একজন দিনমজুর ও একটি স্কুল ডায়েরির গল্প
শিহাবের আজ স্কুলের প্রথম দিনা। সে ভর্তি হবে প্রথম শ্রেণীতে। যদিও তার বয়সের অনেক ছেলে-মেয়েই তার অনেক আগে থেকেই স্কুলে যায়, তার এতদিন সুযোগ হয়ে উঠেনি। তার বাবা সামান্য এক দিনমজুর। দিনে আনে দিনে খায়। ছেলেকে তাই স্কুলে দিব দিব করতেই কয়ে কটা বছর কেটে যায় শিহাবের বাবার। শিহাবের বাবা নিজে মেট্রিক পাশ। ছোটখাট চাকরির পেছনে না ছুটে দিনমজুরের কঠোর অধ্যাবসায়ের পথ কে বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
সকাল থেকেই শিহাবের বাবার মন অন্যরকমের এক আনন্দে ভরে উঠেছে। তার এতদিনের স্বপ্ন আজ পূর্ণ হওয়ার পথে। ছেলেকে তিনি নিজে অ , আ ,ক , খ শিখিয়েছেন। পড়িয়েছেন ছড়া, কবিতা, গল্প । আজ তার শিহাব স্কুলে যাবে অন্যান্য ছেলেদের সাথে এ কথা ভাবতেই তার চোখ আনন্দের অশ্রুজলে ভিজে উঠছিল। শিহাবের মা শিহাবকে ভোরে উঠেই প্রস্তুত করছেন স্কুলে যাওয়ার জন্য। শিহাবের মনেও যে আনন্দের ঘাটতি আছে তা নয়। শিহাব বার বার ভাবছে ,তার মাঠের খেলার সাথীদের কথা। তারা তাকে প্রায় জিজ্ঞেস করত, “কিরে স্কুলে যাস না কেন?”
উত্তরে সে সবসময় চুপকরে থাকত। আর মাঝে মাঝে বাসায় এসে চুপচাপ চোখের পানি ফেলত। সে ছোট হলেও ততদিনে বুঝিতে শিখেছিল তাদের ঘরের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। তবুও সে মাঝে মাঝেই তার মাকে বলত “মা আমি কি স্কুলে যাবোনা ?”
মা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে অস্পষ্ট সুরে বলতেন “যাবি বাপ্ যাবি , কিছুদিন পরেই যাবি “
সেই কিছুদিন আসতে আসতে কয়েকটা বছর ঘুরে গেলো। অবশেষে আজ সেই দিন , সকাল নয়টায় শিহাবের স্কুলে প্রথম ক্লাস। শিহাবদের ঘরে যেন আজ ঈদের চাঁদ উঠেছে। শিহাবের মা খুশি ,বাবা খুশি , খুশি শিহাব।
শিহাবের মা শিহাব কে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে অনেক্ষন হলো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শিহাবের বাবারও সাথে আসার কথা ছিল কিন্তু কোথায় যেন মাটি কাটার কাজ পাওয়ায় সেখানে ছুটে যেতে হয়েছে তাকে। এ সুযোগ হাত ছাড়া করা যেতোনা। শিহাবের পড়া লেখা চালাতে এখন সংসারের খরচটা এমনিতেই বাড়বে।
শিহাবের মাকে একজন শিক্ষক জিজ্ঞেস করেছিল শিহাবের বাবা কি করেন। শিহাবের মা উত্তরে সত্যটাই বলেছিল। এরপর থেকে স্কুল শিক্ষকরা অনেকেই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন ব্যাপারটা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। যেখানে অন্য ছাত্রদের কেদারদুরস্ত অভিভাবকদের আলাদা ভাবেই যেন দেখা হচ্ছিল।
একই জিনিস শিহাবের বাবাও কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিল যখন তিনি শিহাবকে আনতে স্কুলে গেলেন। শিহাবের বাবা ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে এবং তার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ,ক্লাস টিচারের এমন ভাযে তাকিয়ে ছিল যেন একজন দিনমজুর পড়াশুনার ব্যাপারে জানতে চাইতে পারেনা , কারণ কিছু বললেও সে কিছু বুঝবেনা।
***************************************
শিহাবদের স্কুলে আজ গ্রীষ্মের ছুটির আগে শেষ দিন। শেষ ক্লাস চলছে। ক্লাস টিচারের মোবাইলে একটি কল এলে তিনি সেটা বিরক্তির সাথে রিসিভ করে বাইরে গেলেন।
তিনি কথার এক পর্যায়ে বললেন “না ডায়েরিতে কোন ভুল নেই, আমি নিজে লিখেছি ‘
ওপাশ থেকে কেউ হয়ত কোন বানানের কথা জিজ্ঞেস করল।
ক্লাস টিচার বললেন “না বানানটা আমি লিখেছি , হ্যা হ্যা এটাই সঠিক বানান , আপনি কি আমার চেয়ে বেশি জানেন?”
