আমি একজন প্রাইভেট টিউটর

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

কজন ছাত্র তার শিক্ষাজীবনের কোন না কোন মুহুর্তে প্রাইভেট বা টিউশানিতে যুক্ত হয়েছেই! টিউশানি থেকে প্রাপ্ত সম্মানী দিয়ে অনেকের কোনমতে পকেট খরচ চালায় আবার অনেকে সম্মানী ব্যাংকে রাখে।আজকে আমার টিউশানি জীবনের অনেক ঘটনা তুলে ধরবো যা অনেকের সাথে মিলে যাবে এ আশা রাখি। আমার মূল টিউশানি জীবন শুরু হয়েছিলো লালমনিরহাটে। বাড়ি থেকে লালমনিরহাটে গেলাম পড়াশোনার জন্য। গিয়েই মেসে না উঠে পরিচিত আন্টির বাসায় উঠলাম। কিন্তু বাসায় একটাই সমস্যা, বাইরে খেতে হবে।মেসে যে পরিমান খাওয়া দেয় তাতে আমার একদমই চলেনা।পাতলা ডালের বাটিতে প্রথম দিন হাত ধোয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।বাড়ি থেকেও মোটামুটি অর্থ দেয়,কিন্তু চাঞ্চল্য মন তাই নিতে সংকোচ লাগে! অবশ্য আন্টি একটা টিউশানি জোগাড় করে দিলেন। সেই টিউশানির বদৌলতে সকালের নাস্তা খাওয়া হয়।সাথে শ, সাতেক টাকাও জুটলো। টিউশানি করাতে গিয়ে বিপাকে পড়লাম! ৫ম শ্রেণীর ছাত্র, কিন্তু আমার চাইতে বেশি বোঝে।আমি পড়াই একটা আর তিনি পড়েন আরেকটা! সে ২য় সাময়িক পরীক্ষা দেবার পর আমি তাকে পড়াতে শুরু করেছিলাম। ২য় সাময়িক পরিক্ষায় আমার একমাত্র ছাত্র ৪ সাবজেক্টে ফেল করে বসলো! আর সেই দায় আমার ঘাড়ে বর্তালো! বাধ্য হয়ে টিউশানি বাদ দিতে চাইলাম। পড়ে অবশ্য তার মা ভূল স্বীকার করায় আমি পড়িয়েছিলাম এবং সে সমাপনীতে জিপিএ ৪ পায়। আর এতে করে আমারো টিউশানিতে ফোর পিটানো শুরু হলো! পরের বছরের শুরুতে মোটামুটি চারটি বাচ্চা পড়ানো শুরু করলাম। কিছুদিন পর তারা দুই বেলা খাওয়ার অফার করলো।বাচ্চাদের মধ্যে ২ জন প্রচন্ড আলসে, দুইদিন পর পর মার খায়। এদিকে ছাত্রছাত্রীর মা মানা করে দিলেন, তাদেরকে মাইর দেওয়া যাবে না! যা হোক পড়াতে গিয়ে দেখলাম সব কয়েকটি পড়া চোর তার উপর এদিকে পড়াই এদিকে ভূলে যায়!

একদিনের ঘটনা, প্রাইভেট পড়িয়ে চলে এসেছি। প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে রাতে খেতে গেলাম। গিয়ে দেখি বাড়ির গেটে তালা দেওয়া।পকেটেও সেরকম টাকা না থাকায় সে রাতে না খেয়ে ছিলাম। একা একা এইদিন আমাকে অনেক অসহায় মনে হয়েছিলো। তারা প্রায় সাতদিন অন্য কোথাও ছিলো। আমিও এই সাত দিন বাইরে খাওয়া দাওয়া করে বাড়ি থেকে যা আনি তাও শেষ করে ফেললাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো অষ্টম দিনে,তারা ফেরত আসলো। এসেই আমার জন্য আফসোস করলো। কিন্তু এতদিনে আমার পকেট করুণ সুরে গান গাওয়া শুরু করেছে।

