিন কত শিশু সেখানে মারা যাচ্ছে অপুষ্টি,নিউমোনিয়া, কলেরা, ডায়রিয়া এই রোগগুলোতে।

এমন এক অভাগা দেশের সন্তান ডাঃ জোবায়ের চিশতি। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। ইন্টার্নশিপ এর প্রথম রাতে সিলেটের এক হাসপাতালে তরুন জোবায়ের চিশতি তার চোখের সামনে পরপর ৩টি শিশুকে চোখের সামনে নিউমোনিয়ায় মারা যেতে দেখলেন। উন্নত দেশগুলোতে নিউওমোনিয়ার চিকিৎসায় যে  ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা হয় তার দাম প্রায় ১৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ ডলার। গরীবের জন্যে যা আকাশ-কুসুম স্বপ্ন। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্যে WHO (World Health Organization) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্যে ‘Low-flow’ নামে একটি পদ্ধতি ঠিক করে দিয়েছে। বাচ্চাগুলোকে সেই লো-ফ্লো পদ্ধতি অনুযায়ীই ফেস মাস্কের মাধ্যমে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিলো। কিন্তু কঠিন নিউমোনিয়ায় এই পদ্ধতি অধিকাংশ সময়ই ফুসফুসে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারেনা। যার ফল প্রতিবছর নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই রোগে মারা যায় লাখ লাখ শিশু। সেদিন সেই রাতে সিলেটের সেই হাসপাতালে তরুন চিকিৎসক ডাঃ চিশতীর চোখের সামনে সেই ৩টি বাচ্চাও মারা গেলো। অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিলেন, কিছুই করতে পারেননি তিনি। সেদিন নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে গরীব শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসার জন্যে তিনি কিছু একটা করবেন যাতে এই শিশুদের জীবন নামক রঙ্গমঞ্চে নামার আগেই অবেলায় নিউমোনিয়া নামক ঘাতকের আঘাতে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে না হয়।

 

আজ অনেক বছর পর সেদিনের সেই তরুন জোবায়ের চিশতী উঠে এসেছেন CNN, The Telegraph, The Economist সহ আরো অনেক বিশ্ববিখ্যাত গণমাধ্যমের সংবাদে। কীভাবে? ‘যখন আপনি মন থেকে কোন মহৎ কাজের জন্যে প্রতিজ্ঞা করবেন তখন স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাতা’লা হয়ে যাবেন আপনার সহায়তাকারী ও পথপ্রদর্শক’।

 

মেধাবী জোবায়ের চিশতী  দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত রিসার্চ ইন্সটিটিউট icddr,b (International Centre for Diarrhoeal Disease Research, Bangladesh) এ কাজ করা শুরু করেন। বাংলাদেশের এই সেন্টারটি মূলত দরিদ্র দেশগুলো যে সমস্ত অপুষ্টিজনিত রোগ ও মহামারিতে আক্রান্ত হয় সেই রোগগুলোর এবং স্বল্পমূল্যে সেগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার নিয়ে গবেষনা করে এবং দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করে। ডাঃ চিশতী মূলত নিউমোনিয়া নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। অপুষ্টিতে ভোগা একটি শিশু যখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় তখন তার ফুসফুস শ্বাস-প্রশ্বাসের অতিরিক্ত উঠানামাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা। উন্নত দেশগুলোতে এই শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রনের জন্যে একটি ভেন্টিলেটর ব্যাবহার করা হয়। ডাঃ চিশতী একবার অস্ট্রেলিয়ার একটি হাসপাতালে Bubble-CPAP একটি ভেন্টিলেটরের সাথে পরিচিত হন যেটি প্রি-মেটিউরড বাচ্চাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজে ব্যবহার করা হয়। এই মেশিনটির দাম প্রায় ৬০০০ ডলার। যদিও উন্নত বিশ্বে ব্যবহৃত সেই ভেন্টিলেটরের চেয়ে দাম অনেক কম, তারপরো দরিদ্র মানুষদের পক্ষে এর চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য তো নেই। ডাঃ চিশতী একদিন ফেলে দেওয়া একটি শ্যাম্পুর বোতল হাতে তুলে নিলেন যার ভেতর শ্যাম্পুর কিছু বুদবুদ তখনো রয়ে গেছে। সেই মুহুর্তে তার অস্ট্রেলিয়ায় দেখা সেই Bubble-CPAP এর মেকানিজমের কথা মনে পরে গেলো। ডাঃ চিশতী সেই মুহূর্তে অনুভব করলেন খুব সামান্য কিছু জিনিষকে একত্রিত করে তিনি এমন কিছু একটা বানাতে পারবেন যা নিউওমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসে ক্ষেত্রে সেই Bubble-CPAP এর কাজ করবে। একটি অক্সিজেন সাপ্লাই, কয়েকটি টিউব আর একটি প্লাস্টিকের বোতলের সমন্বয়ে তিনি এমন একটি জিনিষ তৈরী করলেন যার খরচ পরে মাত্র ১.২৫ ডলার!! আর এই পদ্ধতি অনুসরন করে তিনি iccddr,b তে নিউওমোনিয়ার চিকিৎসা শুরু করেন। ২০১৫ সালে ডাঃ চিশতী ও তার সহকর্মীরা তাদের এই আবিষ্কার ও এর ভিত্তিতে চিকিৎসার ফলাফল যখন প্রকাশ করেন সেটি চিকিৎসার ময়দানে রীতিমতো হইচই ফেলে দেয়। দেখা গেলো ডাঃ চিশতীর হাসপাতালে এই পদ্ধতি অনুসরন করার কারনে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা কমে এসেছে ৭৫%। আরো দেখা গেলো, ১.২৫ ডলারের এই Bubble-CPAP এর মাধ্যমে উন্নত বিশ্বের সেই ৪০,০০০ ডলারের ভেন্টিলেটর সিস্টেমের মতো একই চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে!!

বহু বছর আগে ডাঃ চিশতী তিনটি ছোট্ট শিশুর মৃত্যু দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আল্লাহ তার সেই প্রতিজ্ঞাকে সফল করে দিলেন।

 

ডাঃ চিশতীর আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি ইথিওপিয়াসহ অনেকগুলো দেশ ব্যবহার করা শুরু করেছে। আর ডাঃ জোবায়ের চিশতী ও তার এই Ground breaking আবিষ্কার উঠে এসেছেন বিশ্বগনমাধ্যমে। আজ বহু মানুষ, বহু দরিদ্র পরিবারের দোয়ায় শামিল এই মানুষটি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহু ছাত্রের কাছে আজ ডাঃ জোবায়ের চিশতী রোল মডেল। আমরাও বলতে চাই…
‘What a great Doctor!’
‘What a great Person!’
‘What a great Achievement!’
And ‘What a fulfilling Life!’

ডাঃ জোবায়ের চিশতীর মতো মানুষেরাই আমাদের সত্যিকার রোল মডেল, এই জাতির সত্যিকার মহানায়ক…

ক্রিকেটার, মিউজিশিয়ান আর তথাকথিত অনলাইন-অফলাইন সেলিব্রেটিদের চক্করে মজে থাকা তরুনদের উচিত জোবায়ের চিশতীর মতো সেই মানুষদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার যারা অন্তরালে থেকে নিঃস্বার্থভাবে দেশের ও মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। যারা আল্লাহ প্রদত্ত ‘জীবন’ নামক আমানতকে মহান কোন উদ্দেশ্যের পেছনে বিনিয়োগ করে দিয়েছেন। আমাদের যুবসমাজ যেনো ভুলে না যায়, সত্যিকার সফলতা আসে নিঃস্বার্থপরতা, আত্মত্যাগ ও মহান কিছু করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে।

আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, ব্যক্তিজীবনে একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ডাঃ জোবায়ের চিশতীকে তিনি নেক হায়াত দান করুন আর এই দূর্ভাগা জাতি যেনো জোবায়ের চিশতীর মতো আরও অনেক মহান সুসন্তানদের পেতে পারে যারা পৃথিবীর বুকে এই দেশকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখাবে।

 

    

 “The most beloved people to Allah are those who are most beneficial to the people.
(al-Muʻjam al-Awsaṭ, Hadith no: 6192)

 

 

তথ্যসূত্রঃ

The Economist: Click To Go

CNN : Click To Go

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া