ক্লাস ওয়ানের টিচার আবার ক্লাস নিতে শুরু করলেন। ছুটির ঘন্টার ঠিক আগে ,স্কুলের প্রিন্সিপাল পিয়ন কে দিয়ে শিহাবদের ক্লাস টিচারকে ডাকালেন।
প্রিন্সিপাল তাকে জানালেন একজন অভিভাবক তাকে ফোন করে জানিয়েছেন – ক্লাস ওয়ানের ক্লাস টিচারের ডায়েরিতে কয়েকটা লিখা বেশ কয়েক জায়গায় বারংবার ভূল। ক্লাস টিচারকে ফোন করা সত্ত্বেও তিনি নাকি ব্যাপারটার সুরাহা করেন নি। ক্লাস টিচার এবার একটু টেনশনে পড়ে গেলেন বোধয়। তিনি জানালেন একজন তাকে ফোন করেছিলেন , এবং তিনি জানিয়েছেন বানানে ভুল নেই।
প্রিন্সিপাল জিজ্ঞেস করলেন “আমি কি ডায়েরিটা একটু দেখতে পারি?,ছাত্রটির ডায়েরিটি নিয়ে আসুন ”
ক্লাস টিচার বলেন “ছাত্রটির নাম কি?”
প্রিন্সিপাল জানালেন শিহাবুর রহমান। পিয়নকে দিয়ে ডেকে আনা হল শিহাবকে ,তার ব্যাগ সমেত। প্রিন্সিপাল শিহাবকে তার ব্যাগ থেকে তার স্কুল ডায়েরি বের করতে বললেন , এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডায়েরিটা পড়ে তিনি ক্লাস টিচারকে ভূলগুলো ধরিয়ে দিলেন। ঘটনাটা ক্ষুদ্র আঙ্গিকে ঘটলেও পরবর্তীতে এর ব্যাপ্তি ঘটল। এই ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকা পিয়নের ভূমিকায় মূখ্য।
****************************************************************************
গ্রীষ্মের ছুটির পর, আবার নিয়মিত ক্লাস শুরু হলো. ক্লাস চলছে , শিহাবও নিয়মিত ক্লাস করছে। সেদিনের সে ঘটনা সবাই ভুলে গেছে। মনে ছিল , সেই স্কুলের প্রিন্সিপালের। স্কুলের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি তার বক্তব্য শেষ করার আগে একটি ছোট গল্প বলবেন বললেন শুরুতেই।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি সেটা শুরু করলেন।
তার গল্পটি এবারের বর্ষসেরা অভিভাবককে নিয়ে। একে একে বলে গেলেন একজন দিনমজুরের কথা। কষ্ট করে সেই বাবার ছেলেকে স্কুলে পড়ানোর কথা। তিনি জানালেন ,তিনি অবাক হয়েছিলেন , যখন তিনি কথা বলে জানতে পারলেন একজন দিনমজুর তার ছেলের পড়ালেখার ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস হলে , ছেলের স্কুলের বই থেকে শুরু করে ডায়েরি পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাচাই করে দেখেন যে, ছেলে কোথাও ভুল শিখছেনাতো ? হয়ত সব ভুল তিনি ধরিয়ে দিতে পারেন না। কিন্তু তিনি সাহস রাখেন ভূল ধরিয়ে দেবার। এর জন্য তিনি ক্লাস টিচারের উষ্মার স্বীকার হতেও কুন্ঠিত বোধ করেন না।
সর্র্বশেষ , তিনি নাম ঘোষণা করলেন ,
“এবারের বর্ষসেরা অভিভাবক ইজাজুল রহমান, পেশায় তিনি একজন দিনমজুর “ – তিনি আমাদের শিহাবুর রহমান শান্তের গর্বিত পিতা”
ইজাজুল রহমান আনন্দে কাঁদছেন। শিহাবের মাও। শিহাব তার শিশুসুলভ চোখে তার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই যখন তার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে তুমুল করতালিতে ব্যস্ত শিহাবের চোখেও কোথা থেকে রাজ্যের জল এসে জমা হলো।