যাহোক, কিছুদিন পরে খাওয়া বাদ দিয়ে তারা সম্মানী দেওয়া শুরু করলো। এতে আমিও লাভবান হলাম। এদিকে বাঁধ সাধলো আমার এক ছাত্রের খালা, ললনার কঠিন দৃষ্টি অন্য কিছুর ইংগিত করে। এরপর দুইদিন দুইটি চিরকুট হাতে ধরিয়ে দেয়ায় সেই প্রাইভেট বাদ দিয়ে দিলাম। তার বছরখানেক পর লালমনি জীবনের সব প্রাইভেট এর ইতি ঘটলো।বাড়িতে আসার পর ভাইয়ার বদৌলতে প্রায় ছত্রিশ খানেক ছাত্র ছাত্রী জুটলো।চাপ নিয়ে পড়াতে শুরু করলাম। মাসের শুরুতে হাতে ঢের অর্থ আসে, কিন্তু মাস শেষে দেখা যায় চলার মত পয়সা নেই। এমনও দিন যায়, পকেটে দুই টাকা নেই অথচ প্রাইভেটের বাড়িতে হাজার হাজার টাকা পড়ে থাকে। প্রাইভেটে যতই ভালো করে পড়াইনা কেন,  রেজাল্ট একটু খারাপ হলে সব দোষ প্রাইভেট মাস্টারের! এইতো কিছুদিন আগে এক প্রাইভেটে দুইদিন আসিনি জিজ্ঞেস করলও আসিনি কেন! অথচ তারা যখন আত্মীয়র বাড়িতে গেলো,সপ্তাহখানেক থাকলো তখন তাদের পড়া নষ্ট হয় না। প্রত্যেকটা প্রাইভেটের যে বাচ্চাকাচ্চা থাকে তাদের অভিভাবকগণ দুহাতে টাকা খরচ করে অথচ প্রাইভেট টিচারের সম্মানী দিতে দিতে মাসের মাঝামাঝি চলে যায়।এই যে সারাদিন পড়ালাম, রাত হতে হতে গলার প্রচন্ড সমস্যা হয়, মাথা প্রচন্ড ঝিমঝিম করে,অথচ সবাই ভাবে প্রাইভেট পড়িয়ে দুহাতে টাকা ভরছি! বাড়িতে সকালের ব্যাচ ছিলো দুইটা, ভালোই পড়াতাম, মাস শেষ হওয়ার আগে দেখা যায়, অর্ধেকই টাকা দেওয়ার আগে ভেগে যায়। এই রকম ব্যাপার প্রত্যেক টিউশন স্যারের ক্ষেত্রে ঘটে।আমি কোন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে যুক্ত নই,অথচ এভাবে পড়াই দেখে কত স্যার হিংসা করে তার ইয়াত্তা নেই। অথচ তারা ক্লাশে ঠিকমত পাঠদান করেনা অথবা ছাত্রছাত্রীরা স্কুলের প্রতি মনোযোগী নয় বা বাড়িতে পড়েনা দেখেই আমাদের কাছে ছাত্রছাত্রীরা পড়ে। আমি বা আমরা স্যারের কাতারে পড়ি না! অনেক প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী আছে যারা এই অভাগা স্যারদের দেখে কুশলাদি জানারো প্রয়োজন মনে করে না। মাঝে মাঝে দেখে এড়িয়ে যায়!  এত সব অসম্মানীর সম্মানীতে তবুও আমি পড়াই, কারণ আমি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান।আর আমার মতো হাজার হাজার শিক্ষিত বেকারের পথ চলার সম্বল এই টিউশানি। আর আমার এই কষ্টের মধ্যে যদি আমার পরিবারের খরচ কমাতে পারি,আমার মেধাকে সূচারু রুপে প্রকাশ করতে পারি, তাদের মেধা বিকাশে সাহায্য করতে পারি, তবে সে কৃতিত্ব আমারই প্রাপ্য। (সমাপ্ত)

লেখকঃ সাঈদ আল রবি।

রচনাকালঃ ৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৮।

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন