মৌলানা আবুল কালাম আজাদঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক

Please log in or register to like posts.
পোস্ট
Abul_Kalam_Azad, মৌলানা_আবুল_কালাম_আজাদ

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ – সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক

মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্ম মক্কায়, ১১ নভেম্বর ১৮৮৮ সালে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের বাবা ছিলেন একজন স্কলার। সিপাহী বিদ্রোহের সময় কালে মৌলানা আজাদের বাবার মৃত্যু ঘটে।  মৌলানা আজাদ নিজেও ছিলেন মুসলিম স্কলার। যারা চায়নি ভারত ভাগ হোক তাদের মধ্যে আবুল কালাম আজাদ অন্যতম। তিনি হিন্দু-মুসলিম সকলের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা করে এক জাতির পক্ষে ছিলেন। এর পক্ষে তিনি কাজ করেছেন । এমন কি ভারত থেকে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সে সময়ের পাকিস্তানের অদূর ভবিষ্যৎ তিনি মানস-চক্ষে দেখেতে পেয়েছিলেন।

মৌলানা আবুল কালাম গুলাম মহিউদ্দিন আহমেদ বিন খাইরুদ্দিন আল হুসাইনী( জন্মঃ ১১ নভেম্বর, ১৮৮৮, মৃত্যুঃ ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৫৮)  ভারতের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বস্থানীয় পদে ছিলেন তিনি, এবং তিনি ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী । । তিনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নামেই বহুল পরিচিত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা অনন্য। তিনি কখনো চাননি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি হোক। তিনি চান নি ভারত খন্ডীত হোক! সোজা ভাষায় বলতে গেলে তিনি রাষ্ট্রের অঙ্গবিচ্ছেদ চান নি একেবারেই। তাঁর মতের পক্ষে অবশ্যই তাঁর পোক্ত যুক্তি ছিল।তাঁর ছদ্মনাম আজাদ। যার অর্থ “মুক্ত”

তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন বই থেকে পড়ে এটা ধারনা হয়েছে আমার যে, তিনি সর্ব-ভারতের মুক্তি চেয়েছিলেন, তিনি দ্বি বা ত্রি-খন্ডিত ভারত মোটেই চান নি। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ যৌবনে উর্দুতে কাব্য চর্চা করতেন।  তাঁর লেখার মধ্যে, চিন্তা চেতনার মধ্যে সে সময়কার রাজনীতি ও দর্শনের স্থান ছিল লক্ষণীয় ।সাংবাদিকতা কে পেশা হিসেবে নেন তিনি। লেখালেখির মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলেন। তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কে সমর্থন করে সরাসরি ব্রিটিশ শাসন কে নিয়ে সমালোচনা করেন।আজাদ খিলাফৎ আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। সে সময়েই তিনি ভারতের সংগ্রামী নেতা মহাত্মা গান্ধীর সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে পরিচিত হন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ গান্ধীর নন-ভায়োলেন্ট মতের পক্ষে ছিলেন শুরু থেকেই।  ১৯১৯ সালে রাওলাট আইনের বিপক্ষে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দলোনের ভূমিকায় অনুপ্রাণিত হন মৌলানা আজাদ। এ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মৌলানা আজাদ অসহযোগ আন্দলোন সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।স্বদেশী পন্যের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং স্বরাজ আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য , সেকুলারিজম এবং সোশিয়ালিজমের পক্ষে ছিলেন।

১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । সে সময়ই ভারত ছাড় আন্দোলন জোরদার হয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং আরো অনেক পলিটিকাল লিডার কে সে সময়  তিন বছর কারারুদ্ধ অবস্থায় কাটাতে হয়। সে সময়ই তিনি লিখেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Ghubar-e-Khatir (Sallies of Mind)  । বইটিতে আছে ২৪ টি চিঠি। এ চিঠি গুলো লিখা হয়েছিলো মৌলানা আবুল কালামের কাছের বন্ধু মৌলানা হাবিবুর রহমান খান শেরয়ানিকে।  যদিও এ চিঠি গুলো তাঁর বন্দী দশায় কখনই তাঁর বন্ধুর কাছে পৌছায় নি। বন্দীদশা থেকে মুক্তির পর পরই মৌলানা আবুলা কালাম আজাদ চিঠিসমূহ তাঁর বনন্ধু আজমল খান কে দিয়ে দেন।  যিনি পরবর্তিতে এগুলো পাব্লিশ করেন ১৯৪৬ সালে। চিঠি গুলোতে ছিলো ধর্ম, সংগীত  বিষয়ক আলোচনা। এটা প্রায় বলা হয়ে থাকে যে Ghubar-e-Khatir (Sallies of Mind) এই বইটিতে তাঁর সামাজিক, এবং ধার্মিক জীবনের প্রতিচ্ছবি খুজে পাওয়া যায় এবং তাঁর লিখিত বই   India Wins Freedom  থেকে রাজনৈতিক  জীবন সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়।

 তিনি দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের বিপক্ষে ছিলেন। এমনকি তিনি পরবর্তি সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্পর্কে এবং এর ভাঙ্গন সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। দেশ বিভাগের পর মুসলিম দের সুরক্ষার জন্য চিন্তা করেছিলেন। তিনি দূরদর্শিতার চিহ্ন রেখেছেন শিক্ষার ক্ষেত্রেও। আবুল কালাম আজাদের পূর্বপুরুষরা  ছিলেন শিক্ষিত এবং দীনি দীক্ষায় দীক্ষিত । তারা ভারতে স্থায়ী ভাবে থাকা শুরু করেন মুঘল শাসনামলে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মায়ের পূর্বপুরুষ আরববাসী ছিলেন। পরিবারটি বেঙ্গল রিজিওনে ছিলো ১৮৫৭ সালে সংগঠিত বিদ্রোহের আগ পর্যন্ত। পরবর্তিতে তারা মক্কায় স্থায়ী হন। ১৮৯০ সালে পরিবারটি ফের কলকাতায় ফিরে আসে। আজাদ ছোট বেলা থেকেই ধর্মীয় এবং সময়ানুযায়ী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেন। তিনি নিজের ঘরেই ওস্তাদদের কাছ থেকে শিখতেন এবং কাছাকাছির মধ্যে অবস্থিত মসজিদে শিক্ষা গ্রহনের জন্য যেতেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ উর্দু,পারসিয়ান,আরবী, হিন্দি ভাষার উপর দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর বাবা তাঁর জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেছিলেন।এভাবেই   তিনি অঙ্কশাস্ত্র, বিজ্ঞান, পৃথিবীর ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তিনি মাত্র ১৬ বৎসর বয়সেই ঐতিহ্যগত পড়াশুনা শেষ করেছিলেন। কম বয়সেই বিয়ে করেন।তার স্ত্রীর নাম জুলেখা বেগম

  মৌলানা আবুল কালাম আজাদ আহলে হাদীসের অনুসারী ছিলেন। শুরু থেকেই তাঁর শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবার কেন্দ্রিক ছিলো। কিন্তু তিনি আধুনিক ধ্যান ধারনা দ্বারা ও অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি ঐতিহ্যগত ভাবে যেসব পড়ালেখা করেছিলেন সে সব সম্পর্কে ,ও ঐতিহ্যগত বিভিন্ন ধ্যান্ধারনা নিয়ে তিনি ভিন্ন মত পোষণ করতে লাগলেন। পরবর্তিতে তিনি ভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান চর্চা শুরু করেন।   তিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে লাগলেন । পাশ্চাত্যের দর্শন,ইতিহাস এবং সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে জানতে গভীর ভাবে পড়তে শুরু করলেন তিনি। তিনি মুসলিম শিক্ষাবিদ স্যার সৈয়দ আহমেদ খান এর আধুনিক ধ্যান ধারনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।  তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এবং আলোচনায় চিলেন ব্রিটিশ শাসনের সমালোচক। ব্রিটিশরা যে জাতিগত বিভেদের ধারণার সৃষ্টি করেছিল এর বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি।  ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতের সাধারন জনগন সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত ছিল। সাধারন মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেন তিনি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।  এদিক থেকে তাঁর পরিচয় ছিল স্যার অরবিন্দু এবং শ্যাম সুন্দর চক্রবর্তির সাথে ।

স্বাধীনতার বিদ্রোহের কাজে তিনি বাংলা,বিহার,মুম্বাই এ কর্মরত ছিলেন।পরবর্তিতে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়লে  তিনি উর্দুতে একটি সাপ্তাহিক খবরের কাগজ প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম আল-হিলাল এবং এর মাধ্যমে তিনি সরাসরি ব্রিটিশ রাজনীতিকে আক্রমন করেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের লেখনীর উদ্দ্যেশ্য ছিল যুব সমাজকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য  তৈরি করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। সে সময়ের সরকারী সংবাদপত্র বিধিমালা মোতাবেক মৌলানা আবুল কালামের আল-হিলাল কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।  মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নতুন একটি জার্নাল প্রতিষ্ঠা করেন।

জাতিগত ঐক্য এবং ভারতিয় জাতীয়তাবাদের পক্ষে যা সোচ্চার ছিল। তিনি খিলাফৎ আন্দোলনেও নেতৃত্ব দান করেন। ব্রিটিশ সরকার এটা লক্ষ্য করেছিল যে মৌলানা আবুল কালাম আজদের জনপ্রিয়তা রাতারাতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল।  ফলে তারা আইনানুগ ভাবে Defence of India Regulations Act এর অধীনে তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশনীটিকেও বন্ধ করে দেন এবং এই আইনের বলে মৌলানা আজাদ কে গ্রেফতার করে। ইউনাইটেড প্রোভিন্স, পাঞ্জাব, দিল্লিতে মৌলানা আজাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোশনা করে ফরমান জারি করা হয়। ওনাকে সরিয়ে নেওয়া হয় রাঞ্চির জেলে। যেখানে তিনি ছিলেন ১ জানুয়ারী ১৯২০ সাল পর্যন্ত। মুক্তি পাওয়ার পর আবুল কালাম আজাদ রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসেন ভরপুর প্রানশক্তি ও ব্রিটিশবিরোধী  প্রেরণা নিয়ে। ভারতীয় নাগরিকরা মানসিক ভাবে ক্ষেপে ছিল ১৯১৯ সালে প্রণীত রাওলাট এক্টস এর কারনে। রাওলাট এক্টস এর কারনে নাগরিকদের সাধারন অধিকার ভোগের দিকটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আটক করা হয় এবং অনেক গনমাধ্যম কে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয় ।

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের নিরস্ত্র নাগরিকের হত্যার ঘটনা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করে। পরবর্তিতে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতিয় কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন হয় যিনি ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারনে ভারতিয় জনমনে সাড়া ফেলেছিলেন।   গান্ধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।  এমনকি গান্ধী হিন্দি-মুসলিম দন্দ দূর করেত সচেষ্ট ছিলেন। মৌলানা আজাদ ও এতে অনুপ্রাণিত হন। তিনি গান্ধী মতবাদের সাথে ঐক্যমত ছিলেন।  এসময় ভারত জুড়ে বিদেশি পন্য বয়কটের অসহযোগ আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। এসময় মৌলানা আবুল কালাম কংগ্রেসে জোগদান করেন এবং সর্ব-ভারতীয় খিলাফত কমিটির  প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। যদিও মৌলানা আজাদ সহ অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে শীঘ্রই ঘেফতার করা হয়।  যদিও এরি মধ্যে অজস্র মানুষ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল।এসময়টা ছিল মৌলানা আজদের জীবনের একটা পরিবর্তনের সময়।  আজাদ ধীরে ধীরে গান্ধী মতবাদের সাথে এবং গান্ধীর সাথে আরো ভালো ভাবে পরিচিত হয়ে উঠেন।

মৌলানা আজাদ এবং গান্ধী দুজনই ধর্ম সম্পর্কে গভীরভাবে জানার ব্যপারে আগ্রহী ছিল। এভাবেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক গড়ে উঠে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ গান্ধীর সাধারন জীবনযাপন দেখে অনুপ্রাণিত হন। এমনকি তিনি গান্ধীর অনুসরনে চরকায় খাদির ব্যবহার করে নিজের কাপড় নিজে বোনা শুরু করেন।  মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে জওহরলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাস, এবং সুবাস চন্দ্র বোস এর সাথে। আজাদ ছিলেন দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোর বিরোধী। অনেক মুসলিম নাগরিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আজাদ কে সমালোচনা করেন মুসলিমদের কথা চিন্তার আগে তিনি রাজনীতি কে প্রাধান্য দিচ্ছেন এই কথা বলে।

