গল্পটা আমার , আপনার। আমাদের জীবনের। উত্তরা বিমানবন্দর রেল স্টেশনে বসে ছিলাম, কখন ঘোষণা আসবে চট্টগ্রাম অভিমুখী সুবর্ন এক্সপ্রেস অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে এক নম্বর প্লেট ফার্মে এসে থামবে এমন কিছু শুনার জন্যে।
আর আমি ৪:৫০ এর ট্রেন ধরতে ৩:৫০ এ এসে বসে থাকা অধম। তবে এই ঘন্টাটা না পেলে একটা জীবনকে ছুয়ে দেখা হতনা।
অনেক্ষন দাঁড়িয়ে , সময় সুযোগ বুঝে স্টেশনে গোল করে সিমেন্টের বসার জায়গায় জায়গা মেরে দিলাম। পাশেই একজন খুব ছোট করে বলে উঠলো, আসসালামুয়ালাইকুম, এখানে একজন আছে।
আমি কিছু বলার খাতিরে আর জায়গা না ছাড়ার খাতিরে বললাম কে আছে ? এটা তো টিকেট কাটা সিট না। ছেলেটাও চুপ গেলো। আমিও পেয়ে গেলাম, জায়গার ক্ষণস্থায়ী মালিকানা।
পাশ ফিরে একবার দেখে নিলাম ছেলেটাকে। একেতো ঢাকা, তার উপর এমনিতেই পকেট কিছুটা ফাঁকা। যা আছে তা হারালে রক্ষে নেই। ওদিকে আবার মা ,বোন হুশিয়ারি দিচ্ছে
কেউ কিছু দিলে খাবনা। বয়স ২৮ গড়িয়ে ২৯ এ তবুও তাদের কাছে বড় হতে পারলাম না। এটাও যে কত বড় পাওয়া, এই যে বন্ধন, মায়া, নিষেধ, উপদেশ না হারালে কি আর বুঝা যায়। যার আছে এসব তার এসবের মর্ম বুঝা দায়!! !
ছেলেটার চেহারায় কোনো ভাব নেই। বরঞ্চ দেখলেই মনে হবে একে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু আসলেই কি বিশ্বের বাজার বড় নড়বড়ে এখন। নিজের ছবি মাঝে মাঝেই নিজের থেকে পিঠ ফেরায়, ভেলকি দেখায়। তাই এই সিধে চেহারার আড়ালে কিছু যে ভেজাল বিলক্ষণ থাকতে পারে সে ব্যাপারে আমার সচেতন থাকা দরকার। তাই আর আগ বেরে ভাব দেখলাম না।
ছেলেটাই জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া সময় কত। জানালাম ৪:০০ টা। হতচ্ছাড়া সময় ও নাছোড়বান্দা। যায়না।
সময় কাটতেই জিজ্ঞেস করলাম কোথায় বাড়ি ? থাকো কই ?
সিলেট যাচ্ছি। সকালের ট্রেন মিস দিসি , কপাল খারাপ। * অমুক জায়গা থেকে ঢাকা আসলাম এখন ঢাকা থেকে সিলেট যাবো। সকালের ট্রেনেই যেতে পারতাম একটুর জন্যে মিস হলো।
তো বাড়ি কি সিলেটে নাকি, অমুক জায়গায় ? মানি *অমুক ( *অমুক জায়গা_ নাম ভুলে গেছি, মাথা বাড়ি দিলেও এখন নামটা আর মনে পরবেনা, কোন এক সিরিয়াস কাজের মুহূর্তেই হয়তবা ছেলেটার দেশের বাড়ির নাম মনে পড়বে) জায়গা থেকে সিলেটে যাচ্ছ ঘুরতে? নাকি সিলেটে থাকো, অমুক জায়গায় কোন কাজ সেরে আসতেস?
আমি নিজেই বুঝলাম আমার প্রশ্ন করার ক্ষমতা ভেজাল টাইপের, প্রশ্নটা আমি এভাবেই করতে পারতাম_ তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়? এখন কি কাজে যাচ্ছ? তাহলে সহজ প্রশ্নে সে সব উত্তর দিতে পারতো।
ছেলেটা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে প্রশ্ন বুঝে নিয়ে গুছিয়ে উত্তরটা দিল। ভাইয়া আমি সিলেটে মাদ্রাসায় পড়ি। এখন নবম ধাপে আছি। আর ৭/৮ বছর পর ইনশাআল্লাহ পড়া লেখা শেষ হবে। আমার আসল ঠিকানা *অমুক জায়গায়, কিন্তু সেখানে ৯ বছর পর গেলাম , আমি এখন সিল্টের জাফলং এর * মাদ্রাসায় পড়ি ৯ বছর ধরে।
আচ্ছা, তোমার ঘরে কে আছে ?
কেউ নেই।
বাবা ?
জন্মের আগে আগে মারা গেছে।
ওহ, তোমার মা কোথায়?
এইতো দেড় বছর আগে মারা গেলো।
হুম, এই পর্যায়ে তাকে কি প্রশ্ন করবো বা কথা বলবো ভাবছিলাম। তার ঘরের অন্য সদস্য আছে কিনা জিজ্ঞেস করে পরিস্তিতি ঘুরাতে চাইলাম।
আর কেউ আছে ভাই বোন ?
বোন আছে , মানে ছিল, সে স্মিত হেসে জানালো, সে হাসিতে একে একে সব হারানোর বেদনা। সে জানালো, বাবা মারা গেছে জন্মের আগে এক্সিডেন্ট , মা মারা গেছে পেরালাইসিস এ, আর যে বড় বোন ছিল, সেও মারা গেলো অসুখে। সে কথা গুলো কত সাধারণ ভাবে বলে গেল। যেন এটাই জীবন।
আমি আর কিই বা জিজ্ঞেস করতে পারি একজন ১০/১২ বছরের ছেলেকে, যে এই ক্ষুদ্র জীবনে এত্ত কিছু হারিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ সে ভালো পথেই আছে, ভবিষ্যতে পড়ালেখা শেষ করার স্বপ্ন দেখছে একাই তার নির্ভীক চোখে। আল্লাহ ভরসা।
আমার মোবাইল এর চার্জ শেষের দিকে। আমি ট্রেনে। আরো আধা ঘণ্টার গল্পের, পরিচয়ের পর আমরা আলাদা রাস্তা ধরেছি। ভালো কথা ছেলেটার নাম মো জুনাইদ আহমেদ। নামটাও আমার সাথে মিলে গেলো। একই নাম, কতনা ভিন্ন জীবন। কত কষ্টের, কত পরিশ্রমের কত নির্লিপ্ত আত্মত্যাগের। আরো গল্প আছে ইয়াসিন এর সাথে। সেটা পরে লিখে রাখবো ভাগ্যে থাকলে। ও হ্যা, ইয়াসিন তার মার রাখা নাম। সেটা সে মনে রেখেছে। প্রথমে বলেছে অনেক ইয়াসিন নাম তার মা বাবা রেখেছে, পরক্ষণে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলেছে,
।” না ভাইয়া বাবা কেমনে নাম রাখবে, বাবা তো আমি আসার আগেই মারা গেছে, মা রাখছে, বলে আরেক দিকে তাকালো”
আমিও।।
(বাকি কথা পরে ইনশাআল্লাহ লিখতে চেষ্টা করবো)