আবদুল্লাহ আল মুতী – কঠিন বিজ্ঞান কে শিশুদের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন যিনি

Please log in or register to like posts.
পোস্ট

আবদুল্লাহ আল মুতীর সম্পূর্ন নাম আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন। জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি। তিনি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ। তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা লেখি করেছেন। তিনি বিজ্ঞানের লেখক হওয়ার সাথে সাথে একজন বিজ্ঞান কর্মি ও ছিলেন বটে। পেশায় ছিলেন সরকারি কর্মকরতা।তিনি কোমল মতি শিশুদের জন্য বিজ্ঞান এর সহজ সরল ব্যাখ্যার মাধ্যমে বই লিখেছেন। তাঁর সম্পূর্ন নাম অনেকেই না জানলেও তিনি আবদুল্লাহ আল মুতী নামেই বিশেষ ভাবে পরিচিত। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয় গুলোকে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন সহজ ভাবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞান লেখকদের মধ্যে তিনি ২য় ব্যক্তি যিনি ইউনেস্কোর কলিঙ্গ পুরুস্কার লাভ করেন।

 

আবদুল্লাহ আল মুতীর জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে।১১ ভাই বোনের মধ্যে  আবদুল্লাহ আল মুতী সবার বড়।মার নাম হালিমা শরফুদ্দিন, বাবার নাম শেখ মইন শরফুদ্দিন। ১৯৪৫ সালে তৎকালীন ঢাকার মুসলিম হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন, যাকে আমরা বর্তমা্নে এসএসসি বলি। তিনি পরীক্ষায় কলকাতা বোর্ডে ২য় স্থান লাভ করেন। পরবর্তিতে ১৯৪৭ সালে সাফল্যের সাথে আই এ পাশ করেন( ইন্টার) এবং ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তাঁর পড়া লেখার বিষয় ছিল পদার্থ বিজ্ঞান। পদার্থ বিজ্ঞানে সম্মান সহ স্নাতক হন ১৯৫২ সালে।এ সময়  তিনি বাংলা ভাষার জন্যে আন্দলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, হয়ত সে কারনেই ২য় শ্রেনী পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন মেধাবি বিজ্ঞানের ছাত্র, পরের বছর তিনি প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য শিকাগো তে যান। এরপর শিকাগো বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে শিক্ষায় এম এ পাশ করেন। ১৯৬২ সালে লাভ করেন পিএইচ ডি ডিগ্রী । তিনি তাঁর বিজ্ঞানের জ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে পরবর্তিতে লিখে গেছে অসংখ্য সারা জাগানিয়া বই।

 

আবদুল্লাহ আল মুতী কর্ম জীবন শুরু করেন রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে।  শিক্ষামন্ত্রনালয়তের যুগ্ম সচিব হিসেবে যোগ দেন ১৯৭৫ সালে। এর পর শিক্ষা প্রশাসন সহ ,মন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। আবদুল্লাহ আল মুতী  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের সচিব ছিলেন।পরে ১৯৮৬ সালে তিনি সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহন করেন। তিনি বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক অনেক গ্রন্থ প্রনয়ন করেন। তাঁর প্রকাশিত শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থের সংখ্যা ২৭ টি। অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ ককরেছেন ১০ টির মত বই।  তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ও কম নয়। ছাত্র জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। বিজ্ঞানের জটিল ও অবোধ্য বিষয় গুলোকে সাধারন মানুষের কাছে সহজ সরল করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল মুতীর ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। শিক্ষা , সাহিত্য, সংস্কৃতি মূলক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে তিনি সংস্লিষ্ট ছিলেন আমরন।আবদুল্লাহ আল মুতী মুকুল ফৌজ আন্দোলনে যোগ দেন ১৯৪৭ সালে। এর পরের বছরেই “মুকুল” নামে কিশোর পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি।মোহাম্মদি, আজাদি ইত্তেফাক পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। কেন্দ্রিয় কচি কাচার মেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

 

আবদুল্লাহ আল মুতী শিশুদের জন্য, ছোট দের জন্য বিভিন্য বিজ্ঞানের বই সহজ ভাষায় লিখেছিলেন। বিজ্ঞান নয় , যেনো রুপকথার গল্প।জাতিয় শিশু -কিশোর সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত। বাংলা একাডেমি, ঢাকা ও বিজ্ঞান শিক্ষা সমিতিতে তিনি সভাপতিত্ব করেন।  ঢাকার প্রথম মহাকাশ উৎসব বেক্সিমকো স্পেসফেস্ট এর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন এর  দশম বর্ষ পূর্তি উদযাপন  কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ২য় ঢাকা মহাকাশ উৎসব  “স্পেসফেস্ট ১৯৯৯ “ এর উপদেষ্টা ছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার সংস্কার ও আধুনিকিকরনে আব্দুল্লাহ আল মুতি প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থেকে এর উন্নতি সাধনে অবদান রেখেছেন।

 

আবদুল্লাহ আল মুতী যৌবনে  বাম পন্থী আন্দোলোনের সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তিতে ১৯৪৮ এবং ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছিলেন।  এর পরে তিনি আর রাজনীতিতে যোগ দেন নি। সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে থাকলে হয়ত তাঁর এত এত যে বই, তা আলোর মুখ দেখত না । রাজনীতি ছেড়ে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। তিনি শিশু কিশোর দের জন্যে লিখে গেছেন বিজ্ঞান বিষয়ক অসংখ্য বই।  তাঁর বই গুলো পড়ে বিজ্ঞানের প্রতি ভয় নয়, আড়ষ্টতা নয় বরং শিশু মনে কৌতুহল জেগে উঠে। তাদের বিজ্ঞান ভালো লাগে, তাদের নতুন কিছু জানতে ভালো লাগে। তাদের এই যে জানার আগ্রহ আবদুল্লাহ আল মুতী তৈরি করেছেন, এখানেই তাঁর লেখার সার্থকতা। বিজ্ঞানের বই দেখলে যেখানে শিশু মনে ভয় লাগার কথা, সেখানে তাঁর বই পরে শিশুরা হয়েছে বিজ্ঞান মনস্ক।

 

তাঁর বিখ্যাত বই গুলোত্র মধ্যে “এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে” (১৯৫৫) উল্লেখযোগ্য। তাঁর অন্যান্য বই গুলো ও সমান ভাবে আলোচিত, সর্বজন গৃহীত। বই গুলো হলো – “অবাক পৃথিবী”(১৯৫৫)  , আবিষ্কারের নেশায় (১৯৬৯) , “রহস্যের শেষ নেই”(১৯৬৯) । “ বিজ্ঞান ও মানুষ” (১৯৭৫) “জানা-অজানার দেশে”(১৯৭৬) আবদুল্লাহ আল মুতীর দুটি বহুল আলোচিত গ্রন্থ। এছাড়াও আছে, “সাগরের রহস্যপুরি”(১৯৭৬) , “আয় বৃষ্টি ঝেপে”(১৯৮০), এ”এ যুগের বিজ্ঞান”(১৯৮১), “মেঘ বৃষ্টি রোদ”(১৯৮১),  “ফুলের জন্য ভালোবাসা” (১৯৮২), “ সোনার এই দেশ” (১৯৮৩), “তারার দেশের হাতছানি”(১৯৮৪), “বিচিত্র বিজ্ঞান”, “বিপন্ন পরিবেশ” (১৯৮৫), “প্রানলোক ; নতুন দিগন্ত”(১৯৮৬) ,” বিজ্ঞানের বিস্ময়” (১৯৮৬) , “টেলিভিশনের কথা “(১৯৮৮), “বিজ্ঞান জিজ্ঞাসা”, “কিট পতঙ্গের বিচিত্র জগত” , “কাজি মোতাহের হোসেন”,(১৯৮৮) , “বিজ্ঞান এগিয়ে চলে”(১৯৯১), ‘চোখ মেলে দেখ”(১৯৯২), “ফারিয়া নাদিয়ার মজার সফর”, “পরিবেশ সংকট ঘনিয়ে আসছে”, “আজকের বিজ্ঞান ও বাংলাদেশ” (১৯৯৬)   । এ সম্পর্কিত শেষ বই “ মহাকাশে কি ঘটছে”(১৯৯৭)।

 

আবদুল্লাহ আল মুতী সে সময় শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করতেন। তিনি নিয়ে শিক্ষা বিষয়ক কিছু বই লিখেছেন। এদের মধ্যে “শিক্ষা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ “(১৯৭৫) , “শিক্ষান ও বিজ্ঞান- নতুন দিগিন্ত” (১৯৯১) , “ আমাদের শিক্ষা কোন পথে” (১৯৯৬) বই গুলো উল্লেখযাগ্য। তাঁর অনুবাদকৃত গ্রন্থের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ১৯৫৬ সালে রচিত হয়” আকাশের সঙ্গে মিতালী”। এর পর ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়, “মহাবীর পরমানু”(১৯৫৭), “রহস্যটা জানতে হবে”(১৯৫৮), “সেকালের জীবজন্তু”(১৯৫৮),  “তাপ’ (১৯৫৮), “আলো”(১৯৬১), “শিক্ষা ও জাতিয় উন্নয়ন”(১৯৬৫),” বিশ্ব সৃষ্টির মাল মসলা” (১৯৬৫) । এছাড়াও দ্বৈত ভাবে মিনা শরফুদ্দিনের সঙ্গে ১৯৭১ সালে রচনা করেন “পরমানুর রাজ্যে”। ত্যার অপ্রকাশিত বই এর মধ্যে “কম্পিউটারের আশ্চর্জ জগত” উল্লেখযোগ্য। “আধুনিক বিজ্ঞান”(১৯৬৮), “বাংলাদেশের বিজ্ঞান চিন্তা”(১৯৮৮), “Education for all”(1968) সহ আরো বিভিন্নগ্রন্থ রচনায় তিনি সম্পাদনার দায়িত্বে চ্ছিলেন।

 

বিজ্ঞানের কঠিন ভাষা তিনি পরিহার করতেন, তাঁর ভাষা ছিল খুবি সহজ, এত সহজ ভাষায় বিজ্ঞান বোঝানোর ক্ষমতা খুব কম লেখকের থাকে। তিনি  বিভিন্ন ক্ষেত্রে ,বিশেষ ভাবে বলতে গেলে বিজ্ঞান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য বিভিন্য পুরুস্কারে ভূষিত হন। তিনি সাহিত্যের জন্য  ইউবিএল পুরুস্কার পান ১৯৬৯ সালে। বিজ্ঞান কে জনপ্রিয় করার জন্য ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক কলিঙ্গ পুরুস্কার পান ১৯৮৩ সালে। স্বাধীনতা পদক পান ১৯৯৫ সালে। এছাড়াও তিনি  শিশু একাডেমি পুরুস্কার সহ আরো অনেক সম্মানে সম্মানিত হন। আবদুল্লাহ আল মুতী সারা জীবন বিজ্ঞানের প্রসারে কাজ করে গেছেন। তিনি তাঁর অবদানের জন্য যথেষ্ট সম্মান ও পেয়েছেন।  আবদুল্লাহ আল মুতীর প্রয়াস ছিল বিজ্ঞান নিয়ে মানুষের মনের , শিশু মনের অন্ধকার দূর করা । মহান শিক্ষাবিদ , বিজ্ঞান লেখক ও বিজ্ঞান কর্মী ১৯৯৮ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন।

 

রেফারেন্স  1 https://en.wikipedia.org/wiki/Abdullah-Al-Muti

ফেসবুক কমেন্টস

Reactions

0
0
0
0
0
0
Already reacted for this post.

প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য করুন