 এরি মধ্যে মুসলিম লীগ আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র মুসলিম লীগের কথা চিন্তা করছিলো। জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বটি আসলে হিন্দু ও মুসলমান্দের আলাদা জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এটা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মোটেই পছন্দের ছিলনা।

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এ সম্পর্কে বলেন

…সম্পূর্ন এগারোটি শতাব্দী শেষ হয়েছে, ভারতের মাটিতে ইসলামের দাবি   আছে ঠিক ততটুকু যতটুকু হিন্দুদের আছে,। যদি কয়েক হাজার বছর ধরে এখানকার মানুষদের ধর্ম হিন্দইজম হয়ে থাকে, ইসলাম ও এখানকার মানুষদের হাজার বছরের ধর্ম। ঠিক যে ভাবে গর্বসহকারে একজন হিন্দু বলতে পারে সে ভারতীয়, এবং সে হিন্ধু ধর্মের অনুসারী , ঠিক একিভাবে আমরা সমান গর্বভরে বলতে পারি  আমরা ভারতীয় এবং আমরা ইসলামের অনুসারী। আমার উচিৎ সীমা আরো বর্ধিত করা।ভারতীয় খিস্টানদেরও অধিকার আছে এটা বলার যে সে একজন ভারতীয় এবং সে খ্রীস্টন ধর্মের অনুসারী” ।

— Page: 21, Freedom Fighters of India by Lion M.G. Agrawal

এসময় ভারত ছাড় আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। গান্ধী এবং পাটেল জরুরী ভিত্তিতে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের তোড়জোড় শুরু করে। ওদিকে মুসলিমরা  মুসলিমরা বেশিরভাগ জিন্নার পক্ষে ও যুদ্ধের পক্ষে ছিলো। জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বও তাদের মনে সাড়া ফেলে। আন্দোলনের ফলাফল, কার্যকারিতা নিয়ে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, নেহেরু, পাটেল এবং গান্ধীর মধ্যে গভীর, তাৎপর্যপূর্ন কথা বার্তা,যুক্তি-তর্ক চলে।  আজাদ ভারত ছাড় আন্দোলনের পক্ষে প্রচার শুরু করেন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে লোকদের সাথে, কংগ্রেসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও কর্মিদের সাথে দেখা করে ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেন।   গান্ধীকে পুনের আগাখান প্যালেসে বন্দী  করা হয়।   

মৌলানা আবুল কালাম এবং কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিকে ঘ্রেফতার করা হয় এবং তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয় আহমেদনগর এর দূর্গে। পরবর্তি চার বছর তাদেরকে সেখানে একাকীত্বে বন্দীদশায় সময় কাটাতে হয়।  বাইরের খবররাখবর আদান-প্রদান ছিল সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। বন্দিদশায় খারাপ সময় কাটালেও তারা দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছেন ভেবে সন্তুষ্ট ছিলেন। বন্দী দশা কেটেছিলো আজাদেরটেনিস ম্যাচের রেফারি হিসেবে এবং ব্রিজ(কার্ড) খেলে।  সেসময়ে তিনি ভোরে ভোরে লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যকর্ম  Ghubhar-i-Khatir । আজাদ সে সময় তাঁর সহচর দের উর্দু ভাষা এবং পার্শিয়ান ভাষা শিক্ষার দেওয়ার কাজ করেন। একি সাথে তাদের সাথে বিশ্বের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেন তাঁর কতিপয় সহযোদ্ধার সাথে।  যদিও তারা বন্দী দশায় রাজনীতি নিয়ে বেশি কথা বলতনা। কিন্তু প্রতিবছর জানুয়ারীর ২৬ তারিখ তারা একত্র হয়। এদিনটিকে ধরা হত পূর্ন স্বরাজ ( পূর্ন স্বাধীনতা দিবস) দিবস হিসেবে ।  সেদিন তারা তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে নিজেদের ঐক্য নিয়ে আলোচনা করতেন। ১৯৪৩ সালে আজাদ এবং নেহেরু ব্রিটিশদের সাথে চুক্তিতে আসার প্রস্তাব ব্যক্ত করেন। সে সময় চলছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ ।  তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যদি ব্রিটিশ্রা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি থাকে তবে কংগ্রেসের উচিৎ ব্রিটিশদের সাথে চুক্তিতে আসা এবং অসহযোগীতা বন্ধ করা। যদিও তাঁর মতামত কে গ্রাহ্য করা হয়নি। ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ব্রিটিশরা ভারতের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়। সকল রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয় ১৯৪৬ সালে।

মৌলানা আজদ নির্বাচনে  কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছিলেন । জিন্নার পাকিস্তানের দাবির বিপক্ষে ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের ভারত ভাগের বিরোধীতা করেন তিনি। আজাদ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট এর পদ থেকে ১৯৪৬ সালে পদত্যাগ করেন এবং  তাঁর বদলে নেহেরু কংরেস প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব গ্রহন করেন। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর রচিত India Wins Freedom গ্রন্থে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। হয়ত তাঁর পদত্যাগের সীদ্ধান্ত আর জওহরলাল নেহেরুকে নির্বাচিত করার সীদ্ধান্ত সঠিক ছিলনা।

১৯৫৯ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থে  এ সম্পর্কে তিনি বলেন

I acted according to my best judgement but   the way things have shaped since then has made me realise that this was perhaps the greatest blunder of my political life. I have regretted no action of mine  so much as the decision to withdraw from the presidentship of the congress at this critical juncture . It was a mistake which I can describe in Gandhiji’s words as one of Himalayan dimension.

My second mistake was that when I decided not to stand  myself I did not support Sardar Patel. We differed on many issues but I am convinced that If he had succeeded me as congress president he would have seen that the cabinet mission plan was successfully implemented . He would have never committed the mistake of Jawaharlal which gave Mr Jinnah the opportunity of sabotaging the plan . I can never forgive myself  when I think that if I had not committed these mistakes , perhaps the history of the last ten years would have been different.

(Page: 162 India Wins Freedom by Abul kalam Azad )

 জিন্নার ডিরেক্ট একশন ড্যা এর দারুন ভারত জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। হাজারে হাজারে মানূষের মৃত্যু হয়েছিল সে ঘটনায়। মৌলানা আজদ সে সময় বাংলা , বিহার  এ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। মুসলিম লীগের অনেকেই মৌলানা আজদ কে এই বলে সমালোচনা করেন যে তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কে সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ভাবে হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত করতে হিন্দুদের পাশে ছিলেন।

 সেই দুঃসময় এ ও মৌলানা আজাদ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির উপর বিশ্বাস রাখেন। তিনি বলেন 

  “I am proud of being an Indian. I am part of the indivisible unity that is Indian nationality. I am indispensable to this noble edifice and without me this splendid structure is incomplete. I am an essential element, which has gone to build India. I can never surrender this claim.”

page:24, Freedom Fighters of India by Lion  M.G. Agrawal

১৯৪৭ সালের দিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরো বেগবান হয়। ৩ জুন , ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতকে ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়।  মৌলানা আজাদ গোপনে এ বিষয়ে গান্ধী, পাটেল, নেহেরুর সাথে বৈঠক করে।  দূরদর্শি মৌলানা আজাদ লীগের জনপ্রিয়তা বুঝতে পেরেছিলেন, এও বুঝতে পেরেছিলেন এভাবে চলতে থাকলে গৃহ যুদ্ধ  অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। এর পর আজাদ একরকম চুপ হয়ে যান। (AICC-All India Congress Committee) সম্মেলন   চলাকালীন তিনি আর এ বিষয়ে কথা বলেন নি। যার অর্থ দাঁড়ায় ভার- ভাগের নীরব সমর্থন ।

১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। পাঞ্জাব,বিহার,বাংলা, দিল্লী ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গা শুরু হয়।  লাখ লাখ মুসলিম নব সৃষ্ট পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য যাত্রা শুরু করে। এই সময় প্রায় ১ মিলিওন এর মত মানুষের প্রান হানীর ঘটনা ঘটে। বেঙ্গল,বিহার,আসাম,পাঞ্জাব এর দাঙ্গাপ্রবন এলাকায় মৌলানা আজাদ মুসলমানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হন।   পরবর্তিতে  মৌলানা আজাদ ছিলেন প্রাইম মিনিস্টার নেহেরুর আস্তাভাজন এবং পরামর্শকদের মধ্যে অন্যতম। জাতিয় নীতি নির্ধারনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আজাদ দেশ জুড়ে শিক্ষার বিস্তারের জন্য কাজ করেছেন সর্বাতবক ভাবে।

তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে তিনি দরিদ্র এবং মেয়েদের শিক্ষার উপর জোর দেন।  এক কনফারেন্সে তিনি বলেন ,

“আমাদের এক মুহুর্তের জন্য ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়, অন্তত পক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার  যেটা ছাড়া কেউ নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব সম্পূর্ন পালন করতে পারেনা”

 মৌলানা আজাদ তাঁর জীবনের শেষ সময়গুলো কাটিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত বই India Wins Freedom লিখে। যেখানে পাওয়া যায় ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কে সম্মক ধারনা এবং সে সময়ের নেতাদের ভূমিকার  কথা । বইটি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।

শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে তাঁর চিন্তাচেতনা ছিল দূরদর্শি।  ইউনিভার্সিটি অব দিল্লী, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন   প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা অতুলনীয় ।মৌলানা আবুল কালাম আজাদ শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন ভারতকে এক রাখতে। মৌলানা আজাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিতে তাঁর বিশ্বাস তাকে এখনো মানুষের হৃদয়ে সম্মানের জায়গা দেয়। আধুনিক ভারতে, এবং এই আধুনিক ধ্যান ধারণার যুগেও মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি  এর প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় । মৌলানা আজাদের সম্মানে এবং স্মরনে ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে তাঁর নাম  জুড়ে আছে। যেমনঃ মৌলানা আজাদ মেডিকেল কলেজ, মৌলানা আজদ ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি, মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু ইউনিভার্সিটি,  মৌলানা আজাদ কলেজ, মৌলানা আজাদ স্টেডিয়াম, মৌলানা আজদ জাদুঘর ইত্যাদি।

২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৮ সালে তারে জীবনের সমাপ্তি ঘটে।   জহরলাল নেহেরু মৌলানা আজাদ সম্পর্কে বলেছেন

  একজন খুবি সাহসী এবং ভদ্রলোক, সাস্কৃতিক উৎকর্ষের শেষ কথা যা এই যুগে খুব কম মানুষের সাথে সম্পর্কিত  ।

মহাত্মা গান্ধী মৌলানা আজাদ সমর্কে বলেন,  

 প্ল্যাটো, এরিস্টটল , পিথাগোরাসের সম্পর্যায়ের ব্যক্তি

 মৌলানা আজাদের জন্ম তারিখ ১১ নভেম্বর ভারতের জাতিয় শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। আর তাঁর প্রয়াণ দিবস  ২২ ফেব্রুয়ারীতে হয়ত জাতির সামনে ভেসে উঠে অতীতের ইতিহাস, তাঁর ত্যাগের কথা। অখন্ড ভারতের জন্য তাঁর সোচ্চার কণ্ঠস্বর ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য তাঁর সর্বাত্মক চেষ্টার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।

তথ্য সূত্রঃ 

Page: 162 India Wins Freedom by Abul kalam Azad

 page:24, Freedom Fighters of India by Lion  M.G. Agrawal

Page: 21, Freedom Fighters of India by Lion M.G. Agrawal

আরো লেখনী পড়তে ভিজিট করুনঃ

জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকঃ চলমান বিশ্বকোষ ও জ্ঞানতাপস 

                বাংলায় ইসলামী জীবনের ইতিকথা

শ্রদ্ধেয় আবদুল কায়্যুম নিজামী স্যার

একটি অদম্য দম্পতির জীবনের অনুপ্রেরণার গল্প

<

  

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন